সামান্থা হার্ভে’র অর্বিটাল জিতল বুকার প্রাইজ
মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আঘাতপ্রাপ্ত পৃথিবীর গল্পে আমি থাকেত চাই শুধু মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী। ব্রিটিশ লেখিকা সামান্থা হার্ভে এমন কথা বলেছেন কিনা জানা হয়নি। তবে বুকার পুরস্কারের বিচারক প্যানেল হার্ভের মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী থাকার মনোভাবের পরিচয় পেয়েছেন তার অসাধারণ উপন্যাস অর্বিটালের মধ্যে।
যার জন্য ২০২৪ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে সামান্থা হার্ভেকেই বেছে নিয়েছেন তারা। হার্ভে, যিনি ইতঃপূর্বে চারটি উপন্যাস ও একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। ২০২০ সালের পর প্রথম কোনো ব্রিটিশ লেখক হিসাবে বুকার জিতলেন তিনি। হার্ভে এর আগে বেশ কয়েকবার বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন এবং তার অন্যান্য প্রভাবশালী কাজের মধ্যে প্রথম উপন্যাস দ্য ওয়াইল্ডারনেস এবং দ্য শেপলেস ইউনিজ উল্লেখযোগ্য।
অর্বিটাল উপন্যাসটি মূলত ভাষার সৌন্দর্য আর অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান দিয়ে গঠিত এবং এর মধ্য দিয়ে হার্ভে পাঠকদের মহাকাশের অজানা গতি এবং পৃথিবীর প্রতি মানবিক আকর্ষণের গভীরতা অনুভব করাতে চেয়েছেন। এ বইটি নিয়ে অনেক সমালোচক প্রশংসা করেছেন, বিশেষ করে এর কাব্যময় ভাষা এবং গভীর চিন্তার জন্য, যা হার্ভের লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা হয়। বইটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা ছয় নভোচারীর জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত, যেখানে তারা মহাকাশ থেকে পৃথিবীর সৌন্দর্য আর মানবজীবনের ভঙ্গুরতাকে উপলব্ধি করেন। উপন্যাসটি মানবিক অনুভূতি, একাকিত্ব, শোক ও ক্লান্তির মধ্যে এক গভীর সংলাপ তৈরি করে। মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় নভোচারীদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, স্মৃতি এবং মানবজীবনের বিপন্নতা নিয়ে যে প্রশ্ন তারা করেন তা পাঠকদের মনোযোগ কাড়ে।
হার্ভে কোভিড-১৯ মহামারির সময় লকডাউনে বইটি শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, এ উপন্যাস ‘ঠিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে নয়, তবে পৃথিবীর এ দৃশ্যের মধ্যে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা অন্তর্নিহিত রয়েছে।’ হার্ভে এ উপন্যাসটিকে শুধু মহাকাশ বা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসাবে দেখতে চাননি বরং এক ধরনের ‘স্পেস প্যাস্টোরাল’ হিসাবে তৈরি করেছেন, যেখানে মহাকাশের নির্জনতা ও সৌন্দর্যের মাঝে পৃথিবীর প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। অর্বিটালের প্রধান সৌন্দর্য এর ভাষার নান্দনিকতা এবং দৃশ্যপটের রূপময়তায়। হার্ভে মূলত প্রাকৃতিক দৃশ্যপটকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যেন প্রতিটি বাক্য পাঠকদের নিজস্ব মহাকাশ অভিযানে নিয়ে যায়।
লেখক ও শিল্পী এডমন্ড ডি ওয়াল, যিনি পাঁচ সদস্যের বিচারক প্যানেলের সভাপতি ছিলেন, অর্বিটালকে ‘অলৌকিক উপন্যাস’ আখ্যা দেন যা ‘আমাদের পৃথিবীকে আমাদের জন্য অদ্ভুত ও নতুন করে তোলে।’ হার্ভের মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসের ‘স্ফটিকের মতো স্পষ্ট’ লেখনী ও ‘ব্যাপকতা’র প্রশংসা করেন ডি ওয়াল। তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি বই যা ধীরগতিতে পড়ার পর পূর্ণতা লাভ করে।’ বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী গ্যাবি উড বলেন, ‘একটি ভূরাজনৈতিক সংকটের বছরে, যেটা ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,’ এমন সময় বিজয়ী বইটি ‘আশাবাদী, সময়োপযোগী ও কালজয়ী।’
অর্বিটাল উপন্যাসের মাধ্যমে সামান্থা হার্ভে একটি নতুন ধরনের সাহিত্যকর্ম তৈরি করেছেন, যা মহাকাশে বসবাসকারী মানুষের জীবনের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা এবং পৃথিবীর প্রতি তাদের সংযোগকে ফুটিয়ে তোলে। বইটি যেমন অত্যন্ত কাব্যময়, তেমনই এর চরিত্রগুলো পৃথিবী থেকে দূরে থেকেও মানবজীবনের সঙ্গে আবেগের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। পাশাপাশি, তাদের চোখের সামনে আবির্ভূত হওয়া তুষার ঝড়ের দৃশ্য এবং নিজেদের শরীরে দেখা দেওয়া স্বাস্থ্যগত সমস্যা তাদের মধ্যে অপরিসীম অস্থিরতা ও একাকিত্বের জন্ম দেয়, যা পাঠকদের মনেও অনুরণিত হয়।
নিজের বই নিয়ে হার্ভে বলেন-‘মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখাটা এমন, যেন কোনো শিশু আয়নায় নিজেকে দেখে এবং প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে, আয়নায় প্রতিফলিত ব্যক্তিটি সে নিজেই।’ হার্ভে মহাকাশচারীদের বই পড়ে এবং মহাকাশ স্টেশনের ক্যামেরায় লাইভ দেখে তার উপন্যাসের জন্য গবেষণা করেছেন। তার মতে ‘পৃথিবীর প্রতি আমরা যেমন আচরণ করি, সেটা আসলে আমরা নিজেদের প্রতিই করি।’
সমালোচকদের মতে, হার্ভের অনন্য ভাষাশৈলী এবং প্রতিটি চরিত্রের অভ্যন্তরীণ অনুভূতিকে তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা সাধারণ কল্পকাহিানর গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। এটি মহাকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্কের গভীরতম স্তরে প্রবেশ করে, যেখানে প্রতিটি নভোচারী পৃথিবীর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও সুরক্ষার জন্য এক ধরনের বেদনাবোধ অনুভব করে। অনেক সমালোচকের মতে, এ উপন্যাস কেবল গল্প নয় বরং মানবজাতির প্রতি এক গভীর আবেগময় পত্র। এটি একদিকে মহাকাশযান সংক্রান্ত বাস্তবতা এবং অন্যদিকে মানবতার গভীর অধ্যায়ের কথা বলে, যা হার্ভে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমন্বিত করেছেন।
অর্বিটাল উপন্যাসে প্লটের তুলনায় চরিত্র ও ভাবনাগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটি প্রথাগত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির থেকে ভিন্ন, যেখানে প্রযুক্তি কোনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে না। বরং, উপন্যাসটি গভীরভাবে মানবিক চিন্তা, অস্তিত্বের সমস্যা এবং পৃথিবীকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করে। আমেরিকা, রাশিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের ছয়জন মহাকাশচারীরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে এসেছে, তবে ধীরে ধীরে তারা ভাবতে শুরু করে : পৃথিবী ছাড়া জীবন কেমন? মানবতা ছাড়া পৃথিবীই বা কেমন? তারা ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে পৃথিবীকে একদিনে ১৬ বার প্রদক্ষিণ করছে।
আমরা দেখি তারা শুকনো খাবার তৈরি করছে, মাধ্যাকর্ষণমুক্ত ঘুমে ভাসছে এবং তাদের পেশির ক্ষয় রোধে নিয়মিত ব্যায়াম করছে; আমরা দেখি তারা এমন সম্পর্ক তৈরি করছে যা তাদের একাকিত্ব থেকে রক্ষা করে। তারা একটি দ্বীপের ওপরে একটি টাইফুনের গঠনের দৃশ্য দেখছে; এর মহিমা দেখে বিস্মিত এবং এর ধ্বংসের সম্ভাবনায় ভীত। এখানে মহাকাশচারীদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পৃথিবীকে রক্ষা করার তাগিদ তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের বিশ্বে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিচারক প্যানেলের প্রধান ডি ওয়াল বলেন-‘বিচারক হিসাবে আমরা এমন একটি বই খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম যা আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে, একটি বই যাতে বিশালতা ও অনুরণন আছে, যা আমরা সবার সঙ্গে ভাগ করতে আগ্রহী। আমরা এমনকিছুই চেয়েছিলাম।.....সারা বছর আমরা এমন কথাসাহিত্য উদযাপন করেছি যা বিশেষ একটা বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে তবে কোনো সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয়নি, উত্তর খোঁজেনি বরং আমরা যা অন্বেষণ করতে চেয়েছিলাম তার প্রশ্নটাই পালটে দিয়েছে। অর্বিটাল সম্পর্কে আমাদের ঐকমত্য তার সৌন্দর্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি। আর আমরা যেখানে বসবাস করি সেই মূল্যবান ও নাজুক পৃথিবীর প্রতি হার্ভের অসাধারণ মনোযোগের পরিচয় অর্বিটাল।’
ব্রিটিশ লেখক সামান্থা হার্ভে মূলত উপন্যাস এবং আত্মজীবনীমূলক লেখার জন্য পরিচিত। তার লেখায় বিভিন্ন সময়কালের মানুষের জীবন, স্মৃতি এবং মনস্তত্ত্বের গভীর উপলব্ধি ফুটে ওঠে। হার্ভে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন এবং তার বেশ কিছু বই আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত একজন বৃদ্ধের জীবন ও স্মৃতির বিবরণ নিয়ে লেখা তার উপন্যাস ‘দ্য ওয়াইল্ডারনেস’ ব্রিটিশ উপন্যাসের মর্যাদাপূর্ণ ওয়েভারলি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় এবং এর মাধ্যমে তার সাহিত্যজীবন প্রতিষ্ঠিত হয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বুকার পুরস্কার পাওয়ার পর এক বক্তব্যে হার্ভে বলেন-যেসব মানুষ পৃথিবীর পক্ষে সরব থাকেন, অন্য মানুষের মর্যাদা, অন্য প্রাণের পক্ষে কথা বলেন এবং যেসব মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকেন ও কাজ করেন, তাদের সবার জন্য তিনি এ পুরস্কার উৎসর্গ করছেন।
সূত্র : সিএনএন ও দ্য বুকার প্রাইজ