খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় বিভাগের পরিদর্শক। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী বাংলার অনেক এলাকায় ঘুরে ফিরেছেন। তার শিক্ষার হাতেখড়ি মক্তবে, তারপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে যান নড়াইলে। চিত্রা পাড়ের এ শহরে কাটে তার তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপ গিয়ে ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুল ও পরে কারগিল হাই স্কুলে। এরপর নোয়াখালী জেলা সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে তার স্থান বদল হয় ফেনীতে। ভর্তি হন ফেনী হাই স্কুলে, সেখান থেকে যান ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ গিয়ে ১৯৪৯ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। স্কুলজীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে। তিনি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ করেছেন। সিগনেটের বই কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য ছিল এক অনুপম নির্দশন। সাময়িক পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী ‘ছায়াছবি’ নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। সুযোগমতো টুকটাক প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এ কাজের সূত্রেই পরিচয় হয় সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে তার দুই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায় সেই বই আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রচ্ছদে একটি পরিবর্তন ঘটান ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত জহুরুল হকের ‘সাত-সাঁতার’ গ্রন্থে। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ তার অঙ্কন, টাইপোগ্রাফিবোধ ও রসসিঞ্চিত তির্যক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। ১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
তেলরঙ, জলরঙ, কালি-কলম, মোমরং, রেশমছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। বস্তুত তার ছবি নকশাপ্রধান। বর্ণিল পটভূমিতে মোটাদাগের নকশা তার প্রধান অঙ্কনশৈলী। লাল, নীল, সবুজ এই তিনটি রং তিনি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতেন। এই বর্ণভঙ্গি তার চিত্ররীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার ক্যানভাসের আয়তন প্রায়ই বর্গাকার। এছাড়া তার চিত্রাবলিতে এদেশের লোকশিল্পসুলভ পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতলপাটি, কাঁথা ইত্যাদির পৌনঃপুনিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কার লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৮৬ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালে শহিদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হন। ওই বছরেরই ৩০ নভেম্বর কাইয়ুম চৌধুরী বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ক্ল্যাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভালের চতুর্থ দিনে বক্তব্য দেওয়ার সময় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাকে সিএমএইচে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।