ফতেহ লোহানী একাধারে ছিলেন অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, অনুবাদক ও সাংবাদিক। তিনি আবৃত্তিকার হিসাবেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি ৪৪টি চলচ্চিত্রে ও অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি ১৯২৩ সালের ১১ মার্চ সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবু লোহানী ছিলেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। মা ফাতেমা লোহানী কলকাতা করপোরেশন স্কুলের শিক্ষিকা ও লেখিকা ছিলেন।
মাত্র আট বছর বয়সে ফতেহ লোহানীর পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর মায়ের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। ফতেহ লোহানী কলকাতার সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল মিশন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, রিপন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। এরপরে ১৯৫০-এ তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং ওল্ডভিক থিয়েটার স্কুলে নাট্য প্রযোজনা বিষয়ে দুবছরের কোর্স সম্পন্ন করেন। সে সময় ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্য হিসাবে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়েও অধ্যয়ন করেন।
কিশোর বয়সেই কলকাতায় মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রা দেখে মুগ্ধ হয়ে অভিনয়ের প্রতি অনুরাগী হন তিনি। কলকাতার স্কুলে অধ্যয়নকালে প্রথম অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি কৌতুকাভিনয় ও আবৃত্তি করতেন। রিপন কলেজে পড়ার সময় তিনি বেশকিছু বাংলা ও ইংরেজি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। কলেজে অভিনীত তার প্রথম নাটক বনফুল রচিত ‘শ্রী মধুসূদন’। এ নাটকে তিনি মধুসূদনের চরিত্রে অভিনয় করেন। পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী আলোক তীর্থের উদ্যোগে রঙমহলে মঞ্চস্থ হেমেন রায়ের নর-নারী নাটকে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রকার বিমল রায় তাকে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘হামরাহী’র (১৯৪৫) একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। এ চলচ্চিত্রে তিনি কিরণ কুমার নামে অভিনয় করেন। একই বছর তিনি উদয়ন চৌধুরীর (ইসমাইল মোহাম্মদ) রচনায় ও পরিচালনায় ‘জোয়ার’ টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪৬ সালে হিমাদ্রি চৌধুরীর (ওবায়েদ-উল হক) রচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ চলচ্চিত্রে প্রতিনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতায় অখিল নিয়োগী পরিচালিত ‘মুক্তির বন্ধন’ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
দেশবিভাগের পরে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। ওই বছরই তিনি ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ শুরু করেন। পাশাপাশি পরিচালনা করেন ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্র। এটি ছিল তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তার নির্মিত ‘আসিয়া’ ১৯৬০ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক নিগার পুরস্কার লাভ করে।
ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসাবে ফতেহ লোহানীর অভিষেক ঘটে ১৯৬৪ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘রাজা এলো শহরে’র মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রে তিনি খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং এর মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। একই বছর বেবি ইসলাম পরিচালিত তানহা উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে তার পরিচালিত প্রথম উর্দু চলচ্চিত্র ‘সাত রং’ মুক্তি পায়। ১৯৬৬ সালে জহির রায়হান ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে ফতেহ লোহানী চাঁদ সওদাগরের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
দেশবিভাগের আগে কলকাতায় ফতেহ লোহানী সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। সাহিত্য শাখায় তিনি একজন গল্পকার ও অনুবাদক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। ফতেহ লোহানি ১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।