Logo
Logo
×

রাজনীতি

বিএনপির সেমিনার

৩১ দফা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ এএম

৩১ দফা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই

রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেন, ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। এখন দেশের মানুষ মনে করে নির্বাচন কেন্দ্রিক সংস্কার দ্রুত শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের। সে জন্য নির্বাচনি রোডম্যাপও ঘোষণা চায় বক্তারা।  

বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ’৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রুপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী ও চিকিৎসক ও আইনজীবী ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, ভারত, জাপান, সৌদি আরব, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২৮ দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।

 সেমিনারের সভাপতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাগত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কেন লেখা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়। আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে আছি। আমাদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘাড়ে বসে থাকা ফাসিবাদকে সরাতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমরা সংস্কারের বিষয়টি জাতির কাছে আগেই তুলে ধরেছি। যুগপৎ আন্দোলন শরিক দলগুলো ঐক্যমত হয়ে ৩১ দফা দিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, ঐক্যবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সফলতা অর্জন করতে পারব।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচিতে যা যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। ৩১ দফায় দুই ধরনের সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। একটা হচ্ছে-সংবিধান সংক্রান্ত, আরেকটি হচ্ছে দেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত। 

৩১ দফার বাইরেও বেশ কিছু সুপারেশ করেন মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতি কী হবে। গত ৫৩-৫৪ বছরে সংবিধানের মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু মূলভিত্তি ফাংশনাল হয়নি। ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক তর্ক আছে, অনেক ধরনের উপলদ্ধি আছে। তাই আমার সুপারিশ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ঘোষণায় যে নীতিগুলো ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ইনসাফ, ন্যায্যতা-এইগুলো হওয়া উচিত সংবিধানের মূলনীতি। দ্বিতীয়ত, সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের একটা ব্যাপার আছে-এটাকে নিয়েও আপনাদের চিন্তা করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম আছে। আমাদের সংবিধানেও আছে। রাজনৈতিক সুবিধা ও ফায়দা লুটার জন্য হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেছিলেন। এই নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে সরিয়ে দিতে সাহস দেখাইনি। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শ কাতর। এটা নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা হওয়া উচিত।

বাংলাদেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করার যে আলোচনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ বিভিন্ন সময়ে করে থাকেন তার বিরোধীতা করেন মাহবুব উল্লাহ। 

তিনি বলেন, কারণ আমাদের পাশে রয়েছে ভারত। ভারত হচ্ছে আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। বিগত তিন মাসে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মিডিয়া ও দেশটির নেতৃবৃন্দ যেসব কথা বলেছেন সবগুলো আগ্রাসী। তাদের নিরাপত্তা চিন্তক যারা তারা বলেন, সেভেন সিস্টারে তাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং রংপুরকে বিচ্ছিন্ন করে এর মধ্যদিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হবে। ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে বেশ তৎপর। এ সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে হলে আমরা কখনো প্রদেশ গঠনের চিন্তা করতে পারি না।

বাংলাদেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হোক এমন কোনো সংস্কার আমরা করতে পারি না বলেও মন্তব্য করেন মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, প্রদেশ গঠন নয়, স্থানীয় সরকারকে সক্রিয় করা, তাদের ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ি এলাকার উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। সেখানকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে সেজন্য এই সংস্কারের মধ্যে ব্যবস্থা রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে আছে বন্ধু রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে না। এটাকে এখন উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কারণ আমরা এখন কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। 

এবি পার্টির ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফার প্রত্যেকটি দফার পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক তর্ক জারি থাকা উচিত। রাজনৈতিক দলের কাঠামো সংস্কার নিয়েও আমাদের আলাপ তোলা দরকার। 

জাতীয়তাবাদী সমমনা দলের প্রধান সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেছেন, ৩১ দফা বাস্তবায়ন করতে হলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার।  

লেবারপার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, যে বিষয়গুলো মীমাংসিত যেমন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহি রহমানের রহিম-এ গুলো নিয়ে যেন আমরা প্রশ্ন না তুলি। 

৩১ দফা সংস্কার প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু সংখ্যালঘু যারা-তাদের প্রতিনিধিত্বটা সংসদে, রাষ্ট্রে, সমাজের নানা স্তরে কিভাবে হবে তা গভীর মনোযোগ দাবি করে। 

