Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

উন্নয়ন অধ্যয়ন আমার প্রাণের বিষয়

Icon

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:৪০ পিএম

উন্নয়ন অধ্যয়ন আমার প্রাণের বিষয়

দেখতে দেখতে বয়স তো কম হলো না। এ সময়ে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। নানা পরিচয়ে আমি পরিচিত হয়েছি। কখনো কখনো মনে হয় আমার মূল পরিচয় প্রায়ই ঢেকে যায় গভর্নর পরিচয়ের আড়ালে। আমার মূল পরিচয় আমি একজন শিক্ষক। যদিও আমি অনেক দেরিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে সরাসরি অধ্যাপক হিসাবে এক বৈরী সময়ে যোগ দিয়েছিলাম, তা সত্ত্বেও আমার গবেষণা জীবনটিও ছিল শিক্ষকসম। প্রচুর তরুণ গবেষক আমার সঙ্গে পিএইচডি ছাত্রের মতোই কাজ করেছে। তাদের অনেকেই এখন সফল গবেষক এবং শিক্ষক। আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টারস ও পিএইচডি শেষ করে বিআইডিএসেই ফিরে আসি। জাতীয় এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আমি কৃষি ও দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করলেও আমার চোখ ছিল ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিকেও। আর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লিখতাম নিয়মিত। ছাত্রজীবন থেকেই লিখতাম। পিএইচডি শেষ করে আরও বিষয়ভিত্তিক লেখালেখির দিকে মনোযোগী হই।

অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই বিআইডিএসে ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি গবেষণাটির নেতৃত্ব দিতে শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বাঙালির এ শ্রেষ্ঠ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণিবিন্যাস ও স্বপ্নের আদল খোঁজার উদ্যোগ নেই। এ গবেষণা পরিচালনার সময় আমি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ওপর জরিপ এবং গভীর আলাপচারিতায় যুক্ত হই। ইতিহাসও যে উন্নয়নের বড় উপকরণ হতে পারে এ অংশগ্রহণমূলক গবেষণার মাধ্যমে আমার অনুভবে তা গেঁথে যেতে থাকে। পাশাপাশি কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন, বর্গাচাষিদের জীবন-সংগ্রাম, নদীভাঙা মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ ক্ষমতার কাঠামোয় ‘টাউটদে’র দৌরাত্ম্য এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মতো দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করতে থাকি।

এসব গবেষণার ফল নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লেখাও চালিয়ে যাই এ আশায় যে, পাঠকদের মনের জানালায় অর্থনীতির এসব জটিল বিষয়ও সহজ করে স্পর্শ করা যায়। সেই সময়টায় ‘বাজেট সহজ পাঠ’ আন্দোলনের সূত্রপাত করি। প্রশিকার ইউপা নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ‘সমুন্নয়’ নামের আমার প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গরিবের বাজেট, প্রতিবন্ধীদের বাজেট, নারী ও শিশুর বাজেট এবং কৃষকের বাজেট নিয়ে নানামাত্রিক গণভিত্তিমূলক অংশগ্রহণমূলক গবেষণায় যুক্ত হই। পাশাপাশি পরিবেশ নিয়েও কাজ শুরু করি। তখনো জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি সেভাবে সামনে চলে আসেনি। প্রতিমাসে ‘পরিবেশ পত্র’ নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদনা করতাম। তরুণদের পরিবেশ আন্দোলনে উৎসাহ দেওয়ার বড় বাহন হয়ে উঠেছিল এ সাময়িকীটি। তা ছাড়া অন্যান্য পরিবেশবিষয়ক লেখকদের (যেমন দ্বীজেন শর্মা, আইনুন নিশাত, সলিমুল হক, ওয়াহিদুল হকসহ অনেকেই) সহযোগিতায় প্রতিবছর একটি বার্ষিক পরিবেশ প্রতিবেদন তৈরি করতাম। এসব গবেষণা ও প্রকাশনা করতে গিয়েই এ দেশের বরেণ্য লেখক, কবি এবং বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়।

ধীরে ধীরে আমার পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের আর্থ-সামাজিক লেখাগুলোর সঙ্গে। তার লেখা ‘সমবায়নীতি’, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, ও ‘আত্মশক্তি’ আমার মনোজগতকে গ্রাস করে ফেলে। তিনি পূর্ববাংলায় থেকেছেন। তাদের পারিবারিক জমিদারি এস্টেটগুলো পরিচালনার জন্য। সেই সুবাদে শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুরের গ্রামীণ সামজ, বিশেষ করে কৃষকদের সমস্যা ও সম্ভাবানা নিজের চোখে দেখতে পান। ‘পদ্মা’ নামের বোটে ভ্রমণ করতেন এবং অনেক রাতও যাপন করতেন। ভোরবেলায় নদীর বা বিলের ঘাটে গৃহিণীরা আসতেন বাসনকোসন পরিষ্কার এবং স্নান করার জন্য। তাদের দুঃখ ও আনন্দের টুকরো টুকরো কথা তার কানে আসত। সেসব কথাই তাকে নারীকে নিয়ে অমর গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি তন্ন তন্ন করে গ্রাম-বাংলার মানুষের দারিদ্র্যের কারণগুলো খুঁজে বেড়িয়েছেন। সেসব কারণ দূর করার জন্য গ্রামে গ্রামে স্কুল, হাসপাতাল, কৃষি খামার, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, সমবায়ভিত্তিক গ্রামীণ ব্যাংক, কৃষি মেলা এবং লোক সংগীতের নানা আয়োজন করতেন। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তিনি অনুভব করলেন যে সমাজের ভেতরে যে ঐতিহ্যিকভাবে আত্মশক্তি এবং হিতচিন্তা লুকায়িত আছে সে সবই মানুষের বড় পুঁজি। ভরসানির্ভর এ সামাজিক পুঁজিই তাদের জীবনের মান বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। সে জন্য মানুষকে জোট বাঁধতে হয়। কেননা একলা মানুষ টুকরা মাত্র। যা কিছু কল্যাণকর তা অর্জিত হয়েছে মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। বরীন্দ্রনাথের গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা বিষয়ে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা করেছিলাম আশির দশকের শেষ দিকে শিলাইদহে। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষ্যে ছিল এ আয়োজন। ওয়াহিদুল হক, প্রফেসর আনিসুর রহমানসহ অনেকেই রবীন্দ্রনাথের আর্থ-সামাজিক চিন্তার এ দিকগুলো নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

এরপর থেকে এ বিষয়ে আরও কাজ করি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ‘রবীন্দ্র-অমর্ত্য ভাবনা’ নামের একটি বই লিখেছিলাম। ইউপিএল প্রকাশিত সেই বইটি রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক ভাবনার বিষয়টিকে বাঙালি পাঠকের মনে বেশ খানিকটা উৎসাহ সৃষ্টি করে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথকে মূলধারার অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারায় যুক্ত করার চেষ্টা আমি করতে থাকি। পাশাপাশি কৃষির রূপান্তর নিয়েও গবেষণা অব্যাহত রাখি। বিশেষ করে আমার পিএইচডিনির্ভর গবেষণাটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নয়াদিল্লি এবং জেড বুকস, লন্ডন থেকে ‘পেজেন্টস অ্যান্ড ক্লাসেস’ নামে প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রামীণ অর্থনীতির শ্রেণিবিন্যাস ও বিভাজন নিয়ে গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ভালো সাড়া মেলে। পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উন্নয়নশীল বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও কৃষকদের নিয়ে গবেষণা করার ঝোঁক বাড়ে। এ জন্য আমি আমার তত্ত্বাবধায়ক সোয়াসের প্রফেসর টি. জে. বায়ার্সের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। তিনিই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রচুর উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং আমাকে গাইড করেছেন। এ গবেষণা শেষে গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনের জন্য পুঁজির অনুপ্রবেশ এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার মতো রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো আমার কাছে আরও স্পষ্ট হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এসব বিষয়ে আমার ধারণা আরও স্পষ্টতর হয়। আর এসব বহুমাত্রিক ধারণার সংশ্লেষ ঘটিয়েই আমি উন্নয়ন বিষয়টিকে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে তাকে ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ রূপরেখায় উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।

ইতোমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (‘ডব্লিও টিও’) প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ বিশ্ব সংস্থায় চীন যুক্ত হওয়ায় সারা বিশ্বেই আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটে। উন্নত দেশগুলো নিজেরা বেশি দামে ম্যানুফেকচারিং পণ্য উৎপাদন না করে কম দামে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে তা আমদানি করতে থাকে। শুল্ক সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, চীন এ ধারার বিশ্ব বাণিজ্য থেকে যথেষ্ট সুবিধা পেয়ে যায়। প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও এসব দেশে বস্ত্র, চামড়া, ওষুধসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনে বিরাট সাফল্য আসে। এসব দেশে স্বল্প দক্ষ তরুণ শ্রমিকের (বেশিরভাগই নারী) কাজ জোটে। গ্রাম থেকে শহরের আশপাশে গড়ে ওঠা শিল্প নগরীতে তারা কাজ পেতে থাকে। এর ফলে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমতে থাকে। এ ছাড়া প্রবাসে কাজের সন্ধানে বিপুলসংখ্যক মানুষের যাত্রার কারণে গ্রামের শ্রমবাজার ‘টাইট’ হতে থাকে। তাই গ্রামীণ মজুরির হার বেড়ে যায়।

সে কারণে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের হার বাড়ে। কৃষি উৎপাদন আরও দক্ষ হতে থাকে। সনাতনী খরপোষের কৃষি ধীরে ধীরে পুঁজিনির্ভর আধুনিক বহুমুখী কৃষিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। কৃষির প্রবৃদ্ধির সুবিধে হিসাবে কম মূল্যে খাদ্য সরবরাহ ঘটে শিল্প খাতে। তাই কম মজুরি দিয়েও রপ্তানিমুখী শিল্প খাত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে যায়। কৃষি, প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয়ের যুগপৎ সাফল্যেবাংলাদেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়। এর সুপ্রভাব শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি খাতেও পড়ে। ফলে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতেও উন্নতির পরশ লাগে। সামাজিক সুরক্ষার গণ্ডিও বাড়তে থাকে। ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় এবং আয়ু দুটিই বাড়তে থাকে। তাই দেশটির মানব উন্নয়ন সূচকেরও উল্লেখযোগ্য হারে উন্নতি চোখে পড়ে। ইতোমধ্যে সরকার অবকাঠামো ও কানেকটিভিটির ওপর জোর দিতে শুরু করে। সব মিলে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক ঈর্ষণীয় মডেলে পরিণত হয়।

উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবদানও এ ধারার উন্নয়নে যথেষ্ট লক্ষ করার মতো। এ বহুমাত্রিক বিষয়গুলোকে এক সুতায় বাঁধার আরেক নাম উন্নয়ন বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ এমন ধারার উন্নয়নকে চমৎকার কিছু শব্দগুচ্ছে প্রকাশ করেছেন এভাবে- ‘... যে-জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ক্রমশই সে জাতির প্রত্যেক বিভাগের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অকিঞ্চিতকরতা চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব তাদের সবাই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করার অধিকার পাচ্ছে। এ জন্যই সেখানে মানুষ ভাবছে কী করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো পরবে, রোগের হাত থেকে বাঁচতে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’ (‘বাতয়নিকের পত্র’ রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, জয় বুকস লি, ১৪০৬, পৃ. ৫৮১)।

