Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

সুদের হার মুদ্রাবাজার ও মুদ্রাস্ফীতি

Icon

ফারুক মঈনউদ্দীন

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩১ পিএম

সুদের হার মুদ্রাবাজার ও মুদ্রাস্ফীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ব্যাংকিং খাত; তথা মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও সুদের হার। শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী নেতাদের চাপে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর অভিঘাত মোকাবিলা করার জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানতের ওপর সুদের হারও কমিয়ে ফেলতে হয়েছে। ফলে আমানতকারীরা, বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ শ্রেণিটির বিশেষ কোনো ক্ষমতা কিংবা শক্তিশালী কোনো সংগঠন নেই বলে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার কমানোর এ দাবি নতুন নয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান নিজেও একসময় সুদের হারের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর পেছনে লেগেছিলেন। সেসময় ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেও শেষাবধি সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ঋণ ও আমানতের সুদের হার নয়ছয় করার পর একসময় দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার নয় শতাংশ থেকে কমে আটের ঘরে নেমে গেছে এবং কাজটা বাজারই করেছে। এ প্রবণতায় আবারও প্রমাণিত হয় যে, সুদের হার নির্ধারণ করে বাজার।

আমাদের স্মরণে আছে, ১৯৯০-এর পরের বছরগুলোতে ব্যাংকগুলো যখন বিশাল তারল্য নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, তখনো ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদ না কমিয়ে বরং অপেক্ষাকৃত কম সুদে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলে তাদের বাড়তি তহবিল লগ্নি করছিল। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বহুভাবে উদ্বুদ্ধ করে সুদ কমিয়েও ঋণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। ঋণ বিস্তারের জন্য সুদের হার কমানোর দাবির পেছনে একটা অতিসরলীকৃত ধারণা কাজ করতে পারে যে, কেবল ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে দিলেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উদ্যমী হবেন। এ ধারণার পেছনের যে ভ্রান্তি সেটা হচ্ছে সুদকে বিনিয়োগের অন্যতম কিংবা একমাত্র সরাসরি নিয়ামক হিসাবে গণ্য করা।

সুদ আসলে কী? যে অর্থ ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়, তার মূল্যই তো সুদ। কেউ যখন তার মূলধন অন্যকে ধার দেয়, সে তার সেই মূলধনের বর্তমান ভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। এ ভোগবঞ্চনার মূল্য বা পুরস্কারই হচ্ছে সুদ। কেউ যদি তার মূলধন অন্য কাউকে ধার না দিয়ে নগদ ঘরে ফেলে রাখে, তবে সে তার মূল্য বা সুদ থেকে বঞ্চিত হয়। প্রকৃতপক্ষে অর্থ বা মূলধনকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে দিয়ে তার ওপর মূল্য বা সুদ অর্জন না করলে অলস তরল বা নগদ অর্থের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। অতএব ঋণ বিতরণ না করে ব্যাংকগুলোরও কোনো গতি নেই। তবে সে ঋণের সুদ কত হবে সেটি নির্ধারণ করাই মূল বিষয়।

প্রকৃতপক্ষে ঋণসুদের হার বিনিয়োগের অনেক নিয়ামকের একটিমাত্র। তবে একথাও বোধকরি বলা যায় যে, এমনকি ঋণসুদের হার যদি বিনিয়োগের একমাত্র নিয়ামকও হয়, তাহলেও এটাকে একটা নির্দিষ্ট হারের নিচে নামানো সম্ভব হয় না, কারণ তার সঙ্গে সম্পর্কিত তহবিল মূল্য (কস্ট অব ফান্ড) এবং তার সুযোগ ব্যয় (অপরচুনিটি কস্ট)। ঋণের ওপর সুদের হার যাই হোক, তা তহবিল মূল্যের সমান কিংবা তার চাইতে কম হতে পারে না।

ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মতে, সুদকে ভোগবঞ্চনার পুরস্কার হিসাবে ধরা হলেও, কেইনসের মতে, ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নগদ টাকা ঘরে রেখে দেওয়ার মনুষ্যপ্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করার জন্যই সুদ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, নগদ অর্থ ব্যবহারহীনভাবে ফেলে রাখলে সেটা দিয়ে কোনো প্রকৃত সম্পদ সৃষ্টি হয় না এবং অর্থনীতিতে রাখতে পারে না কোনো অবদান। সঞ্চিত অর্থের বিকল্প ব্যবহার, অর্থাৎ বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করা নিশ্চিত করা যায়, যদি বিকল্প বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চিত আয় সম্পর্কে পূর্বনিশ্চয়তা পরিমাপ করে দেওয়া যায়। এ ধারণা থেকেই কেইনস তার সুদের হার তত্ত্ব সৃষ্টি করেন।

কেইনসের মতে, নগদ অর্থ ধার তথা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখার পুরস্কার তথা সুদের হার নির্ভর করে দুই ধরনের অবস্থার ওপর: বাজারে আবর্তিত অর্থের পরিমাণের ওপর, যা নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ বাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ মানুষ কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতার ওপর। নগদ অর্থ ধরে রাখার বিষয়টি অবাস্তব মনে হলেও কেইনস মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতাকে উড়িয়ে দেননি। কারণ, নগদ টাকা ধরে রাখার বিকল্প যে দুটো পন্থা আছে, সেগুলো থেকে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা ও হাতছানি থাকলেও তার মধ্যে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং লোকসানের ঝুঁকি। নগদ টাকা হাতের কাছে রাখার নিরাপত্তাবোধ সম্পর্কে মানুষের এ মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নেওয়ার কেইনসীয় ধারণার পেছনে সম্ভবত এ কারণ ছিল যে, তখনকার যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা ততটা সংহত ছিল না, সুদৃঢ় ছিল না ব্যাংকগুলোর ভিত্তি, সুলভ ছিল না ব্যাংক পরিষেবা এবং ছিল না বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং সুবিধা। তবে আজকাল ব্যাংক পরিষেবা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে ফেলে রাখে না। ফলে যে কোনোভাবেই হোক মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। বর্তমানে এ ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, যাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়।

ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার কমানোর উদ্দেশ্য দুটো হতে পারে। একটি হচ্ছে তাত্ত্বিকভাবে সর্বজনস্বীকৃত নব্য ধ্রুপদী মুদ্রানীতির কৌশল, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় বাজারে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা করা হয়। এ কৌশলের মাধ্যমে ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে আগ্রহী ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণ সহজলভ্য করা হয়, যাতে তারা ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ হয়। তাত্ত্বিক ধারণা হচ্ছে, ঋণ পাওয়া সহজ এবং সুলভ হলে ব্যবসায়ীরা তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহী হবে; ফলে বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বাড়বে। এতে মন্দার বাজারে গতির সঞ্চার হবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ব্যবসায়িক, অর্থাৎ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কিংবা আগ্রহী উদ্যোক্তা যদি মনে করেন যে, চলতি হারে সুদ তাদের বিনিয়োগজাত আয়ের চেয়ে বেশি অথবা সমান, সে ক্ষেত্রে সুদ কমানোর একটা প্রচেষ্টা তারা করতে পারেন কিংবা কমানোর জন্য প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। সুদের হার যদি কমানো যায় এবং উদ্যোক্তার প্রত্যাশিত আয় যদি না কমে, তাহলে এতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। এজন্যই কেইনস সব সম্পদের পূর্ণনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য ঋণের সহজ প্রাপ্তি এবং নিম্ন সুদের হার সুপারিশ করেন।

আমাদের স্মরণে আছে, ২০০৬-০৭ সালে পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের আমদানি ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করে আগের দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মুক্ত সুদ নীতিতে আংশিক সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল, তবে এর পেছনে ব্যবসায়ী মহলের কোনো দাবি ছিল না। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবকে প্রতিরোধ করাই ছিল সরকারের মূল উদ্দেশ্য। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় বিনিয়োগহার সমুন্নত রাখার জন্য প্রায় সব শ্রেণির ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নির্দেশনা মোতাবেক ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করে, যেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটে ২০২১ সালে।

অর্থনৈতিক মন্দা উত্তরণে সুদের হার কমানোর যে মুদ্রানৈতিক কৌশল, তাতে ঋণের ওপর সুদকেই মূলত বোঝানো হয়, তবে সঞ্চয়ের ওপর সুদও এ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত থাকে; কারণ, ঋণের ওপর সুদের হার মূলত সঞ্চয়ের সুদের হারের ওপর নির্ভরশীল, যেহেতু সঞ্চয়ই ‘ঋণ’ নামের সেবা পণ্যের মূল কাঁচামাল। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সঞ্চয় থেকেই ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টি হয়।

