-67c3088458ab9.jpg)
ফুটবল কি নেহায়েতই একটা খেলা? আধ শতাব্দী আগে হলে তা বলা যেত হয়তো। তবে সময়ের সাথে সাথে তা যেন ওই ১১৫ গজের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার অন্যতম এক হাতিয়ার বনে গেছে এই খেলা।
তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে রমজানে। মুসলিম বিশ্বের পবিত্রতম এ মাসেও ইউরোপের মুসলিম ফুটবলারদের জন্য রমজানের রোজা রাখা এক সময় ছিল বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে পরিস্থিতি, বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গিও।
ইউসেফ চিপ্পোর গল্প সেই পরিবর্তনের সাক্ষ্য দেয়। ১৯৯৭ সালে পর্তুগালের ক্লাব এফসি পোর্তোতে যোগ দেওয়ার পর, এই মরক্কান মিডফিল্ডার লুকিয়ে রেখেছিলেন এক বড় সত্য—তিনি রোজা রাখছিলেন নিয়মিত। দিনের পর দিন না খেয়েই কঠিন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মুখ ফুটে একটা কথাও বলেননি। অবশেষে, মাথাব্যথা আর দুর্বলতার কবলে পড়ে শেষমেশ তাকে স্বীকার করতেই হলো সত্যটা। ক্লাব তখনই ব্যবস্থা নেয়, তার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করে যেন তিনি রোজা রেখেও সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স দিতে পারেন।
তবে চিপ্পোর মতো অনেক মুসলিম খেলোয়াড়ের জন্য পরিস্থিতি এত সহজ ছিল না। ইউরোপীয় ফুটবলে এক সময় রোজাকে দেখা হতো নেতিবাচক দৃষ্টিতে। এমনকি দলের স্বার্থে খেলোয়াড়রা নিজেরাই কৌশল খুঁজে নিতে বাধ্য হতেন। সূর্যাস্তের পর রোজা ভাঙতে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে সতীর্থরা কৌশলে চোট অভিনয় করতেন, যেন মুসলিম খেলোয়াড়রা সাইডলাইনে গিয়ে একটু পানি আর খেজুর খেতে পারেন। ট্রেনাররা মাঠে নেমে ‘ইনজুরি ট্রিটমেন্ট’-এর নামে লুকিয়ে নিয়ে আসতেন ফল বা এনার্জি ড্রিংক।
কিন্তু দিন বদলেছে। আজ ফুটবলে মুসলিম খেলোয়াড়দের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে, তাদের প্রয়োজনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগসহ ইউরোপের বড় বড় লিগ এখন মুসলিম ফুটবলারদের জন্য অনুশীলনের সময়সূচি পরিবর্তন করছে, ম্যাচ চলাকালীন রোজা ভাঙার জন্য বিরতি দিচ্ছে, এমনকি পুষ্টিবিদরা বিশেষ খাদ্য পরিকল্পনাও করছেন।
লিভারপুলের সাবেক তারকা সাদিও মানে বছর কয়েক আগে দলের অধিনায়কের মাধ্যমে কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের কাছে অনুরোধ করেন যে, যেন অনুশীলন সকালের দিকে রাখা হয়, যাতে তিনি ও মোহাম্মদ সালাহ রোজার সুবিধা পান। কোচ রাজি হন।
একই দৃশ্য দেখা গেছে আর্সেনালেও। দলটির সাবেক মিশরীয় মিডফিল্ডার মোহাম্মদ এলনেনি জানান বিষয়টা, ‘তারা এটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, কারণ তারা বোঝে এটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আর আমাকে ফিট রাখা তাদের জন্যও দরকার।’
শুধু আর্সেনাল বা লিভারপুল নয়, ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ ক্লাবই এখন এই পথ অনুসরণ করছে। এমনকি ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের লিগে ম্যাচ চলাকালীন ‘রমজান ব্রেক’ এর চলও দেখা যাচ্ছে এখন, যাতে মুসলিম খেলোয়াড়রা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতে পারেন।
কিন্তু সব দেশ সমানভাবে গ্রহণ করেনি বিষয়টা। ফ্রান্সের ফুটবল ফেডারেশন রোজার কারণে ম্যাচ থামানো নিষিদ্ধ করেছে, এমনকি তাদের অনুশীলন ক্যাম্পে থাকা খেলোয়াড়দের রোজা রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও হয়েছে, এক খেলোয়াড় ক্যাম্প ছেড়ে চলে যান বছর কয়েক আগে।
ইংল্যান্ডের মতো দেশে অবশ্য সম্প্রীতি আর গ্রহণযোগ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি দিনে দিনে দৃঢ় হচ্ছে। প্রিমিয়ার লিগ ২০২১ সাল থেকেই ম্যাচ চলাকালীন মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য সুনির্দিষ্ট বিরতির ব্যবস্থা করছে। খেলোয়াড়দের ইউনিয়ন পর্যন্ত রমজান নিয়ে একটি ৩০-পৃষ্ঠার নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে রোজা রেখে কীভাবে শারীরিক সামর্থ্য বজায় রাখা যায় তা বলা হয়েছে। ইউনিয়নের প্রধান নির্বাহী মাহেতা মোলাঙ্গো বলেছিলেন, ‘মুসলিম খেলোয়াড়দের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে বলা নয়, বরং পরিবেশকেই তাদের দিক থেকে বোঝা উচিত।’
এই পরিবর্তন রাতারাতি আসেনি। ইউসেফ চিপ্পো যখন ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে আসেন, তখন তাকে নিজে থেকেই রোজা রাখার কৌশল বের করতে হয়েছিল। খেলার সময় মাঠের এক পাশে একজন সহকারী দাঁড়িয়ে থাকতেন হাতে খেজুর আর পানির বোতল নিয়ে, যেন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তিনি দ্রুত তা গ্রহণ করতে পারেন।
২০২১ সালে ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবার রমজান বিরতি দেওয়া হয়। ক্রিস্টাল প্যালেস ও লেস্টার সিটির ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় এ রেওয়াজ। দলের মেডিক্যাল স্টাফরা রেফারির সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন, যেন সঠিক সময়ে বিরতি দেওয়া হয়। সাবেক ক্রিস্টাল প্যালেস ডাক্তার জাফর ইকবাল বলেন, ‘বল বাইরে গেলে খেলা সামান্য থেমে যায়, আর দুই খেলোয়াড় দ্রুত সাইডলাইনে গিয়ে পানি ও খেজুর খেয়ে ফিরে আসেন। কেউ বুঝতেই পারেনি, এতটাই সাবলীল ছিল পুরো ব্যাপারটা।’
কিন্তু সব কোচই যে রমজানকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন, তা নয়। ২০০৯ সালে ইন্টার মিলানের কোচ হোসে মরিনহো গনায়ান মিডফিল্ডার সুলেই মানতারিকে মাঠ থেকে তুলে নেন এই বলে যে, রোজার কারণে তার শক্তি কমে গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, তার মন্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। মোহাম্মদ এলনেনি বলেন, ‘আমি প্রতিটি অনুশীলনে অংশ নিই, শুধু খাবার আর পানীয়ের সময়টা বদলে নেই।’ ম্যাচের দিনে যদি তিনি শুরুর একাদশে থাকেন, তবে ইসলামিক বিধান অনুযায়ী সেই দিনের রোজা পরে কাজা করে নেন, যাতে তার সতীর্থরা মনে না করেন যে তিনি দলের প্রতি কম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু এতকিছুর পরও, রোজার সময় মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য এটি সহজ নয়। কারণ রোজা রেখে মাঠে খেলাটা যে সহজ নয়। কাজটা কেমন কঠিন, তা বুঝতে আইরিশ ফুটবলার পল ম্যাকশেন একবার একদিনের জন্য রোজা রেখেছিলেন তার মিশরীয় সতীর্থ আহমেদ এলমোহামাদির সঙ্গে।
এলমোহামাদি বলেন, ‘এটা দারুণ ব্যাপার ছিল, তবে একদিন করেই সে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ৩০ দিন এটা করা তার পক্ষে অসম্ভব!’
ফুটবল মাঠে এই পরিবর্তন শুধু মুসলিম ফুটবলারদের জন্য সুবিধা দিচ্ছে না, বরং পুরো খেলার পরিবেশকেই আরও সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলছে। আজকের ফুটবল শুধু খেলা নয়, বরং সংস্কৃতির মেলবন্ধনের দারুণ এক উদাহরণও বটে।