স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার নিষিদ্ধ হওয়ার ৫০ বছরের বেশি সময় পরে আবার নিষিদ্ধ হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। যদিও গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময় দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে কখনোই কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় জামায়াতের কিছু নেতাকর্মী কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেও দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল বহু বছর।
পরে ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আই.ডি.এল) নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামী তৎপরতা শুরু করে। যদিও রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় হতে শুরু করে আরো তিন বছর পরে।
নয়া দিগন্ত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর বিবিসি বাংলাকে বলেন, নিষিদ্ধ থাকার সময়ে এই দলের নেতারা অনেকে আটক বা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলো। আর যারা বাইরে ছিলেন তারা আইডিএলে সম্পৃক্ত থেকে সংগঠন গুছিয়েছেন। ১৯৭৯ সালে জামায়াত ইসলামী সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে আরও সুসংগঠিত হতে পেরেছে কারণ তারা ক্যাডার ভিত্তিক দল বলে নেতারা যেভাবে বলে কর্মীরা সেভাবেই অ্যাক্ট করে।
জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আইডিএল- এর ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর ছয় জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে অনেকেই মনে করেন, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য কিংবা নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এলেও ১৯৭৯ সালে সক্রিয় হবার ৪০ বছর পর এসে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে চরম কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি এবং শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন হারিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে।
তবে এ সময়েও সামাজিক যোগাযোগ এবং অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার কাজটি করে গেছে জামায়াত।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তান আমলেও এই দলটি কয়েকবার নিষিদ্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েছিল।
জামায়াতের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ আমলে
দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু হয়েছিলো মূলত ব্রিটিশ আমলে। সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে পরের বছরেই এর সদর দপ্তর লাহোর থেকে নেওয়া হয় ভারতের পাঠানকোটে।
ধর্মের কথা বলা হলেও অনেকেই মনে করেন মূলত ভারতের কমিউনিজম বিরোধী শক্তি হিসেবেই এ সংগঠনটির জন্ম হয়েছিলো এবং তখনকার ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যও তারা পেয়েছিলো।
১৯৪৫ সালে এর প্রথম কনভেনশন হয় অবিভক্ত ভারতে এবং এর দু’বছর পর দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই সংগঠনটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলো।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত দুই বার নিষিদ্ধ
১৯৪৮ সালে ইসলামি সংবিধানের দাবিতে প্রচারণা শুরু করলে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে গ্রেফতার করে। তবে ওই বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও জামায়াতের কার্যক্রম শুরু হয়। দুবছর পর মওদুদী জেল থেকে ছাড়া পান।
এর মধ্যেই নেতা হিসেবে উঠে আসেন গোলাম আজম এবং ১৯৫৭ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন।
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ১৯৫৮ সালে অন্য সব দলের সঙ্গে জামায়াতের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেন তখনকার সেনা শাসক আইয়ুব খান।
এরপর মুসলিম পারিবারিক আইন ও শিক্ষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয় দলটি। বিশেষ করে মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে তুমুল সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতাও তৈরি হয় তখন এবং সেজন্য জামায়াতকেও দায়ী করেন অনেকে।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে আবার নিষিদ্ধ করা হয়। মওদুদী ও গোলাম আজমসহ অনেককে আটক করা হয়। সে বছরের শেষ দিকে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৫১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে চারটি আসন পায় দলটি।
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা ও স্বাধীন দেশে নিষিদ্ধ
জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে এবং এর নেতারাও সক্রিয়ভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। তখন পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
এই দলটির নেতৃত্বেই রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী হয়েছিলো যারা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ যুদ্ধকালীন গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য তীব্রভাবে সমালোচিত। ১৯৭২ সালে লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন গোলাম আজম।
বাংলাদেশের বিরোধিতা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য ১৯৭৩ সালে যে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব সরকার বাতিল করেছিলো গোলাম আজমও ছিলেন তার একজন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের বাইরে থাকা জামায়াত নেতারা আবার দেশে ফিরতে শুরু করেন।
১৯৭৬ সালে গোলাম আজম নাগরিকত্ব ফেরতের জন্য আবেদন করলেও সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। এরপর আর ফিরে যাননি।
১৯৭৯ সালে ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। সেখানে গোলাম আজমকে অনেকটা গোপনে আমির করে প্রকাশ্যে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির ঘোষণা করা হয়।
এরপরের বছর ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের সামনে জামায়াতের প্রথম প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে দলটি এবং নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় হয়ে ওঠে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির।
১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দশটি আসন পায় তারা। পরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে জামায়াতও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়।
তবে তাদের বড় সাফল্য আসে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। সেবার ১৮ আসন জিতে তারা এবং তাদের সমর্থনেই সরকার গঠন করে বিএনপি।
অবশেষে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির, প্রজ্ঞাপন জারি
এরপর থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আবার তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে দেশে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গণআদালত হয় সেখানে গোলাম আজমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। এরপর দলটি বেশ কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে।
তবে ১৯৯৪ সালে আদালতের রায়ে নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আজম, জামায়াতও দল হিসেবে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের যখন আন্দোলন চলছিলো, তখন জামায়াতও আলাদাভাবে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ১৯৯৯ সালে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট করে জামায়াত, যার নাম হয় চারদলীয় জোট।
সরকারে আসা ও পরে বিপাকে পড়ে নাম বদল
গোলাম আজম ২০০০ সালে অবসর নিলে দলটির শীর্ষ পদে আসেন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় গেলে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই জামায়াতের প্রথম সরকারে অংশগ্রহণ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াত। ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। এরপর তারা আর কোনো ভোটে অংশ নিতে পারেনি। ওই বছর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় দলের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। এর আগে থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় দলটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা আটক হলে বেশ চাপের মুখে পড়ে দলটি।
ওই বছরেই সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্ট। পরে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে দলটি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজা খাটা অবস্থায় ২০১৪ সালের অক্টোবরে মারা যান গোলাম আজম। এ সময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার নব্বই বছরের সাজা হয়েছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়।
একই ধরনের মামলায় ২০১৫ সালে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের এবং ২০১৬ সালে আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হলে চরম বিপাকে পড়ে দলটি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দলটির আপিল আবেদন খারিজ করে দেয়। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ই বহাল থাকে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩১শে জুলাই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো সরকার। এ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে দলটি দ্বিতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হলো।