সুদের হার হ্রাসের সবচাইতে বড় প্রতিক্রিয়াটি ঘটে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়স্পৃহার ওপর। আন্তর্জাতিক এমনকি আঞ্চলিক বাজারের তুলনায়ও আমাদের দেশে সুদের হার অপেক্ষাকৃত বেশি, সেটা সঞ্চয় এবং ঋণ উভয়ের ওপরই। ফলে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি বেশি সুদে ঋণ নিলেও সাধারণ সঞ্চয়কারীরা লাভবান হচ্ছিলেন। ঋণের ওপর সুদের হার কমানোর কারণে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হারও কমাতে হয়, ফলে ঋণ গ্রহণকারীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ সঞ্চয়কারীরা। অথচ এতদিন সুদের হার বেশি হলেও উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে পিছপা হননি; কারণ, তাদের প্রত্যাশিত আয় বা লাভ ছিল নিশ্চিত।

ব্যবসা এবং শিল্প পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সুদ ব্যয় অতি নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও কেবল সুদের হার হ্রাস করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি কিংবা পণ্যমূল্য হ্রাস করা যে সম্ভব নয়, সেটি যদি উপলব্ধি করা যায় তাহলে আয়কর, জ্বালানি মূল্য এবং আরও বহুবিধ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য খরচ কমানোর উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে, তা না হলে সুদের হার হ্রাসের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সফল হবে না। সুদের হার হ্রাসের পাশাপাশি আরও একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে অনুৎপাদনশীল, অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাস সামগ্রী আমদানি ও উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা। তার জন্য এ জাতীয় পণ্যের ওপর সুদের হার না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এতে সুদের হার হ্রাসের সদুদ্দেশ্য প্রমাণিত হবে, এসব পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি নিরুৎসাহিত হবে এবং সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের তথা সারা বিশ্বের বর্তমান সংকট মুদ্রাস্ফীতি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আমরা জানি, ঋণ সম্প্রসারণের ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটে; কারণ, বাজারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, যার কারণে চাহিদা বেড়ে যায়। আর চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত মূল্যস্তর। তবে ঋণ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবেই সেটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। মূলত অর্থনীতিতে সবকিছুই অনেক ধরনের উপাদান ও ব্যতিক্রমের ওপর নির্ভরশীল। ঋণ ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি ঘটে না। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে মানুষ অর্থ ধরে রাখে না, বিভিন্ন কারণে খরচ করে ফেলে, তাই অর্থের গতিশীলতা বাড়ে। অন্যদিকে মুদ্রাসংকোচনের সময় অর্থের গতি কমে যায়; কারণ মানুষ তখন খরচ না করে বরং সঞ্চয় করে।

সনাতনী ধারণামতে, অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ যদি স্বল্প পরিমাণ পণ্যের পেছনে ধাবিত হয়, তখন মূল্যস্তর বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কেইনস অবশ্য মুদ্রাস্ফীতিকে মুদ্রানৈতিক ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখেননি। তার সংজ্ঞামতে, দ্রব্য এবং সেবার কার্যকর মোট চাহিদা যখন তার সরবরাহের চাইতে বেড়ে যায়, তখন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। অর্থনীতিতে মোট চাহিদা বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার ওপর ভোক্তাদের মোট ব্যয়, মোট বিনিয়োগ ব্যয়, মোট সরকারি ব্যয় এবং নিট রপ্তানি আয় (আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে)- এসব কিছুর সমষ্টি। অতএব এ মতানুসারে একটি অর্থনীতিতে উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এ সময় অতিরিক্ত চাহিদার কারণে দ্রব্য ও সেবার সরবরাহের মূল্য যখন বেড়ে যায়, অর্থনীতির ভাষায় তাকে বলা হয় চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতি (ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশন)। আবার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি কিংবা সংগ্রহমূল্য বৃদ্ধির কারণে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, তাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি (কস্ট পুশ ইনফ্লেশন)।

শাস্ত্রীয়ভাবে বলতে গেলে মুদ্রানীতির মূল কর্মপরিধি হচ্ছে চাহিদা ব্যবস্থাপনা। এটি দিয়ে অর্থনীতির মোট চাহিদাকে প্রভাবিত করে তার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার চেষ্টা করা যায়। এটা সুস্পষ্ট যে, নগদ জমা কিংবা সংবিধিবদ্ধ তারল্য বাড়িয়ে দিলে বাজারে তারল্য ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে মুদ্রাবাজারে স্বল্পমেয়াদে সুদের হার বেড়ে যায় এবং বাড়তি তহবিল সংগ্রহের তাগিদের কারণে দীর্ঘমেয়াদে আমানতের ওপর সুদ এবং ফলশ্রুতিতে ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যায়। এতে বিনিয়োগ কমে যায়, আর তার কারণে অর্থনীতিতে মোট চাহিদা হ্রাস পায়। হ্রাসকৃত বিনিয়োগের জন্য মানুষের ভোগ কমে যায়, যা আবার প্রভাব ফেলে মোট চাহিদার ওপর। সুতরাং দেখা যায়, ঋণসংকোচন করে বিনিয়োগ, মানুষের আয় এবং ক্রয় ক্ষমতা কমানো যায়, যে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে একসময় অর্থনীতিতে দেখা দেয় মন্দাবস্থা, যা মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের মুদ্রাস্ফীতির দেখা দিয়েছে সেটা সীমিত কিছু ক্ষেত্রে চাহিদাজাত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত। যেমন-দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে গত বছরগুলোতে যে অবিশ্বাস্য মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে, সেটা পুরোপুরি চাহিদাজাত। এমনকি ভূসম্পদের এ মূল্যস্ফীতি বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়, তা মূলত খাদ্য এবং অন্যান্য কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভোক্তা মূল্যসূচকের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। এ মূল্য সূচকের মধ্যে খাদ্যমূল্য একটা প্রধান উপাদান। ভূসম্পদ খাতের মূল্যস্ফীতি যদি হিসাবের মধ্যে ধরা হতো, তাহলে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বহুগুণ বেশি দেখা যেত। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য কিংবা জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার সঙ্গে আমাদের দেশের মূল্যস্তরের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তার কারণে এমনকি দেশে খাদ্যের বাম্পার ফলন হলেও বাজারব্যবস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে খাদ্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত হারে কমে না। ফলে ব্যয়বৃদ্ধিজনিত এ মুদ্রাস্ফীতির একটা ক্রমপ্রবাহ আমাদের সাধারণ মানুষকে যেমন কাতর করে রাখে, তেমনি সরকারকেও ফেলে রাখে বিপাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, সেটি প্রায় পুরোপুরি ব্যয়বৃদ্ধিজনিত।

ওপরের আলোচনায় বোঝা গেল, ঋণ সৃষ্টির সঙ্গে বাড়তে থাকে অর্থের সরবরাহ। আর এ সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায় মানুষের বিনিয়োগ ও ভোগ এবং তার সঙ্গে চাহিদা। এক্ষণে উপলব্ধি করা গেল, অর্থ সরবরাহ হ্রাস করে মুদ্রাস্ফীতির রাশকে কিছুমাত্রায় হলেও টেনে রাখা যায়, তবে এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও হোঁচট খায়। মুদ্রাস্ফীতি রোধের এ কঠিন ভারসাম্য রক্ষাকারী কাজটি সব সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই পালন করতে হয়। সেটি করতে গিয়ে কোনো কোনো অতিরিক্ত ঋণপ্রসারী ব্যাংক কিংবা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের তারল্যের ওপর চাপ পড়তে পারে, হ্রাস পেতে পারে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান। অতএব মূল্যস্ফীতি রোধ করা যদি সরকারের অগ্রাধিকার হয়, তাহলে সেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও মুদ্রাসংকোচন নীতিটি দৃঢ়ভাবে প্রতিপালন করতে হবে, তাহলেই চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতির রোধ করা সম্ভব। আর ব্যয়বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বাগে আনতে হলে আমদানি কমাতে হবে, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাস সামগ্রীর। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিই হওয়া উচিত সরকারের একমাত্র অগ্রাধিকার।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম