বিশেষ সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদুল আলম ববি
৬০-৭০ বছর ধরে ঢাকার ক্লাবগুলো ক্রিকেট লালন-পালন করছে, গঠনতন্ত্র সংশোধন মানবে না
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম
![৬০-৭০ বছর ধরে ঢাকার ক্লাবগুলো ক্রিকেট লালন-পালন করছে, গঠনতন্ত্র সংশোধন মানবে না](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/03/BSB-Content-02-for-Site-(1)-67a093b792028.jpg)
ছবি ও গ্রাফিক্স: যুগান্তর
ঢাকার ক্লাবগুলোর বিরোধিতার মুখে বাতিল হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আলোচিত গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির কার্যক্রম। তার আগে বোর্ড পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটি গঠনতন্ত্র সংশোধনী নিয়ে কাজ করছিল এবং কিছু প্রস্তাবও দাঁড় করায়। সংশোধনীতে বিসিবিতে ক্লাব কাউন্সিলর ও পরিচালনা পর্ষদে ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব কমানোর প্রস্তাব আনা হলে বিতর্ক তৈরি হয়।
যুগান্তর অনলাইনের বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ পরিচালক সাজ্জাদুল আলম ববি। এছাড়া বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অব্যাহতি, রাসেল ডমিঙ্গোর বিদায় থেকে শুরু করে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রত্যাবর্তন, সাকিব আল হাসানবিহীন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এবং বর্তমান বোর্ডের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এ সংগঠক। ২০০৭ সাল থেকে বর্তমান ফারুক আহমেদের বোর্ড দায়িত্বগ্রহণের আগ পর্যন্ত পরিচালক ছিলেন তিনি। এছাড়া ১৯৮৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা ক্রিকেট বোর্ডে কাজ করেছেন।
বিসিবির সাবেক টুর্নামেন্ট কমিটি প্রধানের এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুল মজিদ চৌধুরী। আজ থাকছে তিন পর্বের বিশেষ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব।
যুগান্তর: বাংলাদেশে ক্রিকেট দল-মতের উর্ধ্বে সব শ্রেণী পেশার মানুষের প্রিয়। ক্রিকেট এখানকার সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি কি মনে করেন ক্রিকেট থেকে রাজনীতি আলাদা থাকা উচিত? এটা কি সমর্থকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দিচ্ছে?
সাজ্জাদুল আলম ববি: না দেখুন, রাজনীতির বাইরে কিছু না। আপনি আমি ভোট দেই। তার মানে কি আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব? আমরা কিন্তু রাজনীতিতে সবাই। রাজনীতির বাইরে কেউ না। দেখুন, আমরা যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পাই, তখন সরকার থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। সেই সময় সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যদি না থাকতো বাংলাদেশ জীবনে কোনো দিন টেস্ট স্ট্যাটাস পেতো না। এখন যদি বলেন রাজনীতিকে খেলাধুলা থেকে আলাদা করবেন, তাহলে এটাকে কিভাবে আলাদা করবেন? রাজনীতি তো আছে, রাজনীতি থাকবে। সমস্যাটা হয় এখানে যোগ্যতা নেই আমার একেবারেও, বা অন্য কারো আছে। আমি রাজনৈতিক দলের কারো তদবিরের মাধ্যমে বা ফুসলিয়ে আমি এমন দায়িত্ব নিয়ে নিলাম, যে দায়িত্বে আমি যোগ্য না। সেটা হলো সমস্যা। কিন্তু রাজনীতির বাইরে কিছু না। রাজনীতি ইতিবাচকভাবেও দেখতে হবে। খেলাধুলার পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের অনাহুত হস্তক্ষেপ আমরা বর্জন করবো। এটা হলো বিষয়।
যুগান্তর: দেশের ক্রিকেট অনেক বেশি ঢাকা কেন্দ্রিক। ক্রিকেটে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গঠনতন্ত্রে সংশোধন ও সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ নিয়ে বর্তমান বোর্ড একটা কমিটিও গঠন করে। কিন্তু ঢাকার ক্রিকেট সংগঠকদের অসন্তোষ ও ম্যাচ বয়কটের মুখে ওই কমিটির গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুপারিশ বাতিল করে বিসিবি। একজন জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
সাজ্জাদুল আলম ববি: সংস্কার শব্দটা এখন অপব্যবহার হচ্ছে। আমরা চলে যাই মনে করি রেভ্যুলেশন করতে হবে। এটা ইভ্যুলেশনও হতে পারে। সেটার মাধ্যমে হলে গ্রহণযোগ্য হয়। আমাদের এখানে সংস্কারের নাম দিয়ে গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে। যেটা আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি, এটা কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের নির্বাচনি খায়েশ মেটানোর জন্য করা হচ্ছে। যাতে কিছু নিবেদিত প্রাণ সংগঠক নির্বাচন করতে না পারেন। না করতে পারলে হয়তো অনেকের দ্বার খুলে যায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রক্রিয়াটা পরিচালনা করা হয়েছে। এটা খুবই ঘৃণ্য ব্যাপার। এটার পেছনে আবার মদদ জোগাচ্ছে একটা গোষ্ঠীর কিছু নেতৃত্বাস্থানীয় ব্যক্তি, যারা এখানে ইন্ধন যোগাচ্ছেন তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য। এটা সরকারকে বুঝতে হবে। ক্রীড়াঙ্গনে যারা আছেন আমার মনে হয় তাদের অনেকে বুঝতে পেরেছেন। ক্লাবগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এটা খুব মার্জিতভাবে বিষয়টা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। এখানে ক্লাবরা আরও অনেক কঠিন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতো। সেটা তারা করেনি। এখন এই হীন প্রচেষ্টাকে ক্লাবরা প্রতিহত করবে। এটা কোনোদিন সফল হতে পারবে না। কারণ আমি যদি একটু পেছনে যদি যাই, ঢাকার ক্লাবরা ক্রিকেটের কথাই যদি বলি, গত ৬০-৭০ বছর ধরে ক্রিকেটকে কিন্তু লালন-পালন করছে। তারা খেলোয়াড়দের বেতন, অনুশীলন, থাকা খাওয়া, তাদের উৎকর্ষতার জন্য যা যা করণীয় তা করছে। এ বছর আমার ধারণা, এই ৭৬ ক্লাব মিলে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছে। ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য, চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি এটা বিনিয়োগ বলবো।। তো যারা ১০০ কোটি টাকার মতো যারা এখানে বিনিয়োগ করছে, তাদের আমি বাদ দিয়ে দেব? আমার ব্যক্তি স্বার্থে আমি নির্বাচন করবো দেখে, অন্যরা যাতে আর আসতে না পারে? এসব হীন মানসিকতা নিয়ে কথিত সংস্কারের আয়োজন করা হয়েছিল। এটা গ্রহণযোগ্য না।
পড়ুন প্রথম পর্বের সাক্ষাৎকার: ৪ মাসে ৯ বার বিদেশ সফরে গেছেন কেউ কেউ, এর জবাবদিহি করতে হবে |
যুগান্তর: কিন্তু দেশব্যাপী ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে কিছু পরিবর্তন তো প্রয়োজনীয় ছিলো..
সাজ্জাদুল আলম ববি: হ্যাঁ, আমি সংস্কার করার কথায় আসি। এখন দেখা যায় লিগের থার্ড ডিভিশনের একটা দলের একজন কাউন্সিলর। আবার ওইদিকে জেলায়ও দেখছি একজন কাউন্সিলর। শুনতে খারাপ লাগে না? খটকা লাগে না? একটা ক্লাব এতটুকু একটা, আবার একটা জেলা, এতো জনসংখ্যা, সেখানে কী এই সমান মর্যাদা পাবে? এটা কিন্তু বাস্তবতার কারণে হচ্ছে। থার্ড ডিভিশন টিমের যে সক্ষমতা আছে, একটা টিম বানিয়ে খেলাটাকে প্রচার করার। দুঃখজনক হলেও সত্য, জেলা পর্যায়ে সব জেলা এখনো যেতে পারেনি। তো যে পারে, আমি তাকে লালন-পালন করবো না? তাকে প্রমোট করবো না? আর যে পারে না তাকে আমি কীভাবে করবো? সংস্কার যদি করতে হয়, তাহলে করতে হবে এসব জেলা বা বিভাগে সক্ষমতা যাতে বাড়ে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা বিনিয়োগ করছে, খেলাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সামনের দিকে, এতোদিন করে এসেছে, যারা পরীক্ষিত, তাদের সংখ্যা কমিয়ে দেবো কেনো? তাদের ১০০ কোটির টাকার যে বিনিয়োগটা আছে, কাল যদি না করে তাহলে ক্রিকেটের কী খুব ভালো ব্যাপার হবে?
যুগান্তর: তাহলে সংস্কার হবে কীভাবে? আপনারা কি কোনো প্রস্তাবের কথা বলেছেন?
সাজ্জাদুল আলম ববি: সংস্কার অনেকভাবে হতে পারে, আমাদের জেলা পর্যায়ের ক্লাবগুলো অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন চলেই কিন্তু কিছু পাগল লোকের জন্য যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। পকেটের খরচের টাকা দিয়ে দলগুলোকে চালায়। এরকম প্রচুর কাহিনী আছে প্রচুর উদাহরণ আছে। এখন খরচ বেড়ে গেছে, পকেট থেকে যারা খরচ করতেন তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে, সবসময় না কিছু কিছু সময় এমন লোকের কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে যাদের কাছে টাকা আছে। তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা এনে দল চালাতে হচ্ছে। সেখানে আমাদের এখন ব্যবস্থা করা উচিত, সংস্কারটার পদক্ষেপ এভাবে নেওয়া উচিত, যাতে ক্লাব এবং জেলাগুলোর প্রতিষ্ঠিত বৈধ আয়ের উৎস থাকে। যেটা নিয়মিত। সেটা যদি সম্ভব হয়, এখানে সন্দেহজনক লোকজন আর জড়িত হতে পারবে না। এই বিষয়গুলো সংস্কারের মূখ্য বিষয় হওয়া উচিত। তার মানে এ নয় এখানে ওখানে তিনজন পরিচালক বাড়ালাম। চট্টগ্রামে তো দুজন পরিচালক আছেন, বা অন্য বিভাগেও আছে এরকম। খেলা হচ্ছে না কিন্তু সেভাবে। চট্টগ্রাম তো উল্লেখযোগ্য একটা জায়গা, সেখানে কিন্তু সেভাবে খেলা হচ্ছে না। যদি পরিচালক তিনটা হয়, কী এমন নিশ্চয়তা আছে খেলা রাতারাতি বদলে যাবে, ক্রিকেটের লিগ শুরু হয়ে যাবে!
যুগান্তর: যদি নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বাধীন বোর্ডের ব্যর্থতা ও সফলতা দুটোই সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়, কোন কোন বিষয়কে সামনে আনবেন?
সাজ্জাদুল আলম ববি: আমি মনে করি সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটো একসঙ্গে চলে। কখনো সবদিক দিয়ে সাফল্য, আবার সবদিক দিয়ে ব্যর্থ তাও না। আমি টুর্নামেন্টের কমিটির দায়িত্বে ছিলাম, আমরা গত ৩-৪ বছরে আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছি। যেখানে আমাদের ক্রিকেটারদের ঘরোয়া লিগ খেলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে। আমরা সেরা মানের উইকেট, পিচ, আউটফিল্ড করেছি। আউটফিল্ডে সে রকম ঘাস থাকবে। উইকেটে ৪ থেকে ৬ মিলিমিটার ঘাস থাকবে। আমরা বল দিয়েছি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেভাবে খেলা হয়। আমরা আম্পায়ারদের খেলোয়াড়দের বেতন বাড়িয়েছি, অ্যাকোমেডেশন, ট্রান্সপোর্টেশনে আমরা সব জায়গায় আমূল পরিবর্তন এনেছি। খেলার দিন যে খাবারটা দেওয়া হয়, সেটার মান আমরা যথেষ্ট মানসম্পন্ন করতে চেষ্টা করেছি। আমি যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট তা না, তবে এই বিষয়গুলো শুরু হয়েছে। এগুলোর সুফল সেগুলো কিন্তু একদিনে পাওয়া যাবে না। এগুলো চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের ক্রিকেটের উন্নয়নটা আমরা দেখতে পারবো পর্যায়ক্রমে। তো সেদিক দিয়ে আমরা মনে করি, ঘরোয়া ক্রিকেটে ন্যাশনাল লিগ, বিসিএল, আমরা যে পরিবর্তনটা আনতে পেরেছি এটা সবচেয়ে বড় সাফল্য। এখান থেকে জাতীয় দল পর্যন্ত এবং অন্যান্য বয়সভিত্তিক দল যারা আছে তারা উপকৃত হবে।