রোজার শেষে সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা একটি দান আবশ্যক করেছেন। সেটিকে বলা হয় যাকাতুল ফিতর তথা ফিতরা।
প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির নিজের ও তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করার নিয়ম।
জব, খেজুর, কিশমিশ ও পনির থেকে ফিতরা আদায় করলে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম আর গম বা গমের আটা দিয়ে ফিতরা দিলে এক কেজি ৭০০ গ্রাম বা এর সমমূল্য কোনো গরিবকে দিতে হবে।
ফিতরা বিধানের হিকমত বা রহস্য কী? এ নিয়ে বিভিন্ন মতামতের ভেতর প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে এই যে, রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে যেসব ত্রু টি বিচ্যুতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা এ বিধান দিয়েছেন।
আরেকটি মত হচ্ছে রোজা শেষের ঈদটা যেন সবাই মিলে একসঙ্গে উদযাপন করতে পারে। ঈদের দিন অভাবী দুস্থ লোকেরা যেন আনন্দে কাটাতে পারে।
জানার বিষয় হচ্ছে, কাদেরকে ফিতরা দেওয়া যাবে? নিশ্চয় গরিব দুঃখিদের মাঝে বণ্টন করতে হবে।
কিন্তু কেবল গরিব মুসলিমদেরকেই কি ফিতরা দিতে হবে? অমুসলিমদের মাঝে ফিতরা বণ্টন করা যাবে না?
ইসলাম ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণে কাজ করতে শেখায়। দান সদকার ক্ষেত্রেও ইসলামে এ উদারতা রয়েছে। সব ধর্মাবলম্বী মানুষকে দান করার নির্দেশনা রয়েছে কোরআন সুন্নায়।
কেবল জাকাতের ক্ষেত্রে ভিন্ন বিধান। অর্থাৎ জাকাত কোনো অমুসলিমকে দেয়া যাবে না। যদিও পবিত্র কোরআনে অমুসলিমদেরও জাকাত দেওয়ার কথা এসেছে কিন্তু বিধানটি বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণ অবস্থায় সে বিধান প্রযোজ্য নয়।
কখনও সেরকম পরিস্থিতি হলে ফিকহ বিশারদরা বলেন, আবারও অমুসলিমদেরও জাকাত দেওয়ার সুরত হবে।
জাকাত ছাড়া অন্য সব দান সদকা মুসলিমদের মাঝে যেমন বিলি করা যায়, অমুসলিমদেরও এসব ওয়াজিব ও নফল দানে শরিক করা যায়। যেমন কাফফারা, মানত ও সদাকাতুল ফিতর। এসব সদকা অমুসলিমদের দিলেও আদায় হয় বলে ফতোয়ার কিতাবাদিতে রয়েছে।
হানাফি মাজহাবের সব কিতাবেই এ মাসআলা লেখা আছে।
বাদায়েউস সানায়ে, তাবইনুল হাকায়েক ও অধিকাংশ ফতোয়ার কিতাবে এ মাসআলার পক্ষে দলীল দেওয়া হয়েছে সুরা মুমতাহিনার আয়াত দিয়ে।
যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, যে সব কাফের তোমাদের সাথে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়নদেরকে ভালোবাসেন। [সুরা: মুমতাহিনা, আয়াত: ৮]
ঈদের দিন আপনি ঈদের আনন্দ করবেন আর আপনার প্রতিবেশি কোনো দরিদ্র হিন্দু বা বৌদ্ধ না খেয়ে থাকবে তাহলে আপনার ঈদ কি করে সুন্দর হয়?
কেবল ঈদ কেন, অন্য সময়েও অমুসলিম প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নেয়ার বিধান খোদ রাসুল সা. হাদিসে দিয়েছেন।
নবীজী বলেন, মুমিন হতে পারবে না ওই ব্যক্তি, যে তৃপ্তিসহকারে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশি থাকে অভুক্ত। [তাবারানি]
এখানে মুসলিম প্রতিবেশীর কথা বলেননি রাসুল সা.। যে কোনো প্রতিবেশির ক্ষেত্রেই এ বিধান।
সাহাবায়ে কেরাম রাসুল সা.-এর এ বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেখিয়েছেন। হযরত ইবন উমর রা.-এর বাড়িতে একবার বকরি জবাই হলো। তিনি বাইরে থেকে এসেই জিজ্ঞেস করলেন, আমার ইহুদি প্রতিবেশির ঘরে মাংস পাঠিয়েছ কি?
এখানে ফতোয়ায়ে শামি থেকে নবীজীর একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, মক্কার কাফেরদের সঙ্গে যখন চরম দুশমনি চলছে মদীনার। ঠিক সে সময়ে মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাসুল সা ও সাহাবিরা নিজেরাই তখন কষ্টে আছেন তা সত্ত্বেও মদীনা থেকে ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা পাঠিয়ে দেন মক্কার কাফের সর্দার আবু সুফিয়ান ও সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার নিকট।
মক্কার দরিদ্র মানুষদের মাঝে বণ্টন করে দিতে বলেন। [ফাতাওয়ায়ে শামি ৩/৩০২]
দুর্যোগের সময় অমুসলিমদের ত্রাণ সহায়তার প্রেরণা আমরা এঘটনা থেকেই লাভ করতে পারি।
প্রতিটি প্রাণের সেবার প্রতিই উৎসাহিত করে ইসলাম। মানবকল্যাণের সবক শিখিয়েছেন প্রিয় নবীজী সা.। সত্যিকারের মুসলিম হতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই এ নির্মল শিক্ষা ধারণ করতে হবে জীবনে।
অন্তত এবারের রোজায় যেন আমরা ফিতরা দেওয়ার সময় আশপাশের দরিদ্র অমুসলিমদেরও খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। সদকাতুল ফিতর থেকে একটা অংশ তাদের জন্যও ব্যয় করি।তাহলে বৃদ্ধি পাবে সম্প্রীতির বন্ধন, বাড়বে ইসলামের প্রতি তাদের মুগ্ধতা।