মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন যে পাকিস্তানি
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৪৫ পিএম
![মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন যে পাকিস্তানি](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/12/17/image-498957-1639723504.jpg)
স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যা, ধর্ষণের বিভীষিকাময় সেই ৯ মাসের করুণ কাহিনি অবর্ণনীয়-অকল্পনীয়।
আর ইয়াহইয়া,ভুট্টো বাহিনীদের হারিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় ইতিহাসে বাংলাদেশের হয়ে নাম লেখিয়েছিলেন এক পাকিস্তানি।
তার নাম আবদুল গফুর বালুচ। পাকিস্তানি হয়েও এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালিদের হয়ে হানাদার বাহিনীর বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষেই ছিল তার অবস্থান। পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার ছিলেন গফুর বালুচ। সেই সময় ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ক্লাবটির শুরু থেকেই কোচ ছিলেন তিনি।
দেশের ফুটবলানুরাগীরা তাকে বেশি চিনেছেন ‘ব্রাদার্সের গফুর বালুচ’হিসেবে।
ঢাকার রাজধানী গোপীবাগে থাকতেন তিনি। গোপীবাগ বাসিন্দাদের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আবেগ ও ভালোবাসা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজধানী ঢাকার আর সব এলাকার মতো অশান্ত হয়ে ওঠে গোপীবাগ এলাকাও।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় গন্তব্যহীন মানুষের কাছে ছুটে যান দিগ্বদিক।
তবে ভিটেমাটির মায়ায় যারা গোপীবাগ ছেড়ে যাননি, হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় ভুগছিলেন তারা।
একদিন গোপীবাগের বাসিন্দাদের ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নেয় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এই গফুর বালুচ। রক্ষা করলেন গোপীবাসীকে।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় করাচিতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল আবদুল গফুরের। কিন্তু তিনি গেলেন না। বাংলাদেশের মাটির টানে রয়ে গেলেন। পরোক্ষভাবে কাজ করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষেই।
থাকতেন গোপীবাগের ভূত বাংলায় (বর্তমানে আনসার ক্যাম্প)।
যুদ্ধকালীন গোপীবাগের অনেক মানুষকে পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন আবদুল গফুর। পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় পরিচয়টাই পাকিস্তান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন গোপীবাগবাসীকে বাঁচানোর জন্য। সফলও হন।
ব্রাদার্স দলের সাবেক অধিনায়ক ও গোপীবাগেরই সন্তান শহীদউদ্দিন আহমেদ (সেলিম) বলেন, ‘সাদেক হোসেন খোকা ভাইয়ের মুখ থেকে অনেকবার শুনেছি— মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল গফুর তাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ওস্তাদের বাসাতেই রাখা হতো। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করতেন।’
এক পাক আর্মি অফিসার নাকি আবদুল গফুরকে সন্দেহ করত।
১৯৭৩ সালে শহীদউদ্দিনকে গফুর বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে ওই আর্মি খেলত। আমাকে অনুসরণ করত সে। প্রায়ই আমার রুমে ঢুকে উঁকি দিত,কিন্তু কখনও কঠোরভাবে চেক করত না। একদিন আমার কাছে এসে বলেছিল সেই আর্মি— আমি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছি।’
ঢাকায় অনুষ্ঠিত আগা খান গোল্ডকাপ খেলতে ১৯৫৮ সালে প্রথম ‘বাংলায়’ পা রাখেন পাকিস্তান জাতীয় দলের এ ফুটবলার।
এর পর থেকেই আস্তে আস্তে বাংলাদেশিদের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে এ দেশের প্রতি টান অনুভব করেন। নিজেকে গোপীবাগের বাসিন্দা হিসেবেই পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন পাকিস্তানের বালুচ সম্প্রদায়ের এই মানুষটি।
কোচিং ক্যারিয়ারে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯, যুব ফুটবল, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ও কায়েদে আজম ট্রফিতে জাতীয় দলের কোচ ছিলেন আবদুল গফুর।
১৯৮২ সালে ব্রাদার্সের দায়িত্ব ছাড়ার পর ১৯৮৪-৮৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোচ ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ব্রাদার্সের কোচ হয়েই কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের কোচ ছিলেন গফুর। পরের বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ট্রফিতেও বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব ছিল তার হাতে।
বিয়ে করেননি গফুর। ১৯৯৭ সালের ২৫ জুন এই বাংলার মাটিতেই মৃত্যুবরণ করেন আবদুল গফুর বালুচ।
করাচির সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন আবদুল গফুর। কিন্তু স্বীকৃতি সেভাবে পাননি।
এ বিষয়ে ব্রাদার্স দলের সাবেক অধিনায়ক হাসানুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘ওস্তাদের (গফুর বালুচ) জন্য আমাদের রক্তক্ষরণ হয়। তিনি ব্রাদার্স, গোপীবাগ ও বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন, তার স্বীকৃতি সেভাবে পাননি। ব্রাদার্স ক্লাবে গফুর ওস্তাদের মূর্তি থাকা উচিত ছিল। আমাদের প্রজন্মের পর আর কেউ জানবে না ওস্তাদের ইতিহাস। তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’