খ্যাতনামা কবি, সংগীত রচয়িতা, নাট্যকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর ১৯১৮ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন খুলনা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেমী। তিনি পেশায় কৃষক ও ব্যবসায়ী ছিলেন।
সিকান্দার আবু জাফর স্থানীয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর কলকাতার রিপন কলেজে পড়েন। ১৯৪১ সালে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগ দেন। এছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাতেও কাজ করেছেন। তার রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’। এটি পরে জনপ্রিয় গণসংগীতে রূপান্তরিত হয়। দেশবিভাগের পর সিকান্দার আবু জাফর ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকে রেডিও পাকিস্তানের শিল্পী হিসাবে কাজ করেন। সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ সম্পাদনার জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
বস্তুত একজন সাহিত্যিক হিসাবে সিকান্দার আবু জাফরের যে খ্যাতি, তার চেয়েও অনেক বেশি খ্যাতি লাভ করেন সমকালের সম্পাদক হিসাবে। সমকাল পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনা তার জীবনের একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। সমকালের প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে পূর্ববঙ্গের সাহিত্য আন্দোলনে তিনি নতুন গতির সঞ্চার করেছিলেন। এ পত্রিকায় ষাটের দশকের নামি-দামি সব কবি-লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়েছে। লেখার সাবধানী ও নৈর্ব্যক্তিক নির্বাচন, প্রতিভাবান নতুন লেখকদের মর্যাদা প্রদান, মনোযোগী সম্পাদনা এবং মুদ্রণ পরিপাট্যের জন্য সমকাল সব কবি-লেখকের জন্য স্বপ্নের পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। একইসঙ্গে এটি প্রগতিশীল বাংলা সাহিত্যধারার অগ্রগামী সাহিত্যপত্রে পরিণত হয়েছিল। তার নিজরেও প্রচুর লেখা এ পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ‘বাংলা ছাড়’ কবিতাটি : ‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলো / আজকে যখন হাতের মুঠোয় কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি / কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাপি / আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি / তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া / তুমি বাংলা ছাড়ো।’
সিকান্দার আবু জাফরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো-‘প্রসন্ন প্রহর’, ‘বৈরী বৃষ্টিতে’, ‘বৃশ্চিক লগ্ন’, ‘বাংলা ছাড়’ ইত্যাদি। তার রচিত কয়েকটি নাটকের নাম-‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মহাকবি আলাওল’, ‘শকুন্ত উপাখ্যান’, ‘মাকড়সা’। তার লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘মাটি আর অশ্রু’, ‘পূরবী’, ‘নতুন সকাল’ ও ‘জয়ের পথ’। কিশোর উপন্যাস-‘জয়ের পথে’, ‘নবী কাহিনী’। অনুবাদ-‘রুবাইয়াৎ ওমর খৈয়াম’, ‘সেন্ট লুইয়ের সেতু’, ‘বারনাড মালামুডের যাদুর কলস’।
সিকানদার আবু জাফর ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।