বিশেষ সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদুল আলম ববি
‘সাকিবের প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ হয়েছে, এটা লজ্জার অন্ধকার অধ্যায়’
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:১৫ পিএম
-67bc1c94f38f4.jpg)
সাজ্জাদুল আলম ববি ও সাকিব আল হাসান। কোলাজ: যুগান্তর
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরিচালক সাজ্জাদুল আলম ববি। দেশের ক্রিকেটের গৌরবজনক ওয়ানডে ও টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির আগের কথা, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা ক্রিকেট বোর্ডে ছিলেন তিনি। মাঝখানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সরে যেতে হলেও ২০০৭ সাল থেকে পরিচালক ছিলেন। সর্বশেষ ফারুক আহমেদের বর্তমান বোর্ড দায়িত্বগ্রহণের আগে বিসিবির টুর্নামেন্ট কমিটি প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সংগঠক।
বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অব্যাহতি, রাসেল ডমিঙ্গোর বিদায় থেকে শুরু করে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রত্যাবর্তন, সাকিব আল হাসানবিহীন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুপারিশ এবং বর্তমান বোর্ডের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন যুগান্তর অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুল মজিদ চৌধুরী। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব।
যুগান্তর: যে কায়দায় রাসেল ডমিঙ্গোকে সরিয়ে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে পরিকল্পনা কি বোর্ডের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?
সাজ্জাদুল আলম ববি: রাসেল ডমিঙ্গোর সঙ্গে আমি নিজেও সম্পৃক্ত ছিলাম দুয়েকটা ট্যুরে। আমি কাছ থেকে তাকে দেখেছি। ভালো কোচ ছিলেন। অনেক কোচ আছেন থিওরিটিক্যাল। তত্ত্ব নিয়ে চলেন। উনি গতরে কেটে মাঠে কাজ করার লোক। অনেক বেশি প্রাক্টিক্যাল। আমি মনেও করি না তিনি ফাঁকিজুকিও করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে তিনি আর তদবির করে কোচ হওয়া যায় না। বাংলাদেশে সে সুযোগটা আমরা দিতে পারিনি। কিছুদিনের মধ্যে, মিডিয়া থেকে তার প্রতি একটা নেতিবাচক আচরণ আমি লক্ষ্য করেছি। যেটা আসলে কিসের জন্য আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। পরে হয়ে গেলো বিষয়টা, সে সময় আমাদের প্রধান নির্বাচক (মিনহাজুল আবেদীন নান্নু) এবং এই হেড কোচ (ডমিঙ্গো), এই দুজনের নাম জড়িয়ে বিভিন্নভাবে প্রচার হলো। যেটা কিন্তু বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হয়নি। দলের ওপরও এটার প্রভাব পড়েছিল। চূড়ান্তভাবে কয়েকজনের মাথায় টিআরপি এবং অন্যান্য বিষয়গুলো মুখ্য ছিল।তারা হয়তো সে দিক দিয়ে সফল হয়েছ।কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এটা খুবই ক্ষতিকর একটা বিষয় হয়েছিল।
যুগান্তর: কিন্তু সে জায়গায় চন্ডিকা হাথুরুসিংহকে যেভাবে নিয়ে আসা হয়, মেয়াদ শেষ না করে আবার তাকে ছাঁটাই করা..
