আমদানি-রপ্তানি ও ইন্ডেন্ট প্রতিষ্ঠান নজরদারিতে
অর্থ পাচার করলেই নিবন্ধন বাতিল
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা: বাতিল হবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন * বৈদেশিক বাণিজ্যের মিথ্যা তথ্য দেওয়া নিষিদ্ধ * নিবন্ধন ছাড়া বাণিজ্য নয়
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে দেশের আমদানি, রপ্তানি ও ইন্ডেন্ট প্রতিষ্ঠানকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। ইন্ডেন্ট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের একক ডিলার বা এজেন্টশিপ। এসব প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক (আমদানি-রপ্তানি) বাণিজ্যের অন্তরালে অর্থ পাচারের ঘটনা পাওয়া গেলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া পণ্য ও সেবা আমদানি-রপ্তানির নামে আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসিং করলেও প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল হবে। এছাড়া এখন থেকে নিবন্ধন ছাড়া দেশের ভেতর কোনো আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং ইন্ডেন্টের প্রতিষ্ঠান পণ্য ও সেবা আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে না। সম্প্রতি এসব কঠোর বিধান রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
প্রসঙ্গত, আমদানি-রপ্তানির অন্তরালে বিদেশে টাকা পাচার প্রসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রথম মুখ খুলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্র্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশ্যে উল্লেখ করেছিলেন, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। তিনি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করেন যে, ১ লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস হয়েছে’ বিষয়টি গোচরীভূত হওয়ার পর এ ধরনের ১০০টি ঋণপত্র পরে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলেও তিনি জানান।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্টে (২০২০ সাল) বলা হয়, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তর জানিয়েছে, আমদানি রপ্তানির অন্তরালে দেশ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সব মিলিয়ে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৮২১ কোটি টাকার বেশি। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত এভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, নিবন্ধন গ্রহণ ছাড়া কোনো আমদানিকারক, রপ্তানিকারক বা ইন্ডেন্টর বাংলাদেশে পণ্য বা সেবা আমদানি বা দেশ থেকে পণ্য বা সেবা রপ্তানি করতে পারবে না। ক্ষেত্রবিশেষ ইন্ডেন্ট করতে পারবে না।
সেখানে আরও বলা হয়, নিবন্ধন নেওয়ার পর আমদানি, রপ্তানি বা বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কিত যে কোনো বিধানসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘন হলে এই আদেশের আওতায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। এছাড়া আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্য বা সেবার মূল্যে আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং করা হলে সেক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এছাড়া প্রতারণামূলকভাবে নিবন্ধন সনদ অর্জন বা অর্জনের চেষ্টা এবং আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য বা সেবার সরবরাহ, মজুত, গুণগত মান অথবা মূল্য সম্পর্কিত কোনো আইন অমান্য করলে, ইন্ডেন্ট সম্পর্কিত কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলেও নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
নজরদারির আওতায় আনতে আদেশে আরও বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নেওয়ার এবং প্রতিষ্ঠান ঘোষণার সময় যে ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে। তবে ওই ঠিকানায় যদি আমদানিকারক, রপ্তানিকারক বা ইন্ডেন্টর প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে একই (নিবন্ধন বাতিল) আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি, রপ্তানি এবং ইন্ডেন্ট সংক্রান্ত কোনো ধরনের মিথ্যা তথ্য দেওয়া যাবে না। মিথ্যা তথ্য দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, আদেশটি কার্যকর করা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়, যদি গেজেটটি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করা হয়। আর সেটি করা হলে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, এই আদেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফইইউ) একটি শক্তিশালী ইউনিট প্রতিষ্ঠা এবং তদন্ত টিম গঠন করতে হবে। ওই টিম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখবে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে আদেশ জারি করেছে সেটির নাম দেওয়া হয়েছে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং ইন্ডেন্টের (নিবন্ধন) আদেশ-২০২৩। এটি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট (কন্ট্রোল) অ্যাক্ট-১৯৫০ এর সেকশন তিনের সাব-সেকশন একের ক্ষমতাবলে করা হয়।
নিবন্ধন নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিধান আরোপ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির দেশের মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হলে বা দুই বা তার বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা একই পরিবারের সদস্য হলে সেক্ষেত্রে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিতে হবে। এছাড়া অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুই বা এর বেশি প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররা একই পরিবারের সদস্য বা মালিক একজনই হলে সেক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিতে হবে।
এ আদেশ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বিকেএমই’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম যুগান্তরকে জানান, সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা অবশ্য থাকতে হবে। এখন পণ্য আমদানি করতে হলে ইম্পোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট থাকতে হয়। এখন নতুন করে এই আদেশের আওতায় আনা হচ্ছে। আমি মনে করি এটি যৌক্তিক। কারণ সরকারের কোনো না কোনো জায়গায় প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যে যা খুশি আমদানি বা রপ্তানির নামে টাকা পাচার করবে এটি হতে পারে না।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবমতে একই সময়ে দেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর ওই তথ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে যে, ওই রপ্তানি মূল্যের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯ কোটি ডলারই দেশে ফেরত আসেনি, যা মোট রপ্তানি মূল্যের ২২ শতাংশ। এই যে আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কাগুজে মূল্যকে বেশি করে দেখানো কিংবা রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ দেশে না আসার মতো ঘটনা ঘটেই চলছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দেশের আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এই আদেশ জারির আগে ‘ইম্পোর্ট, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইন্ডেন্টের রেজিস্ট্রেশন অর্ডার-১৯৮১’-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে অনেক দুর্বলতা ছিল। যে কারণে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের অন্তরালে বিদেশে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। সেটি বন্ধ করতেই নতুন আদেশ জারি করা হয়েছে এবং ‘ইম্পোর্ট, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইন্ডেন্টের রেজিস্ট্রেশন অর্ডার-১৯৮১’ রহিত করা হয়েছে।