দুঃসময়কে পেছনে ফেলতে ‘পরিচয়’ বদলে ফেলছেন গার্দিওলা
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩০ পিএম
কোচ হিসেবে পেপ গার্দিওলার পরিচয় আপনার কাছে কী? তিনি একমাত্র কোচ, যিনি সিনিয়র পর্যায়ে কোচিংয়ের প্রথম দেড় মৌসুমের মাথায় সম্ভাব্য ৬টি শিরোপার সবকটি জিতেছিলেন, তিনিই একমাত্র কোচ, যিনি দুটো ভিন্ন দল নিয়ে এক বার করে মহাদেশীয় ট্রেবল জিতেছেন।
স্প্যানিশ এই কোচের সাফল্যের মূলে কী আছে? উত্তরটা আপনি জানেন, সেটা হচ্ছে তার পাসিং ফুটবলের দর্শন– তিকিতাকা। অনেক বছর হলো, গার্দিওলার দল পাসিং ফুটবল খেলে, কিন্তু তা তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের তিকিতাকা নয়। সে দর্শনে মাঠে ত্রিভুজ বানিয়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বলের দখল দূরে রাখা, বল হারিয়ে ফেললে ৫ সেকেন্ডে তা ফেরত আনতে তাদের ছেঁকে ধরার কৌশলের ভূমিকা অনেক বড়।
প্রিমিয়ার লিগের দ্রুতলয়ের ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আজ অনেক বছর হলো সে তিকিতাকার সঙ্গে আপস করেছেন গার্দিওলা। এই তো মৌসুম দুয়েক আগে অনেক ম্যাচে রক্ষণাত্মক কৌশলেও খেলতে দেখা গেছে তার দলকে।
তবে পেপ গার্দিওলাকে যে বিষয়টার সঙ্গে আপস করতে দেখা যায়নি, সেটা হলো ছোট ছোট পাস দিয়ে বলের দখল ধরে রাখার বিষয়টা। শেষ সাড়ে আট বছর ধরে ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়দের কান তিনি ঝালাপালা করেছেন একটা বাড়তি পাস খেলতে বলে বলে, তার দল অতিরিক্ত ‘ডিরেক্ট ফুটবল’ খেলে বলে দলের প্রতি তার উষ্মা প্রকাশ পেত হরহামেশাই।
চেলসির বিপক্ষে শনিবার রাতের ম্যাচে দেখা গেল অদ্ভুত এক বিষয়। গার্দিওলার দল এগিয়ে আছে ম্যাচে, মাঝ মাঠ থেকে কেউ খেলাটার গতি কমাতে চাচ্ছেন, আর সে বিষয়টা সহ্য হচ্ছে না কাতালান কোচের। ৮৭ মিনিটে ইলকায় গুন্দোগান যখন বল পায়ে নিয়ে পেছনের দিকে ফিরলেন, ডাগ আউটে রীতিমতো ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন পেপ।
তার দল এরপর প্রতিক্রিয়াটা দেখাল। গুন্দোগান বলটা ঠেলে দিলেন গোলরক্ষক এদেরসনের কাছে, সেখান থেকে বলটা তিনি গলফ বলের মতো করে সামনে বাড়ালেন ওপরে থাকা আর্লিং হালান্ডকে লক্ষ্য করে। নরওয়েজিয়ান ফরোয়ার্ড প্রতিপক্ষ রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে বলটা বাড়ান ফিল ফোডেনকে, সেখান থেকে সহজ এক গোল সিটিকে এনে দেয় ৩-১ গোলের লিড।
সে গোলটা অনেকটাই ২০ মিনিট আগে করা দ্বিতীয় গোলের ছক মেনে এসেছে। সেবারও হালান্ড বল পেয়েছিলেন এদেরসনের কাছ থেকে, সেখান থেকে সেবার সিটি ফরোয়ার্ড নিজেই দারুণ এক লবে গোলটা করেছিলেন।
সিটির এমন ‘ডিরেক্ট ফুটবল’ হঠাৎ দেখে থাকলে উদ্ভট ঠেকতে পারে আপনার কাছে। তবে পিএসজির বিপক্ষে দলের গেল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচটা দেখে থাকলে অবশ্য আপনার তা মনে নাও হতে পারে। সে ম্যাচে প্রথমার্ধে সিটি ধুঁকেছে। কোচ লুইস এনরিকের দল সিটির বিপক্ষে রক্ষণ সামলেছে ‘ম্যান মার্কিংয়ের’ কৌশলে, আর বল পায়ে নিজেরা খেলেছে পাসিং ফুটবল। সেদিন পিএসজির রক্ষণও ছিল বেশ উঁচুতে। সব মিলিয়ে সিটির বল ধরে রাখার কৌশল হালে পানি পাচ্ছিল না দেখে কোচ পেপ গার্দিওলা দ্বারস্থ হয়েছিলেন তার চোখে অবহেলিত কৌশল ‘লং বলের’ কাছে– চার ফিল্ডার ছিলেন মধ্য রেখার কাছাকাছি, এদেরসনের কাছ থেকে বল আসছিল মুহুর্মুহু, সে কৌশলই সে রাতে পার্ক দেস প্রিন্সে দলটাকে এনে দিয়েছিল দ্বিতীয় গোলটা।
সিটির বিপক্ষে পিএসজি আর চেলসির খেলায় একটা বিষয় দেখা গেছে, তারা প্রচুর প্রেস করেছে, উঁচুতে রক্ষণ রেখে সিটিকে তাদের খেলাটা খেলতে দেয়নি। যার ফলে সিটিকে বেছে নিতে হয়েছে এই ‘অপ্রথাগত’ কৌশল। তবে ম্যাচ শেষে সিটি কোচ স্বীকার করেছেন, প্রতিপক্ষ যদি রক্ষণাত্মক খেলে, তাহলে তার দলটা আবারও পুরোনো কৌশলেই ফিরে যাবে, যেখানে আপনি তাদের দেখবেন বাড়তি পাস খেলতে, খেলাটা ধীরগতির করে দিয়ে প্রতিপক্ষকে খানিকটা ওপরে উঠতে প্রলুব্ধ করতে।
সিটির চলতি মৌসুমটা ভালো কাটছে না আদৌ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোয় সরাসরি খেলা তো দূর, প্লে অফে খেলার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। প্রিমিয়ার লিগে দলটা আছে তালিকার চারে, চেলসির বিপক্ষে ম্যাচের আগেও দলটা ছিল সেরা পাঁচের বাইরে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে তো রীতিমতো জিততেই ভুলে গিয়েছিল দলটা। ফর্মটা এতটাই খারাপ ছিল যে পেপ গার্দিওলা তার কোচিং ক্যারিয়ারের ১৫ বছরে এমন কিছুর মুখে পড়েননি আর কখনোই।
পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচটা জেতা হয়নি। চেলসির বিপক্ষে হয়েছে। তবে দুই ম্যাচে দলের পারফর্ম্যান্স আবারও সিটিজেনদের লড়াইয়ে ফেরার মতো প্রেরণা দিয়েছে। সেটা যে কৌশলে ভর করে এসেছে, তা মোটেও ‘পেপ গার্দিওলা-সুলভ’ নয়। তার দলকে আপনি এর আগে নিয়মিত লং বলে খেলতে দেখেননি। বল পায়ে তার দল যা করলে তার ভালো লাগত, তা এখন বিবমিষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তার চোখের বালি ছিল, তাই হয়ে গেছে প্রিয় কৌশল। দুঃসময় মানুষকে কত কিছুই না করতে বাধ্য করে!