সাজ্জাদুল আলম ববি: আমি মনে করি কেউ যখন দায়িত্ব থেকে চলে যান অথবা তাকে অপসারণ করা হয়। সে দায়িত্বে তাকে আবার না নিয়ে আসাটা সমীচীন। এটা একেবারে করা যাবে না এমন নয়। তবে সেই একই ব্যক্তিকে একই দায়িত্বে বসানো সমীচীন নয়। কিন্তু তারা এটা করেননি, সে সময় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাদের চিন্তাভাবনা একরকম ছিল। ওই মুহূর্তে একটা জিনিস মনে রাখবেন, সেই পর্যায়ের কোচ যে বাজারে ঘুরে বেড়ায় এটাও না। অনেক লোক কোচিং করান, কিন্তু বাংলাদেশ দলকে আমরা এমন লোকের হাতে দিতে চাই। তার ব্যক্তিত্ব, অভিজ্ঞতা, খেলা নিয়ে অথবা কোচিংয়ে একদম উপরের সারির হবে, সেটা পাওয়াও কঠিন ছিল। অনেক কিছু চিন্তা করেই হয়তো তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু বোর্ড পরিচালক হয়ে একদম ব্যক্তিগতভাবে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা আমি প্রয়োজন ছিল মনে করি না।
প্রথম পর্ব পড়ুন: ৪ মাসে ৯ বার বিদেশ সফরে গেছেন কেউ কেউ, এর জবাবদিহি করতে হবে |
যুগান্তর: দুই বছরের চুক্তির এক বছর হতে না হতেই বিসিবির চাকরি ছেড়েছেন খ্যাতিমান কিউরেটর টনি হেমিং। বাংলাদেশের ক্রিকেট ও বিসিবি নিয়ে কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন তিনি। বিশেষ করে হেমিং দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘শ্রীলংকান মাফিয়া’ আছে। আপনি তো তখন বোর্ডে ছিলেন। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
সাজ্জাদুল আলম ববি: আমি উনার এই বক্তব্যটা বিভিন্নজনের কাছ থেকে শুনেছি। আপনার কাছ থেকেও যেভাবে পুনরায় জানলাম। এই বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গেলে আমার মনে হয় গ্রাউন্ডস কমিটি যারা আছেন, তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করাটাই ভালো। তারা এটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। যদিও আমিও পরিচালক ছিলাম। তবে আমার কাজ ছিলো ভিন্ন জায়গায়। যারা সংশ্লিষ্ট তারা এটার উত্তর দিলে ভালো হবে।

যুগান্তর: দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট খেলে সাকিবের অবসরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাঝপথে এসে তিনি ফিরে যান। এ ঘটনায় বর্তমান বোর্ড কি আরও দায়িত্বশীল হতে পারতো?
সাজ্জাদুল আলম ববি: আমি মনে করি এটা একটা প্রতিশোধমূলক আচরণ হয়েছে। সাকিব আল হাসান খেলতে চেয়েছেন। সে তো অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত হলেই সে দোষী এটা কোনোভাবে বলা যাবে না। তাকে এভাবে আটকে দেওয়া হলো, খেলা থেকে বিরত থাকা হলো, এটা কিন্তু সারাজীবন লজ্জার বিষয় হয়ে রইলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা এমন একটা অন্ধকার অধ্যায়, এটা কেউ কোনোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। আমার মনে হয়, যারা এই বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,তারা হয়তো রাজনৈতিক একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন দেশবাসীর কাছে। (পটপরিবর্তনের আগে) গত ৬ মাস ধরে সে বিদেশে। এটা আসলে এই প্রক্রিয়াটা রাজনৈতিকভাবে একটা বার্তা দেওয়ার জন্য। আমাকে আপনাকে যদি করা হতো সেটার কোনো প্রভাব পড়তো না। সাকিবকে করার ফলে একটা বার্তা সবার কাছে পৌঁছেছে, সেটাই ছিল মনে হয় উদ্দেশ্যটা। এটা নিন্দনীয়। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। এটা মেনে নেওয়া যাবে না।
আমি নিশ্চিত, প্রতিপক্ষ ম্যাচের আগে যে কৌশলগত চিন্তা করেন, সেখানে সাকিবকে নিয়ে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকে। এখানে সে থাকলে আমাদের সুবিধাটা ছিল। এখন যেহেতু বাস্তবতা এমন জায়গায়, তাকে খেলতে দেওয়া হচ্ছে না।
- সাজ্জাদুল আলম ববি
যুগান্তর: তারপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল থেকে সাকিব বাদ পড়েছেন। আপনি কি মনে করেন, শুধুমাত্র ব্যাটার হিসেবে সাকিব দলে জায়গা পেতে পারতেন?
