এবারের বিশ্বকাপটা সত্যিই স্পেশাল। শুধু স্পেশাল এ কারণে নয় যে, মার্কিনমুলুকে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ হচ্ছে। একই সাথে পাঁচটি মহাদেশের দল কিন্তু এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে।
অন্য যেকোনো বারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ২০টি দল এ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে। যেটা আসলে আগে আমরা দেখিনি কখনো। আসলে বিশ্বকাপের মূল মন্ত্রই হওয়া উচিত সবাইকে নিয়ে বিশ্বকাপ করা। আগে আমরা দেখেছি যে ৮-১০টা দল নিয়ে বিশ্বকাপ হতো।
যদিও বরাবরই বলা হচ্ছিল বিশ্বায়নের এই যুগে ক্রিকেট খেলাটাকে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করার কথা। বিভিন্ন মহাদেশে এবং আরও বেশি দল যাতে অংশ নিতে পারে তাহলে তাদের এই খেলার প্রতি আগ্রহটা বাড়বে। ঠিক তেমনই এবারের বিশ্বকাপটা যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট বিশ্বকাপ হচ্ছে এটা কিন্তু অকল্পনিয় অভাবনীয় ছিল একটা সময়। যদিও তিন চার মাসেও মনে হচ্ছিল না যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে এই টুর্নামেন্টটাকে আয়োজন করতে পারবে কিনা।
তবে সবাইকে চমকে দিয়ে আয়োজক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সবাইকে জানান দিল এটা বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে যাচ্ছে। আমেরিকার মতো পরাশক্তি, যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, ক্রিকেটটা অনেক সময় নিয়ে খেলা হয় বলে এই খেলাটি নিয়ে তারা খুব বেশি আগ্রহী নয়। বেসবল বা বাস্কেটবলের প্রতি তাদের যেই মোহ বা আগ্রহ সেটা নেই। তবে আমি নিশ্চিত যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে খুব ভালো খেলছেও তারা। কাজেই এই বিশ্বকাপটা খুবই স্পেশাল। স্পেশাল বিশ্বকাপ যেহেতু পারফরম্যান্সটাও স্পেশাল হওয়া চাই।
আমরা যেমনটি জানি যে, ২০টি দল অংশগ্রহণ করছে। যদি আমি অন্যান্য দলগুলোর কথা বলি, ইংল্যান্ড ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। তাছাড়া বরাবরই শক্তিশালী দল। তারা নিশ্চিতভাবেই চাইবে শিরোপা ধরে রাখতে। তাদের অধিনায়ক জস বাটলারও দুর্দান্ত ছন্দে রয়েছেন। কাজেই তাদের ওপর সেই চোখটা বরাবরই থাকবে।
যদি আমি অস্ট্রেলিয়ার কথা বলি, যারা আরেকটা বড় দল। যারা প্রতিবার বিশ্বকাপে পা রাখলেই খেলার ধরন পাল্টে যায় এবং বিশ্বকাপ মানেই অস্ট্রেলিয়া এমন প্রবাত রয়েছে কিন্তু; আর সেটা হয়েছে তাদের খেলার ধরন দেখে। কাজেই আরও একবার অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট নিঃসন্দেহে। তাদের দলের ট্রাভিস হেড ও ম্যাক্সওয়েলের কথা যদি বলি তারা দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। এছাড়াও পেস বোলিংয়ে মিচেল স্টার্ক, জস হ্যাজেলউড ও প্যাট কামিন্স তো রয়েছেনই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু এবারের বিশ্বকাপের আয়োজক ও দুইবারের চ্যাম্পিয়ন। নিজেদের দেশে খেলা এবং টি-টোয়েন্টি পাওয়ার ক্রিকেটের কথা যদি বলি ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম সবার আগেই আসবে। যতই তাদের পারফরম্যান্সে উত্থান পতন থাকুক নিজেদের দেশে বিশ্বকাপে অন্যতম সেরা দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ভারত আরেকটা টপ ফেভারিট টিম। দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে তারা। আইপিএল থেকে তাদের ক্রিকেটাররা সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছে। গতবার ওয়ানডে বিশ্বকাপে খুব কাছে থেকেও কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি ভারত। যেই কৃতিত্বটা অবশ্য দিতে হয় অস্ট্রেলিয়াকে। দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে তারা।
২০১৩ সালে সবশেষ কোনো আইসিসি ট্রফি জিতেছে ভারত। তারপর থেকে তাদের কোনো আইসিসি টাইটেল নেই। সেদিক থেকে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিরা নিশ্চয়ই চাইবে এবারের বিশ্বকাপ জিততে। সেই ট্রফি খরাটা কাটিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা নিজেদের করতে।
অন্য দলগুলোর মধ্যে যদি শেষ চারের কথা বলি তবে পাকিস্তান অবশ্যই থাকবে। নিউজিল্যান্ডের কথা তো বলতেই হবে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। নিঃসন্দেহে এই তিনটি দল কিন্তু সেমিফাইনালে দাবিদার থাকবে। তবে শুরুর চারটি দল বেশি শক্তিশালী বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এছাড়াও আফগানিস্তান সবাইকে চমকে দিতে পারে।
ছোট দলগুলোর কথা বলা হচ্ছিল। ২০টি দল অংশগ্রহণ করছে। সহযোগী দেশগুলো রয়েছে। সেক্ষেত্রে পাপুয়া নিউগিনির কথা যদি বলি, নামিবিয়ার কথা যদি বলি, উগান্ডার মতো একটা দেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে। নেদারল্যান্ডস রয়েছে।
নেপালের কথা যদি বলি, এই বিশ্বকাপে নেপালের দর্শক আমাকে আবার সেই বাংলাদেশের শুরুর দিকে যেই উন্মাদনাটা ছিল সেটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমরা নেপালের ম্যাচে দেখেছি হাজার হাজার দর্শক কিন্তু পুরো স্ট্যান্ডজুড়ে রয়েছে তাদের দলকে সাপোর্ট করার জন্য।
ক্রিকেটের বিশ্বায়নে এ দলগুলোর জন্য এটা খুবই ভালো একটা প্লাটফর্ম। আমি বিশ্বাস করি এই দলগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি দল তো বড় দলগুলোকে অবাক করতে পারে। যদি বড় দলগুলোকে হারিয়ে দেয় আমি অবাক হব না।
যদি বাংলাদেশের কথা বলি। তবে প্রথমে দীর্ঘ নি:শ্বাস নিতে হবে প্রথমেই। আইসিসি ইভেন্টে গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের পারফম্যান্স খুবই খারাপ। আশার কথা যদি বলি, এবারো আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে খুব বেশি আশা করতে পারছি না। আমরা ডি গ্রুপে রয়েছি, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা আছে এবং শ্রীলংকার সঙ্গে আমাদের প্রথম ম্যাচ। এছাড়াও নেদারল্যান্ডস ও নেপাল রয়েছে।
আমাদের কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলংকার মধ্যে একটি দলকে হারাতেই হবে। পাশাপাশি নেপাল ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি আমাদের অবশ্যই জিততে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের দলের বর্তমান যে পারফরম্যান্স। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজ হেরেছি। আমার কাছে যেটা মনে হয় এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক আমাদের ক্রিকেটের ইতিহাসে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারা। এটা আসলে বাংলাদেশকে অনেক বড় একটা ধাক্কা দেবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
তবে এই ধাক্কা সামলে কিভাবে বিশ্বকাপটা শুরু করতে পারে বাংলাদেশ সেটাই এখন দেখার। তবে ব্যাটিংয়ের কথা বলতেই হবে। কারণ ব্যাটিংটা নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি ভাবনার জায়গা। বিশেষ করে ওপেনিং ও টপ অর্ডারদের ব্যাটিং নিয়ে যদি বলি লিটন দাস, সৌম্য সরকার, তানজিদ তামিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত; তারা কেউই আসলে খুব একটা টাচে নেই। শুরুর দিকেই আমাদের বেশ কিছু উইকেট পড়ে যাওয়ার জন্যই কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ম্যাচ হেরে যাচ্ছি। আমাদের একটা বিরাট বড় দুর্বল দিক রয়েছে কিন্তু। যদি আমরা টিম কম্বিনেশনের কথা চিন্তা করি।
আমাদের শক্তির জায়গা নিয়ে যদি বলি তবে এটা টিক বোলিং ডিপার্টমেন্টটা কিছুটা হলেও আমাদের স্বস্তি দেই। যদিও চোট নিয়ে কিছুটা সমস্যা রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ দলে। শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের আগে আমাদের পেসার শরিফুল হাতে ব্যথা পেয়েছেন বোলিং করার সময় ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। এছাড়াও তাসকিন আহমেদ কিন্তু চোট সারিয়ে উঠছেন।
সবমিলিয়ে এই যে অবস্থা- মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ক্রিকেটাররা, দর্শকরা হতাশ এবং নানাভাবে ক্রিকেটারদের নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মাত্র উপায় হচ্ছে একজন আরেকজনকে মোটিভেট করা। সেক্ষেত্রে দলের দুই সিনিয়র ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রয়েছেন। তারা কিন্তু মোটিভেট করার কাজটি করতে পারেন যেহেতু নাজমুল শান্ত খুবই তরুণ ক্যাপটেন।
কাজেই তাকে দিকনির্দেশনা দেওয়ারও ব্যাপার থাকবে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল নিয়ে আমি আসলে খুব বেশি আশা করতে পারছি না। কিন্তু আমি আশা করব বাংলাদেশ এই সিচুয়েশন থেকে ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্বকাপের শুরুটা ভালো করবে যাতে আমরা পরের রাউন্ডে যেতে পারি; কিন্তু সেটা করতে বাংলাদেশকে খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে।
কাজেই আমার কাছে মনে হয় এবারের বিশ্বকাপটা অন্য যেকোনো আসরের চেয়ে একটু ভিন্ন থাকবে। ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বায়নের কথা যদি বলি। ওভারঅল এবারের আসরটা অনেকের কাছেই মনে থাকার মতো হবে বলেই আমি আশা করি।