নাবিব নেওয়াজ জীবন। ফাইল ছবি
একটা সময়ে দেশে ফুটবলেরই জোয়ার ছিল। সেটা এখন সুদূর অতীত। ফুটবলের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করছে ক্রিকেট। বেড়েছে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা। বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
অন্যদিকে ফুটবল দিন দিন অতল গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটাররা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং বোর্ড থেকে মাসিক সম্মানি পান তার কোনো বালাই নেই ফুটবলে। তারপরও ফুটবল খেলেই সন্তুষ্ট নাবিব নেওয়াজ জীবন।
জাতীয় দলের এ তারকা ফুটবলার শনিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের ফুটবল হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল। যুগান্তর: কেমন আছেন, কোথায় আছেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ঢাকায় আবাহনী ক্লাবে হোমকোয়ারেন্টাইনেই ছিলাম। এখন গ্রামে চলে এসেছি। তার কারণ খেলা থাকায় সেভাবে পরিবারকে সময় দেয়া হয় না। ছুটি পাওয়ায় গ্রামে এসে পরিবারকে সময় দিতে পারছি ভালো লাগছে।
যুগান্তর: আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প শোনাবেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল। ফাইভ-সিক্সে পড়া অবস্থা থেকেই ফুটবল খেলি। আমার দাদা (আফতাব হোসেন মণ্ডল) জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পূর্বে ইস্টবেঙ্গল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। আমি যখন ছোট তখন দাদা মারা যান। উনি জীবত থাকলে ওনার গল্প শুনতে পারতাম। আমার বাবা (কাদের নেওয়াজ শাহী) তিনিও ফুটবলার ছিলেন। জেলায় পর্যায়ে খেলেছেন। আমার চাচা (শাহিনুল কবির শিমুল) জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন। বলতে পারেন পারিবারিকভাবেই ফুটবলের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল।
যুগান্তর: ক্রিকেট, হকি বা অন্যসব ইভেন্ট রেখে ফুটবল কেন বেছেনিলেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আমি যদিও ব্রাজিলের সমর্থক, তবে রোনালদিনহোর ছবি ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখতাম। অন্যসব ইভেন্টের থেকে ফুটবল বেশি ভালোবাসতাম। পারিবারিকভাবেও ফুটবলের প্রতি প্রেম ছিল। সবাই বলত তোমার দাবা, বাবা ও চাচারা ভালো মানের ফুটবলার ছিলেন তুমিও ফুটবলার হও। যুগান্তর: কিভাবে পেশাদার ফুটবলার হয়ে উঠলেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: ২০০৫ সালে আমার বয়স ১৪ কি ১৫ ছিল। তখন অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলের হয়ে খেলতে জেলা শহরে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাদ পড়ে যাই। সেই সময় গাইবান্ধার একটি হাইস্কুলের শারীরিক শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন নুর আলম সরকার। তিনি আমাকে গাইবান্ধায় যেতে বলেন। যাওয়ার পর খেলার সুযোগ পাই। সেই বছরই আমি জেলা চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলতে ঢাকায় এসেছিলাম।
ঢাকায় এসে তিন ম্যাচ খেলে দুটি গোল করার পর বাফুফের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ডাক পাই। সিঙ্গাপুর-ভিয়েতনাম সফরের আগে তিন মাস প্রাকটিস করেও বাদ পড়ে যাই। ২০০৬ সালে নোয়াখালী দলের হয়ে আমি পাইওনিয়ারে খেলি, ১২ ম্যাচে ১৩টি গোল করে টুর্নামেন্টে সেরা হই। তবে আমরা ফাইনালে গিয়ে হেরে যাই।
এরপর ২০১০ সালে চট্টগ্রাম মোহামেডান ক্লাবে খেলার পর ঢাকার এক বড় ভাই বারিধারা ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে (বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে) খেলার সুযোগ করে দেন। ২০১২ সালে ১১ ম্যাচে ১৩টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলাম। সেই বছর বারিধারা প্রিমিয়ার লিগে উঠে যায়। এরপর আমি বিজেএমসিতে চলে যাওয়ায় প্রমোশন বাইন্ডিং হওয়াতে ওই বছর খেলতে পারিনি। তবে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা দেয়ার পর খেলার সুযোগ পাই, দুই বছর বিজেএমসিতে খেলেছিলাম। এরপর ২০১৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম কিরগিজস্তানের বিপক্ষে তাদের মাঠে খেলার সুযোগ পাই।