সাজ্জাদুল আলম ববি: থাকতে পারতো। কিন্তু তার জায়গা কে খেলছে সেটাও দেখতে হবে। আমি মনে করি মাঠে তার উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। তবে এটা আমার কাছে কেমন জানি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন বিষয় মনে হচ্ছে, এতো বছর পর, এতো উইকেট এতো বছরের ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে এমন সন্দেহজনক বোলিংয়ের অভিযোগ! এতো বছর কোনো অভিযোগ হলো না, আলোচনা হলো না, বিষয়টা আমার কাছে বেশ সন্দেহজনক লাগে কেনো জানি। যদিও সাকিব নিজে কিছু বলেনি। অভিযোগটা এটা আসছে ইংল্যান্ড থেকে।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন: ৬০-৭০ বছর ধরে ঢাকার ক্লাবগুলো ক্রিকেট লালন-পালন করছে, গঠনতন্ত্র সংশোধন মানবে না |
যুগান্তর: সাকিবের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ কি মিস করবে?
সাজ্জাদুল আলম ববি: অবশ্যই। মাঠে তার থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় ব্যাটিং-বোলিংয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার উপস্থিতিটা প্রতিপক্ষকে মাথায় রাখতে হয়। আমি নিশ্চিত, প্রতিপক্ষ ম্যাচের আগে যে কৌশলগত চিন্তা করেন, সেখানে সাকিবকে নিয়ে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকে। এখানে সে থাকলে আমাদের সুবিধাটা ছিল। এখন যেহেতু বাস্তবতা এমন জায়গায়, তাকে খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা তার বোলিং অ্যাকশনের জন্য বলছি না আমি। অন্যান্য বিষয়ের কথা বলছি যা চলে আসছে, এটা না হওয়াটাই উচিত ছিল ক্রিকেটে। যারা ভুলটা করেছেন, আমি মনে করি তারা ভুলটা করেছেন, তাদের ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে পারা উচিত, যাতে সাকিব আবারও খেলার সুযোগ পায়। এটা আমি আশা করব।
যুগান্তর: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ দলকে ঘিরে আপনার প্রত্যাশা কি? দল কতদূর যেতে পারে?
সাজ্জাদুল আলম ববি: আমাদের দলের উপস্থিতিটা দেখছি, বেশ নতুন মুখ আছে। নতুন মানে আমাদের পুরনো যে মুখগুলো সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না। যারা এখন উন্মুক্ত আছেন, তাদের মধ্যে সেরা সম্ভাব্য দলটা এর মধ্যে রয়েছে। নির্বাচকরা দল বানাবেন, পরিচালকরা দেখাশোনা করবেন, মাঠে কিন্তু ক্রিকেটাররাই খেলবে। ওই দিন ওই মুহুর্তে দল কিভাবে খেলছে তার ওপর ভিত্তি করে রেজাল্টটা আসবে। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বেশ বড় টুর্নামেন্ট। ৫০ ওভারের বাংলাদেশেই প্রথম এই টুর্নামেন্ট হয়েছিল। এবার পাকিস্তানে হচ্ছে। বাংলাদেশ কিছুদিন আগে আমাদের খেলোয়াড়রা খেলে এসেছে। কন্ডিশন সম্পর্কে তাদেরও মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে। সেখানে প্রত্যেক ম্যাচেই রান হবে। সেখানে আমরা যদি রানটা করতে পারি আমাদের বোলিং ইউনিট যেটা আছে, তারা কিন্তু সেরকম তাদের দিক থেকে ম্যাচগুলো আমাদের অনুকূলে আনার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তবে বাকি দলগুলোও খেলতে যাবে। তারা কিন্তু যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেই যাবে। তাদের শক্তি সামর্থ্য কম না। এখানে প্রত্যেকটা ম্যাচে যেনো বাংলাদেশ দল ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক, সেটা আমরা চাই। একটা দলই জিতবে।
যুগান্তর: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সাজ্জাদুল আলম ববি: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।