‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপির খসড়া
মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় পথ চলবে
মতামত নিতে মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক, একমত হলে সব দলের স্বাক্ষরসহ প্রকাশ করবে
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি। এতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম, গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যায় জড়িতদের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের কথা বলেছে দলটি। একই সঙ্গে ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। ঘোষণাপত্রের এই খসড়া নিয়ে শুক্রবার থেকে মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি।
এদিন তিনটি দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে তাদের কাছে মতামত চেয়ে বিএনপি বলেছে, মিত্র সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে চায়। ঐকমত্যের ভিত্তিতে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো খসড়ায় স্বাক্ষর করলেই শুধু তা বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে। সব দল ঐকমত্য না হলে ঘোষণাপত্র নাও দিতে পারে। আজ লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল-এলডিপি ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। তবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ খসড়ার বিষয়টি ‘গোপন’ রাখার বিষয়ে মিত্রদের অনুরোধ করেছে বিএনপি। তাই এ বিষয়ে বিএনপি বা মিত্র দলগুলো কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, দেশ ও দেশের গণতন্ত্র যতবার সংকটে পড়েছে, ততবারই ত্রাতা হিসাবে বিএনপি আবির্ভূত হয়েছে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অগ্রণী ভূমিকা সবারই জানা। কোনো একটাকে বাদ দিয়ে আমাদের পথচলা সম্ভব নয়।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির। তবে এর আগের দিন রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ না দিয়ে সরকারের উদ্যোগকে ‘সময়োপযোগী’ আখ্যা দিয়ে একে সাধুবাদ জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের যুক্ত রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সূত্রমতে, সেই বৈঠকে মূলত বিএনপি ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আরও সময় চায়। দলটি মনে করছে, সব রাজনৈতিক ও সংগঠনের ঐকমত্য ছাড়া ঘোষণাপত্র দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এরপর জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিনিয়র নেতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘ঘোষণাপত্র’র খসড়া তৈরি করে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পক্ষে যা কিছু হয়েছে, এগুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা সংগঠন অথবা ব্যক্তির পক্ষে পথ চলা সম্ভব নয়। যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করবে তাদের নিয়েই পথ চলবে বিএনপি।
এদিকে ৫ আগস্টের পরে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের খসড়া ঘোষণাপত্রে যেভাবে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হবে; এটি নিয়েও বিএনপির আপত্তি আছে। দলটির অভিমত-এটা অপ্রয়োজনীয়। এটাকে ডিক্লারেশন আকারে দিতে হবে। আর যখন এটা নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হবে, তখন এটা ঘোষিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির কোনো বিরোধ নেই। তবে এটাও স্মরণ রাখতে হবে, শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়নি। বিগত বছরগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। দল হিসাবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এমনকি জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানেও বিএনপির সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী জেল-জুলুম-রিমান্ডের শিকার হয়েছেন। সর্বোচ্চ সংখ্যক শহিদ হয়েছেন। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রে এসবের স্বীকৃতি থাকা উচিত।
বিএনপির তৈরি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’র খসড়ায় যা আছে : মোট ১৬টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এ ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দুই পৃষ্ঠার নিচে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর জন্য ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরের জন্য লেখা আছে। যুগান্তরের হাতে আসা ঘোষণাপত্রের খসড়ার ওপরে শিরোনামে বলা আছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। তার নিচে আছে ‘জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র’ লেখা আছে।
খসড়ায় বলা হয়, ‘যেহেতু এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল; যেহেতু বাংলাদেশের আপামর জনগণ ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে; যেহেতু দীর্ঘ ষোলো বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে এক ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়; যেহেতু জবরদস্তিমূলক একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবৈধ আওয়ামী সরকার দুঃশাসন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাধন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে এবং সব রাষ্ট্রীয়/সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধন করে।’
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘যেহেতু তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে; যেহেতু ধারাবাহিক তিনটি নির্বাচনি প্রহসনের মধ্য দিয়ে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে; যেহেতু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়; যেহেতু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলশ্রুতিতে সারা দেশে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়; যেহেতু গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রণীত নয় দফা দমনে ফ্যাসিস্ট সরকার চরম নির্মমতার আশ্রয় নেয় এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ জারি করে এবং ব্লকরেইড করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে এই অদম্য ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং রাজপথে নারী-শিশুসহ দুই সহস্রাধিক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়; অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করেন। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ বিগত ষোলো বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে; সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’