এমন ধারার উন্নতি তখনই সম্ভব যখন মানুষের মনের পরিবর্তন ঘটে। মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হতে থাকে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তখনই এমন মনের পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। বহুমাত্রিক ভাবনার এ উন্নয়ন ধারা নানাভাবে প্রকাশের জন্য আমি সহজবোধ্য ভাষায় প্রচুর গবেষণানির্ভর লেখা লিখেছি। প্রায় পঁচাত্তরটি বইতে আমার উন্নয়ন ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্যি, এসব লেখার বড় অংশ গণমাধ্যমে আগে প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ফোরামে আমি আলাপও করেছি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ বক্তৃতাও করেছি। এক সময় মনে হলো গবেষক থেকে যদি শিক্ষক পরিচয়ে পরিচিত হতে পারতাম তাহলে আমার এসব ভাবনা তরুণ প্রজন্মের মনে আরও সরাসরি গেঁথে দিতে পারতাম। এমন সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যুক্ত হওয়ার একটি সুযোগ এলো। ওই বিভাগের চেয়ারম্যান তখন সালাউদ্দীন আমিনুজ্জামান। তিনি খুব করে চাইছিলেন আমি যেন অন্তত ওই পদে যোগ দেওয়ার আবেদনপত্রে সই করি। আমার স্নেহধন্য ড. ইউসুফ ও ড. তৈয়বের তোড়জোড়ই ছিল বেশি। তারাই আবেদনপত্র পূরণ করে আমাকে শুধু সই করতে বলল। তাদের ইচ্ছামতোই তা করলাম। আমার মনে আছে ইউসুফ আমার প্রকাশনার একটি করে কপি বিরাট এক কাগজের বাক্সে করে বয়ে নিয়ে গেল রেজিস্ট্রার ভবনে। এরপর যাচাই বাছাই হলো। বিশেষজ্ঞ কমিটি আমাকে অধ্যাপক হিসাবে নেওয়ার প্রস্তাব করল। সময়টা তখন খানিকটা বৈরী হলেও সে সময়ের উপাচার্য প্রফেসর ফয়েজ আহমেদ এবং ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর আসাদুজ্জামন সিন্ডিকেটে যথেষ্ট সমর্থন দিয়েছিলেন। আর অধ্যাপক হারুনর রশীদ, সাদেকা হালিম এবং আরেফিন সিদ্দিকের সহজাত সমর্থন তো ছিলই। দীর্ঘ সময় ধরে সিন্ডিকেটে নাকি বিতর্ক চলছিল। অবশেষে আমি, প্রফেসর মাহবুবউল্লাহ এবং নিয়াজ আহমেদ খান উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার অনুমোদন পেলাম।

২০০৬ সালের ১৮ জুলাই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে যোগদান করি। সেই থেকে আমি এ বিভাগের একজন শিক্ষক পরিচয় নিয়েই এগিয়ে চলেছি। আমার বড়ই সৌভাগ্য এ বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এক গভীর আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি। আমরা যোগ দেওয়ার পরপরই এ বিভাগ স্মাতক-পূর্ব (‘আন্ডারগ্র্যাড’) শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। আমাদের প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরাই এখন এ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। খুব বেশিদিন বিভাগে ক্লাস নিতে পেরেছি সে দাবি আমি করব না। মাত্র তিন বছর পরই আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রায় সাত বছর ছিলাম বাংলাদেশ ব্যাংকে। সেই সময়টাও এ বিভাগের উন্নয়নমূলক নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। সহকর্মী শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা বরাবরই যোগাযোগ রেখেছে আমার সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে, ২০১৬ সালে ফের বিভাগে ফিরে আসি। তার পরের বছর অবসরে গেলেও আজও আমি ‘অনারারি প্রফেসর’ হিসাবে যুক্ত আছি আমার প্রাণের বিভাগের সঙ্গে। মাঝখানে আড়াই বছর বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক হিসাবে ইতিহাস বিভাগের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত থাকলেও সবাই মনে করতেন আমি উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগেই ছিলাম। পারিবারিক এ সম্পর্কের কী ঠিকানা বদল হলেই ছেদ পড়ে? মোটেই না। এ বিভাগের নানা অনুষ্ঠানে আগেও যোগ দিতাম, এখনো দিচ্ছি। সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই অটুট আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে যাওয়ার ফলে আমার উন্নয়ন ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ ঘটেছে। বাস্তবায়নের কাঠামোর ভেতরে ছিলাম বলে আমি এখন বুঝতে পারি কোন নীতিটি আসলেই কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নানা বিচারেই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এর গবেষণা বিভাগটিও বেশ সবল। দীর্ঘ সাত বছরে আমার উন্নয়ন ভাবনার জারকরসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির আদলও খানিকটা বদলে ফেলার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত, উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং-এর রোল মডেল হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে বলে আমি দাবি করতে পারি। বিশেষ করে ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে ‘প্রকৃত অর্থনীতি’কে সমর্থন দেওয়ার কিছু নীতি কৌশল আমরা গ্রহণ করেছিলাম। সেগুলোর বেশিরভাগই এখনো চালু রয়েছে। কৃষি, খুদে ও সবুজ উদ্যোগ এবং ডিজিটাইজেশনকে সমর্থন দেওয়ার যে কৌশলগত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম তার সুফল আজও বাংলাদেশ পাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের জেরে কোভিড-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতি যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা থেকে তাকে পুনরুদ্ধারে উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আমার উন্নয়ন ধারণাটি যেভাবে বাস্তবানুগ পরিবেশে রূপান্তরিত হয়েছে তার পেছনে নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থায়নের কৌশল বড় ভূমিকা রেখেছে। রূপান্তরের সেই রূপরেখার আলোকেই উন্নয়ন ভাবনার রকমফেরের সংক্ষিপ্ত একটি ধারা চিত্র তুলে ধরতে চাই।

পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন আলাপটি শুরু করতে চাই। গল্পের নায়ক এক ডাকাত সর্দার। সাজানো খাবারের দোকানের সামনে অসহায়ের মতো বুভুক্ষু মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা এবং না খেয়ে মরে যাওয়ার দৃশ্য তাকে ভীষণ পীড়িত করেছিল। এক ধর্মগুরুকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘এভাবে মানুষ মরছে, তবুও কেন খাবার কেড়ে নিচ্ছে না?’ উত্তরে ধর্মগুরু বলেছিলেন, ‘সেটা ধর্মের বরখেলাপ হবে।’ ডাকাত সর্দার ধর্মগুরুর উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে তার দলের সদস্যদের নিয়ে স্থানীয় রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের বগিতে রাখা চালের বস্তাগুলো ডাকাতি করে নিয়ে গেলেন। সেই চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে বুভুক্ষু মানুষকে খেতে দিলেন। একটু শক্ত-সামর্থ্য হওয়ার পর তারা বললেন, তারা আরও চাল লুট করতে প্রস্তুত। ডাকাত সর্দার তখন পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন-এ চাওয়া কতক্ষণ টেকে। এক পর্যায়ে খাবার কমিয়ে দিলেন। মানুষগুলো আবার দুর্বল হয়ে পড়লেন। তখন তিনি বললেন, ‘চলো এবার যাই চাল আনতে।’ কিন্তু ততক্ষণে দুর্বল মানুষের আর তেমন আগ্রহ নেই।

ডাকাত সর্দার তখন বুঝতে পারলেন, মৌলিক খাবার না দিতে পারলে মানুষকে সংগঠিত করে কিছুই করা সম্ভব নয়। এটাই উন্নয়নের মূল কথা। আগে তো পেটে কিছু দিতে হবে, তবেই না অন্য কিছু। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যেমনটি লিখেছেন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা গেলেই না অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটানোর প্রশ্ন ওঠে। তার মানে মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চৌহদ্দিতে প্রবেশ করতে পারে। অর্থনীতি পাটাতন তৈরি করলেও উন্নয়নের স্থাপত্য তৈরি হয় সমাজ, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ ভাবনার সম্মিলনে। নিঃসন্দেহে উন্নয়ন বহুমাত্রিক এক বিষয়। দেশভেদে এর রকমফের হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।

উন্নয়ন বিতর্ক পরিক্রমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ মহাযুদ্ধের পর পৃথিবী স্পষ্টতই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের টানাপোড়েনের ফসল উন্নয়ন শব্দটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের চিন্তা থেকেই উন্নয়ন ভাবনার শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান উন্নয়নের নামে কারিগরি সহায়তা ও বৈদেশিক সাহায্যের সুদূরপ্রসারী মিশনের ঘোষণা দেন। এ সময় একদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে কেন্দ্রনির্ভর পরিকল্পিত মডেল, আর অন্যদিকে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ পুনর্গঠনে মার্শাল প্ল্যানের সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা। এ দুই বিপরীত ভাবাদর্শের মডেলই অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি ছিল মুখ্য। একটিতে রাষ্ট্র ছিল নেতৃত্বে; অন্যটিতে বাজার। এ দুই ভাবাদর্শের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উন্নয়ন ভাবাদর্শের বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছে। ১৯৫০-৬০ দশকের ‘মডার্নাইজেশন থিওরি’, ‘ডিপেন্ডেন্সি থিওরি’ থেকে আজকের ‘এমডিজি’, ‘এসডিজি’ পর্যন্ত পৌঁছেছে উন্নয়ন ভাবনা ও তার অনুশীলন। পুরো উন্নয়ন ভাবনার এ বিবর্তনে রাষ্ট্র ও বাজার উভয়েই ভূমিকা রেখেছে। তবে এ ভূমিকারও রকমফের আমরা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় দেখেছি।

আমাদের এ উপমহাদেশে প্রান্তজনবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ভাবনার সূত্রপাতকারী হিসাবে বলা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। আগেই যেমনটি বলেছি, পূর্ব বাংলায় তিনি এসেছিলেন জমিদার হিসাবে। কিন্তু প্রজাদের দুঃখ-বঞ্চনা দেখে তিনি খুবই ব্যথিত হন। তাই তাদের ভাগ্যোন্নয়নে ব্রতী হন। তিনি গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের মধ্যেই সারা দেশের উন্নয়ন দেখেছেন, আর তাই জোর দিয়েছেন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষির উন্নয়নের ওপর। তবে কৃষির উন্নয়নকে তিনি কেবল ফলন বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ হিসাবে না দেখে, কৃষকের হাতে ন্যায্যমূল্য পৌঁছে দেওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ, ঋণের ভার থেকে কৃষকের মুক্তি ইত্যাদির কথাও ভেবেছেন। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির বহুমুখীকরণ ও শিল্পায়নকে তিনি জরুরি হিসাবে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কোলে-পিঠে বেড়ে ওঠা নোবেলবিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনুন্নয়ন বা উন্নয়নের অনুপস্থিতিকে স্বাধীনতাহীনতার সঙ্গে এক করে দেখেছেন। তার মতে, মানুষের স্বাধীনতার বৃদ্ধি যেমন উন্নয়নের মাপকাঠি, তেমনি মানুষের স্বাধীনভাবে কাজ করার ওপরই উন্নয়ননির্ভর করে। তিনি ব্যক্তিকে কেবল উন্নয়ন কর্মসূচির নিষ্ক্রিয় উপকারভোগী হিসাবে না দেখে, সক্রিয় চালক এবং প্রভাবক হিসাবে দেখেছেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই নিম্ন আয়ের কৃষিনির্ভর দেশ হিসাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। আজ ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের বিবেচনায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নানামাত্রিক এসব রূপান্তরের সমন্বয়ই এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতি ও উন্নয়নের সব সূচকেই বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সব ক্ষেত্রেই দিন দিন বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। সরকারের বাজেটীয় উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংককেই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে ব্রতী করেছে। বিকাশমান এসএমই খাত গ্রাম থেকে শহরে আসা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। এ খাত থেকে আয় করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে এ শ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। যেমন : ক্ষুদ্র ইঞ্জিনিয়ারিং খাত থেকে বাংলাদেশ বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে এবং এখানে কাজ করছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক। চলমান মোবাইল বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ‘ফোর জি’ প্রযুক্তির পূর্ণ ব্যবহার ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মিডিয়া, ই-সার্ভিস, অনলাইন শপিং, ব্যাংকিংসহ সব খাতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির এ বিকাশের ফলে কোভিডকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দাভাব। বাংলাদেশও এ সংকটের বাইরে নয়। তবুও ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে হালে আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে বেশ খানিকটা চাপ পড়েছে। টাকার মূল্যমানে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। এ সবের প্রভাবে ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর স্বাভাবিক নিয়মেই পড়েছে। হয়তো প্রবৃদ্ধির ওপরও এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ কোভিডকালেও প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি রাখতে পেরেছিল। এ অর্থবছরে তার আশা ছিল প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে সাত শতাংশ। বাস্তবে হয়তো তা সম্ভব নয়। তবে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যেই তা থাকবে বলা যায়।

অতিদারিদ্র্যের হার কমানোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে। ২০২০ সালে এ হার প্রায় ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে (২০০৫ সালে তা ছিল ২৫ শতাংশ)। স্বল্পোন্নত শ্রেণিভুক্ত দেশ হয়েও বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে কেনিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, জিম্বাবুয়েকে (এরা স্বল্পোন্নত দেশ নয়) পেছনে ফেলে মধ্যম মানব উন্নয়নের দেশ হিসাবে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে সোশ্যাল প্রোগ্রেস ইনডেক্সেও ভারত, কেনিয়া, পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়াকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। গড় আয়ুর বিচারেও বাংলাদেশের অবস্থান ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর ওপরে। সার্বিক বিবেচনায় তাই বাংলাদেশকে ‘স্বল্পোন্নত’র কাতারে রাখার কোনো অর্থ ছিল না। এর ফলে কেবল উন্নয়নের নানা সূচকে দেশটির অর্জনগুলোকেই যে ছোট করা হচ্ছিল এমন নয়, পাশাপাশি বিশ্ব মঞ্চে এ দেশের অনুসরণীয় উদ্যোগগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ বলা হবে।

তবে অর্জন অনেক হলেও বাংলাদেশের সামনে এখনো রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে চলমান বিশ্ব সংকটের কারণে এ চ্যালেঞ্জগুলো আরও তীব্র হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে চাইলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে ৮ শতাংশের বেশি। আর সে জন্য বিনিয়োগের হার জিডিপির ৩৪ শতাংশের মতো করতে হবে। সংখ্যার হিসাবে দেশে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অনেক মানুষ বাস করছে দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে। তারা খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে কোনো সময় দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। তাই তাদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে গৃহীত উদ্যোগগুলো সুফল বয়ে এনেছে, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সদা সতর্ক থাকতে হবে। এ চ্যালেঞ্জটি দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। অবকাঠামো উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি, বাস্তবায়নের গতিও বৃদ্ধি করতে হবে। ক্রমাগত নগরায়ণ অবশ্যম্ভাবী। উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই নগরায়ণের কোনো বিকল্প নেই। বদ্বীপ পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এ পরিকল্পনার আলোকে নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের জবাবদিহিমূলক করতে পারলে উন্নয়ন আরও গুণমানের হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সুশাসনের সীমাবদ্ধতা ও নাগরিকদের প্রতি ন্যায়ভিত্তিক আচরণের যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেসব মোকাবিলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।

সবাই মিলে একযোগে কাজ করলে নিশ্চয় আমরা উন্নয়নের স্বপ্নিল সেসব লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হব। এ লক্ষ্য পূরণে আমাদের জনশক্তির দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। একদিকে যেমন আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতি ও ব্যাংকিং আরও বিকশিত করতে হবে, অন্যদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচে বদলে ফেলে উপযুক্ত দক্ষ জনশক্তি ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ার লক্ষ্যকে উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে স্থান করে দিতে হবে। উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে উন্নয়ন ভাবনার এ রকমফের নিয়ে নিরন্তর আলাপ ও বিতর্ক হোক সেই প্রত্যাশাই করছি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সম্মানীয় অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম