আজকাল টিভিতে চোখ রাখলে বা পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত অসংখ্য উদ্বেগজনক সংবাদ এবং প্রতিবেদন। প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, পুঁজিবাদী দেশগুলোর অধিক মুনাফার পেছনে ছোটা, জাতিতে জাতিতে সংঘাত এবং যুদ্ধ, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে পরমাণু ও রাসায়নিক অস্ত্রসহ অন্যান্য বহুবিধ অস্ত্রের পরীক্ষা ইত্যাদি কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডল এবং জলাশয়ের পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামহীন আহরণ ইতোমধ্যে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যেখানে ২০০০ মিলিয়ন হেক্টর জমির উর্বরতার স্তর নষ্ট হয়ে গেছে।
পৃথিবীর বনাঞ্চলের দুই তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং শত শত প্রজাতির পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিল্প কারখানার বর্জ্যরে ব্যবহার এখন একটি কঠিন সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, পৃথিবীর সব নগরি প্রতি বছর প্রায় ৩০০০ মিলিয়ন টন শিল্পজাত এবং গৃহজাত কঠিন বর্জ্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এ বিপুল বর্জ্যরে বোঝা বহন করতে গিয়ে পৃথিবীর অবস্থা হয়েছে অনেকটা কুঁজো হয়ে যাওয়া বুড়োর মতো।
যতই দিন যাচ্ছে, অবস্থা ততই গুরুতর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাসায়নিক শিল্পের দ্রুত বিকাশের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিকর গ্যাস এবং দ্রব্যাদি পরিবেশে উদ্গীরিত হচ্ছে, যার ফলে প্রাকৃতিক বৃত্তের আপন নিয়ন্ত্রণ দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, মানুষের লাগামহীন ক্রিয়াকলাপ ও অন্যান্য কিছু প্রাকৃতিক কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস হলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন, ওজোন ইত্যাদি। গ্রিনহাউজ গ্যাস বেড়ে যাওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে ছেড়ে দেওয়া তাপ শোষণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্রে পানির উচ্চতাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর ফলে বাংলাদেশের মতো নিচু বদ্বীপ অঞ্চলসহ মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের অনেক এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এছাড়া গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার জন্য বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভাঙন, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে ‘জলবায়ুর পরিবর্তন’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যে দুটি সমস্যা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, সে সমস্যাগুলো হলো-
১. মরুকরণ প্রক্রিয়া।
২. পানীয় জলের অভাব।
মরুকরণ প্রক্রিয়া : কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘চাষাবাদ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অগ্রসর হয় এবং সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয় পেছনে রেখে যায় মরুপ্রান্তর’। এক সময় সুজলা, সুফলা ছিল এরকম বিশাল এলাকাকে গিলে খেয়েছে মরুভূমি। মরুভূমির এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বহু শতাব্দী ধরে মানুষ জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করে দিচ্ছে। জমির উর্বরতা নষ্ট করে ফেলছে। এর সঙ্গে রয়েছে অনাবৃষ্টি বা খরা। নদীতে বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রেখে একদিকে সেচের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর ফলে অন্যদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভাটি এলাকা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ভারত কর্তৃক নির্মিত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা এবং তিস্তা নদীতে নির্মিত তিস্তা বাঁধ। গঙ্গা চুক্তির ফলে পদ্মায় পানি প্রবাহ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আর তিস্তা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া চলছে এশিয়া এবং আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।
পানীয় জলের অভাব : পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়– পরিবর্তনের ফলে স্বচ্ছ পানির অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। শিল্প কারখানা ও কৃষিকাজের জন্য স্বচ্ছ পানির ব্যবহার আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। গৃহস্থালি কাজেও এর ব্যবহার দ্রুত বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়ণ। বর্তমানে অনেক দেশে পানীয় জলের ভারসাম্য প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন। এর প্রধান দুটি কারণ হলো, পানি সম্পদের অসম বণ্টন এবং দূষণ।
স্থলভাগের মিঠাপানির পাশাপাশি মারাত্মক দূষণ চলছে সমুদ্রের পানিতেও। পৃথিবীতে বসবাসকারী বহু জনগোষ্ঠীর জীবন সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। মাছ ধরা এবং বাণিজ্য জাহাজ চালনা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাচীন শাখা, যা সুদীর্ঘকাল থেকে সমুদ্রকে মানবজাতির সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে।
শুধু মৎস্য সম্পদ নয়, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, ফসফরাইট, সালফার, ননফেরাস ধাতু এবং হীরেসমেত প্রধান প্রধান খনিজ সম্পদে সমুদ্র সমৃদ্ধ। অথচ মানবজাতি সমুদ্রকে একটি বৈশ্বিক পরিশ্রুতকরণ ব্যবস্থা থেকে আবর্জনাবাহী একটি বৈশ্বিক পয়ঃনালিতে পরিবর্তিত করছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র পরিণত হচ্ছে বৈশ্বিক আস্তাকুঁড়ে। নদীতে নিঃসরিত বর্জ্যদ্রব্য দ্বারাও সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। বিশ্বের কতিপয় উন্নত দেশ সমুদ্রের গভীর স্তরে অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পুঁতে রাখছে। এক সময় এর পরিণতি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবয়বে হাজির হতে পারে।
সমুদ্র দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, জাহাজযোগে ক্রমবর্ধমান পেট্রোলিয়াম পরিবহণ। কারণ, ট্যাংকার ধোয়ার সময় বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম সাগরে প্রবেশ করে। এছাড়া ট্যাংকার এবং পাইপলাইনের দুর্ঘটনা জলের উপরিতলে প্রচুর ভাসমান তৈল স্তর সৃষ্টি করে, যা জীবন্ত প্রাণীর শরীরে বিষক্রিয়া ঘটায়।
উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাক বিপুল পরিমাণ তৈল সমুদ্রে নিক্ষেপ করে মারাত্মকভাবে পারস্য উপসাগরকে দূষিত করেছিল। বর্তমানে শুধু পেট্রোলিয়াম নয়, অসংখ্য বর্জ্য দ্বারা সমুদ্র দূষিত হয়ে চলেছে। সমুদ্রের গভীরে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সমুদ্র দূষণের ফলে তিমি, ডলফিন এবং বিভিন্ন ধরনের মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণীর সংখ্যা ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বড় দুঃসংবাদ!
গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, খুব শিগ্গির পৃথিবী একটি ‘নগরগ্রহে’ রুপান্ত?রিত হতে চলেছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ নগরগুলোতে বসবাস করছে। কিন্তু নগরে বাস করা কি এতই সুখকর যে, মানুষ গ্রামের শান্তশীতল পরিবেশ ছেড়ে ধেয়ে আসছে শহরের দিকে? সুখকর তো নয়ই, বরং নগরগুলোর এলোমেলো বেড়ে ওঠা, তাদের বিপুল জনসংখ্যাধিক্য, তাদের আবাসিক পরিবেশের বিপজ্জনক দূষণ, যানজট, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া ও চিৎকার এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে নগরীতে বাস করা অনেকের কাছে রীতিমতো নরকবাসের শামিল। তবু মানুষ ছুটছে শহরের দিকে। কেন? এর কারণ হলো রুটি-রুজির তাগিদ।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যাবে বিশাল বিশাল অট্টালিকার পাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝুপড়ি, যেখানে কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেননা, বৈষম্যপীড়িত সমাজে নগরগুলোর বিকাশ উৎপাদন এবং অনুৎপাদনমূলক উভয়বিধ কার্যকলাপের তীব্রতা সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলোর নগরায়ণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়, গাছপালা, খেলার মাঠ। উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে নানা ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ডেঙ্গি জ্বরের প্রকোপ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব। পরিবেশ দূষণ শুধু প্রাকৃতিক দূষণ নয়।
পরিবেশের ধারণা ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তবে সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং বৈশ্বিক পরিবেশ পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো দেশই কিন্তু মুক্ত নয়। সামাজিক, রাষ্ট্রিক, আন্তর্জাতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং দূষণ ব্যাপক প্রভাব ফেলছে আমাদের পারিবারিক পরিবেশের ওপর।
পরিবার থেকে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। ব্যক্তি পর্যায়ে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে নিঃসঙ্গতাবোধ, নিরাপত্তাহীনতা। প্রচণ্ড মানসিক চাপে বৃদ্ধি পাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যানসারের মতো অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। মাদকাসক্তি, ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাজুক মানসিক স্বাস্থ্যেরই পরিণতি।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পৃক্ততা তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশল পরিকল্পনা’ তৈরি করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্টের জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থার বিরুদ্ধে নিতে হবে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা। তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ।
তথ্যসূত্র : ১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন। ২. বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি
- মার্সি টেমাস
The Business Standard (12/11/2021)
লেখক : কবি ও গদ্য লেখক। পেশায় চিকিৎসক, প্রকল্প পরিচালক, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প, জামালপুর