
এর আগেও বহুবার এই স্টেডিয়ামে মানুষের কাঁধে চড়েছেন। সেদিনও চড়েছিলেন। তবে আর সব বারের সঙ্গে সেবারের পার্থক্যটা ছিল তাকে কাঁধে তোলা মানুষগুলোর অভিব্যক্তিতে। আগে যেখানে তাকে কাঁধে তোলার মুহূর্তটায় মিশে থাকত আনন্দের রেশ, সেখানে সেবার সবাই ভেসে যাচ্ছিলেন শোকের সাগরে।
কেনই বা যাবেন না? তর্কসাপেক্ষে বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের একজন, মোনেম মুন্না না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাও মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, যে বয়সে আজকার ফুটবলাররা অবসরের কথা ভাবতে শুরু করেন কেবল, সে বয়সে বিধাতা তাকে জীবন থেকেই অবসর দিয়ে দিলেন! বুক ভেঙে কান্না তো আসারই কথা! আজ থেকে ঠিক দুই দশক আগে এমন এক পরিস্থিতি নেমে এসেছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে; গোটা দেশেও নয় কি?
তাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় কথাটা বলেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। বলেছিলেন, ‘সে ভুল করে বাংলাদেশে জন্মেছে’। সে অটো ফিস্টারের প্রোফাইলটাও পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার, ঘানাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৯২ আফ্রিকান নেশন্স কাপের ফাইনালে, এরপরও ২০০৬ সালে টোগোকে নিয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। এমন একজন রত্ন চিনতে ভুল করবেন না নিশ্চয়ই!
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫ বছর আগে নারায়নগঞ্জে জন্ম তার। সেখান থেকেই ফুটবলে যাত্রা শুরু। পোস্ট অফিস দলের হয়ে পাইওনিয়ার লিগ দিয়ে পা রাখেন ঢাকার ফুটবলে। এরপরও শান্তিনগর ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের হয়েও খেলেছেন। তবে তিনি জাত চেনান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। সেখান থেকে পাড়ি জমান দেশীয় ফুটবলের পরাশক্তি আবাহনীতে।
লেফট ব্যাক থেকে শুরু, রাইট ব্যাকে খেলেছেন, মাঝমাঠে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবেও তার খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। তবে পজিশন যাই হোক, তার নিবেদন থাকত সর্বোচ্চ। আর রক্ষণে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। সে কারণেই তো, ১৯৯১ সালে আবাহনীর সঙ্গে তার চুক্তিটা হয়েছিল ২০ লাখ টাকার। ভাবুন একবার, ফুটবল তো গোলের খেলা, যাবতীয় গ্ল্যামার টেনে নিয়ে যান গোল স্কোরাররাই, সেখানে একজন ডিফেন্ডার হয়ে এত খ্যাতি, এত অর্থ! তিনি মুন্না বলেই হয়তো! এমন পারফর্ম্যান্সের কারণে তিনি বেতাজ বাদশাহ বনে গিয়েছিলেন দেশের ফুটবলের। তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘কিং ব্যাক’।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলেও খেলার সুযোগ পান। সেখানে তিন মৌসুমে তিনি নিজেকে মেলে ধরেন দারুণভাবে। ফ্যান ফেভারিট বনে যান ওপার বাংলাতেও।
জাতীয় দলেও তার অবদান ছিল অসামান্য। ’৮৯ এসএ গেমসের রূপা জিতেছিলেন। তবে তার অধীনেই প্রথম বহুজাতিক শিরোপাটা জেতে বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে গিয়েছিলেন ৪ জাতি টাইগার ট্রফিতে। সেবার ফাইনালে স্বাগতিক মিয়ানমারকে হারিয়ে বাংলাদেশ জেতে তাদের প্রথম বহুজাতিক ট্রফি।
মাঠের এই খ্যাতি মাঠের বাইরেও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ব্র্যান্ডদের জন্য তিনি ছিলেন হটকেক। লাইফবয়ের তৎকালীন শুভেচ্ছাদূতও বনে গিয়েছিলেন তিনি।
ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে যখন ছিলেন মুন্না, ঠিক তখনই তার পথ আগলে দাঁড়াল তার কিডনির সমস্যা। মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাকে সরে দাঁড়াতে হয় ফুটবল থেকে। মাঠ ছাড়লেও এই সমস্যা তার পিছু ছাড়ল না। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে কোটি ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাকে হারানোর ২ দশক পূরণ হলো আজ।