যুগান্তর: কখন মনে হয়েছিল ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেয়া যায়?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: গ্রামের মাঠে ভালো খেলার পর নিজের মধ্যে গোল করার নেশা চলে আসে। তারপর মনে হয়েছে ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিলে খারাপ হয় না।
যুগান্তর: ফুটবলার হিসেবে কাকে ফলো করেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আমি আসলে কাউকে ফলো করি না। ফলো করে তো তাদের মতো হতে পারব না। পছন্দ করি, মেসি-রোনালদোকে। এছাড়া যারা ভালো স্ট্রাইকার তাদের পছন্দ করি। তাদের খেলা দেখি।
যুগান্তর: ফুটবলার না হলে পেশা হিসেবে কী বেছে নিতেন?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আসলে এভাবে কখনও চিন্তা করিনি। হয়তো কোনো ব্যবসা করতাম। গ্রামেই থেকে যেতাম।যুগান্তর: ফুটবল ছাড়া অন্য কোন খেলা ভালো লাগে?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: টেনিস খেলা পছন্দ করি। নিজে খেলতে পছন্দ করি রেকেট। এ ছাড়া ক্যারাম খেলতেও ভালো লাগে।
যুগান্তর: ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: গতবার এএফসি কাপে আমরা আবাহনীর হয়ে ভারতের গুয়াহাটিতে স্বাগতিক ভারতকে হারিয়েছিলাম। এর আগে এএফসি কাপে বাংলাদেশ কখনও কোয়ালিফাই করতে পারেনি। সেই ম্যাচটির অনুভূতি অন্যরকম ছিল, বলে বোঝাতে পারব না।
যুগান্তর: ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত কোনটি?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আমি যখন জাতীয় দলের হয়ে গোল করতে না পারি তখন বেশি খারাপ লাগে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছি।
যুগান্তর: ক্লাব ফুটবলে আপনি তো সফল, জাতীয় দলে সাফল্য না পাওয়ার কারণ কি?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: আসলে এটা কেন হয় জানি না। আমার ভাগ্যের কারণে নিশ্চিত হওয়া গোলও হয়নি। কেন হয়নি আমি ঠিক বলতে পারব না। যুগান্তর: অবসর সময়ে কি করতে ভালো লাগে?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: পরিবারকে সময় দেয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, এ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে বাইরে খাবার খেতে ভালো লাগে।
যুগান্তর: ছুটি কাটানোর প্রিয় জায়গা কোনটি?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: গ্রামে গেলে ভালো আগে। আমার গ্রামই আমার কাছে সেরা জায়গা। কারণ গ্রামে সকালে বাসা থেকে বের হলেই পরিচিত মুখগুলো দেখা যায়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে।
যুগান্তর: জাতীয় দলের ফুটবলারদের মাসিক কোনো পারিশ্রমিক নেই, নেই ভালো মানের কোনো সুযোগ সুবিধাও। এ সব ভাবলে কখনও আফসোস হয়?
নাবিব নেওয়াজ জীবন: ভাই ফুটবল আমার রক্তে মিশেগেছে। টাকা-পয়সা নিয়ে আমি কখনই চিন্তা করি না। বড় কোনো চাওয়াও নেই। ফুটবল খেলে যা পেয়েছি তাতেই খুশি। তবে থাকলেতো অবশ্যই ভালো হতো, আরও ভালো খেলার অনুপ্রেরণ পেতাম।
নাবিব নেওয়াজ জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
নাম: নাবিব নেওয়াজ জীবন।
জন্ম: গাংনগর, শিবগঞ্জ, বগুড়া।
বাবার নাম: কাদের নেওয়াজ শাহী।
মায়ের নাম: রশিদা বেগম।
কয় ভাই বোন: দুই ভাই ও এক বোন। বড় ভাই ঢাকায় চাকরি করেন। বোন বিবাহিত।
পড়াশোন: এইচএসসি পাস।
পেশাদার ফুটবল ক্লাব: প্রিমিয়ারে বিজেএমসি (২০১২-১৩), (আবাহনী-২০১৫-বর্তমান)।
মোট গোল: জাতীয় দলে ২৫-২৬টি ম্যাচে চার গোল, ক্লাব ফুটবলে বিজেএমসিতে ৮টি আর আবাহনীতে চার মৌসুমে ৩৭ গোল।
প্রিয়-অপ্রিয়
প্রিয় খাবার: মায়ের হাতের যে কোনো রান্না করা খাবার।
প্রিয় গান: জেমসের গাওয়া সেই গানটি-তুমি মিশ্রিত লগ্ন মাধুরির জলে ভেজা ...।
প্রিয় ফুল: অবশ্যই গোলাপ।
প্রিয় রং: লাল-কালো-সাদা।