তিনি বলেন, ৩১ দফায় কোন দল বা ব্যক্তি ক্ষমতায় যাওয়ার পরে স্বেচ্ছাচারি হয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ন আলোচনা আমরা হাজির করেছি। 

সাইফুল হক বলেন, গত ১৬ বছর ছিল বিচার বিভাগকে দমন করার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই বিচার বিভাগকে পরিবর্তন করে তার একটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের খুবই গুরুত্ব এজেন্ডা ৩১ দফার ভেতরে সুনির্দিষ্টভাবে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রের যৌক্তিক ও আনুপাতিক হারে নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়নী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে এবং সবগুলো মিলে একটা ইন্ডিপেন্ডেটস সবরিন ন্যাশনস স্ট্রেট-এই জায়গা।    

জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ৩১ দফায় সবকিছু চমৎকারভাবে লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের উন্নয়ন, শিল্পের বিকাশ, সামাজিক উৎকর্ষতা সব কিছু আছে। এর গ্রান্টি ক্লোজ কোথায়? কেন এগুলো বারবার ব্যাহত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তার বাংলাদেশ সফরের (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে) মধ্যদিয়ে তথাকথিত নির্বাচন এবং নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে শাসন চালিয়ে গেছে, সমস্ত উন্নয়ন, সমস্ত পরিকল্পনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে গেছে, তা ৩১ দফায় পর্যপ্ত বলা নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সমোস্ত উন্নয়ন বা দাবি নামাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে; তা সন্নিবেশিত করা, অগ্রাধিকার দিতে হবে।  

আওয়ামী নেই, বিএনপি-ই ক্ষমতায় আসবে উল্লেখ করে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপিকে বলব, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েন না, যেটা আপনারা করতে পারবেন না।

সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে মান্না বলেন, অনেকেই বলেন, সংস্কার শেষ করে তার পরে ভোট। আমার মনে হয় জিজ্ঞাস করি, ভাই এটার শেষ কোথায়? কী হলে শেষ? আপনি বলতে পারেন সংস্কার এতদূর পর্যন্ত আমার দরকার। আমি লড়াই করেছি ১৫ বছর, আমার ভোট নেই, বাঁচার অধিকার নেই। রক্তের মধ্যদিয়ে স্লোগান উঠছে  নতুন বাংলাদেশ চাই। তাই যদি চান, তাহলে দেশে গণতন্ত্র লাগবে। ভোট লাগবে-এমন ভোট যেটা সবাই গ্রহণ করতে পারবে। সেই ধরনের ভোট করার জন্য ন্যূনতম পরিবেশ লাগবে। লাগবে লেভেল প্লেলিং ফিল্ড। সেই ফিল্ড তৈরী করতে হলে পুলিশ, আমলা এবং নির্বাচন কমিশন ঠিক করতে হবে। খুব দ্রুত ভোট দরকার। 

তিনি আরও বলেন, বিএনপি যখন বলে নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই। অনেকে বুঝে আবার বুঝে না। সংস্কার করতে সরকারের কতদিন লাগবে, সেটা সরকারকে বলতে হবে। সে হিসেবে বিএনপি যখন রোডম্যাপ চায়, তখন রোডম্যাপ চাওয়াটা খুবই যৌক্তিক। বিএনপিকে বলতে হবে, তুমি যদি রোডম্যাপ না দাও, তোমরা কি অনন্তকাল থাকবে নাকি?        

সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ হচ্ছে, আমাদের ৩১ দফা, এটি জাতির সনদ হিসেবে গণ্য করা যায়। জাতীয় ঐক্যমত এবং জাতির ধারক ও বাহক বলা যায়। এটি শেষ দফা নয়, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে এটিতে সংযুক্ত বা বিয়োজন হতে পারে।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের দিন বদলের কর্মসূচি দেয়। তবে এটিতে সাধারণ মানুষের কোনো ভাগ্য বা দিন বদলের পরিবর্তন আসে না। পরিবর্তন আসে ওই রাজনীতি নেতাদের। তাই বলছি, মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে ৫ আগস্টের যে আকাঙ্খা সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপির ৩১ দফায় শেষ নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও যেন যুক্ত করতে পারি সে বিষয়টি রাখতে হবে।

বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিনের পরিচালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর রফিকুল ইসলাম খান, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও অ্যাডভোকেট এলিনা খান প্রমুখ।

এই সেমিনারে আরও ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আফরোজা খান রীতা, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীম প্রমুখ।






















বিএনপির সেমিনার: ৩১ দফা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই, নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় বক্তারা

যুগান্তর প্রতিবেদন 

রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেন, ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। এখন দেশের মানুষ মনে করে নির্বাচন কেন্দ্রিক সংস্কার দ্রুত শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের। সে জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপও ঘোষণা চায় বক্তারা।  বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ’৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রুপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী ও চিকিৎসক ও আইনজীবী ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, ভারত, জাপান, সৌদি আরব, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২৮ দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।

 সেমিনারের সভাপতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাগত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কেন লেখা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়। আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে আছি। আমাদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘাড়ে বসে থাকা ফাসিবাদকে সরাতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমরা সংস্কারের বিষয়টি জাতির কাছে আগেই তুলে ধরেছি। যুগপৎ আন্দোলন শরিক দলগুলো ঐক্যমত হয়ে ৩১ দফা দিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, ঐক্যবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সফলতা অর্জন করতে পারব।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচিতে যা যা বলা হয়েছে, তার সাথে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। ৩১ দফায় দুই ধরনের সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। একটা হচ্ছে - সংবিধান সংক্রান্ত, আরেকটি হচ্ছে দেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত। 

৩১ দফার বাইরেও বেশ কিছু সুপারেশ করেন মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতি কী হবে। গত ৫৩-৫৪ বছরে সংবিধানের মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু মূলভিত্তি ফাংশনাল হয়নি। ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক তর্ক আছে, অনেক ধরনের উপলব্দি আছে। তাই আমার সুপারিশ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ঘোষণায় যে নীতিগুলো ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ইনসাফ, ন্যায্যতা-এইগুলো হওয়া উচিত সংবিধানের মূলনীতি। দ্বিতীয়ত, সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের একটা ব্যাপার আছে-এটাকে নিয়েও আপনাদের চিন্তা করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম আছে। আমাদের সংবিধানেও আছে। রাজনৈতিক সুবিধা ও ফায়দা লুটার জন্য হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেছিলেন। এই নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে সরিয়ে দিতে সাহস দেখাইনি। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শ কাতর। এটা নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা হওয়া উচিত।

বাংলাদেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করার যে আলোচনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ বিভিন্ন সময়ে করে থাকেন তার বিরোধীতা করেন মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, কারণ, আমাদের পাশে রয়েছে ভারত। ভারত হচ্ছে আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। বিগত তিন মাসে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মিডিয়া ও দেশটির নেতৃবৃন্দ যেসব কথা বলেছেন সবগুলো আগ্রাসী। তাদের নিরাপত্তা চিন্তক যারা তারা বলেন, সেভেন সিস্টারে তাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং রংপুরকে বিচ্ছিন্ন করে এর মধ্যদিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হবে। ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে বেশ তৎপর। এ সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে হলে আমরা কখনো প্রদেশ গঠনের চিন্তা করতে পারি না।

বাংলাদেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হোক এমন কোনো সংস্কার আমরা করতে পারি না বলেও মন্তব্য করেন মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, প্রদেশ গঠন নয়, স্থানীয় সরকারকে সক্রিয় করা, তাদের ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ি এলাকার উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। সেখানকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে সেজন্য এই সংস্কারের মধ্যে ব্যবস্থা রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে আছে বন্ধু রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে না। এটাকে এখন উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কারণ আমরা এখন কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। 

এবি পার্টির ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফার প্রত্যেকটি দফার পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক তর্ক জারি থাকা উচিত। রাজনৈতিক দলের কাঠামো সংস্কার নিয়েও আমাদের আলাপ তোলা দরকার। 

জাতীয়তাবাদী সমমনা দলের প্রধান সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেছেন, ৩১ দফা বাস্তবায়ন করতে হলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার।  

লেবারপার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, যে বিষয়গুলো মীমাংসিত যেমন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহি রহমানের রহিম-এ গুলো নিয়ে যেন আমরা প্রশ্ন না তুলি। 

৩১ দফা সংস্কার প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু সংখ্যালঘু যারা-তাদের প্রতিনিধিত্বটা সংসদে, রাষ্ট্রে, সমাজের নানা স্তরে কিভাবে হবে তা গভীর মনোযোগ দাবি করে। তিনি বলেন, ৩১ দফায় কোন দল বা ব্যক্তি ক্ষমতায় যাওয়ার পরে স্বেচ্ছাচারি হয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ন আলোচনা আমরা হাজির করেছি। 

সাইফুল হক বলেন, গত ১৬ বছর ছিল বিচার বিভাগকে দমন করার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই বিচার বিভাগকে  পরিবর্তন করে তার একটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের খুবই গুরুত্ব এজেন্ডা ৩১ দফার ভেতরে সুনির্দিষ্টভাবে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রের যৌক্তিক ও আনুপাতিক হারে নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়নী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে এবং সবগুলো মিলে একটা ইন্ডিপেন্ডেটস সবরিন ন্যাশনস স্ট্রেট-এই জায়গা    

জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ৩১ দফায় সবকিছু চমৎকারভাবে লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের উন্নয়ন, শিল্পের বিকাশ, সামাজিক উৎকর্ষতা সব কিছু আছে। এর গ্রান্টি ক্লোজ কোথায়? কেন এগুলো বারবার ব্যাহত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তার বাংলাদেশ সফরের (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে) মধ্যদিয়ে তথাকথিত নির্বাচন এবং নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে শাসন চালিয়ে গেছে, সমোস্ত উন্নয়ন, সমোস্ত পরিকল্পনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে গেছে, তা ৩১ দফায় পর্যপ্ত বলা নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব সবচেয়ে বড় কথা,আমাদের সমোস্ত উন্নয়ন বা দাবি নামাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে; তা সন্নিবেশিত করা, অগ্রাধিকার দিতে হবে।  

আওয়ামী নেই,বিএনপি-ই ক্ষমতায় আসবে উল্লেখ করে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপিকে বলব, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েন না, যেটা আপনারা করতে পারবেন না।

সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে মান্না বলেন, অনেকেই বলেন, সংস্কার শেষ করে তার পরে ভোট। আমার মনে হয় জিজ্ঞাস করি, ভাই এটার শেষ কোথায়? কী হলে শেষ? আপনি বলতে পারেন সংস্কার এতদূর পর্যন্ত আমার দরকার। আমি লড়াই করেছি ১৫ বছর, আমার ভোট নেই, বাঁচার অধিকার নেই। রক্তের মধ্যদিয়ে শ্লোগান উঠছে  নতুন বাংলাদেশ চাই। তাই যদি চান, তাহলে দেশে গণতন্ত্র লাগবে। ভোট লাগবে- এমন ভোট যেটা সবাই গ্রহণ করতে পারবে। সেই ধরনের ভোট করার জন্য ন্যূনতম পরিবেশ লাগবে। লাগবে লেভেল প্লেলিং ফিল্ড। সেই ফিল্ড তৈরী করতে হলে পুলিশ, আমলা এবং নির্বাচন কমিশন ঠিক করতে হবে। খুব দ্রুত ভোট দরকার। 

তিনি আরো বলেন, বিএনপি যখন বলে নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই। অনেকে বুঝে আবার বুঝে না। সংস্কার করতে সরকারের কতদিন লাগবে, সেটা সরকারকে বলতে হবে। সে হিসেবে বিএনপি যখন রোডম্যাপ চায়, তখন রোডম্যাপ চাওয়াটা খুবই যৌক্তিক। বিএনপিকে বলতে হবে, তুমি যদি রোডম্যাপ না দাও, তোমরা কি অনন্তকাল থাকবে নাকি?        

সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ হচ্ছে, আমাদের ৩১ দফা, এটি জাতির সনদ হিসেবে গণ্য করা যায়। জাতীয় ঐক্যমত এবং জাতির ধারক ও বাহক বলা যায়। এটি শেষ দফা নয়, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে এটিতে সংযুক্ত বা বিয়োজন হতে পারে।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের দিন বদলের কর্মসূচি দেয়। তবে এটিতে সাধারণ মানুষের কোনো ভাগ্য বা দিন বদলের পরিবর্তন আসে না। পরিবর্তন আসে ওই রাজনীতি নেতাদের। তাই বলছি, মানুষের ভাগ্যের সাথে ৫ আগস্টের যে আকাঙ্খা সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপি'র ৩১ দফায় শেষ নয়, সময়ের সাথে সাথে আরো যেন যুক্ত করতে পারি সে বিষয়টি রাখতে হবে।

বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিনের পরিচালনায় সেমিনারে আরো বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর রফিকুল ইসলাম খান, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও অ্যাডভোকেট এলিনা খান প্রমুখ।

এই সেমিনারে আরো ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আফরোজা খান রীতা, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীম প্রমুখ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম