সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন
ফোরামের নিষেধ: সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে যা বললেন ব্যারিস্টার খোকন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:০৭ পিএম
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ নির্বাচনে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্যানেল নীল দল থেকে সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারিস্টার এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন। এই প্যানেল থেকে তিনিসহ মোট চারজন নির্বাচিত হয়েছেন।
এই চারজনকে দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম বুধবার চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে সই করেছেন ফোরামের সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী এবং মহাসচিব ও বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। এ চিঠির অনুলিপি দলটির মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে।
এই চিঠি দেওয়ার পর ব্যারিস্টার খোকনের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া না নেওয়া নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের একটি অংশ মনে করছেন, দলীয় ফোরামের চিঠির প্রতি সম্মান রেখে মাহবুবউদ্দিন খোকন সভাপতির দায়িত্ব নেবেন না। কারণ এই নির্বাচন বিতর্কিত। নির্বাচনে বিএনপিপন্থি প্যানেলের জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন কি না সে বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন; যিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদেও রয়েছেন।
মাহবুবউদ্দিন খোকন বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আইনজীবীরা আমাকে ভোট দিয়ে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। ভোটারদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম আমাকে প্রার্থী করেছে। আমি তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। ফোরাম থেকে দুটি কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে- আইনজীবী সমিতির পুনর্নির্বাচন, অপরটি হচ্ছে ভোট ডাকাতির এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচিত চারজনের শপথ না নেওয়া। আমি একটি বিষয়ে পুরোপুরি একমত, সেটি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পুনর্নির্বাচন। আমি নির্বাচনের দিন থেকেই বলে আসছি এটা কোনো ভোট হয়নি। বার নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। সঠিক ভোট হলে আমাদের প্যানেলের ১২ জন জয়ী হতেন। সুতরাং বারে পুনর্নির্বাচন হতে হবে।
ফোরামের চিঠি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে এর আগে বার বার সম্পাদক পদে নির্বাচিত এই আইনজীবী বলেন, আইনজীবীরা তো আমাকে সভাপতি পদে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমি তাদের দাবিগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করব। দায়িত্ব নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারে যে নেক্কারজনক কারচুপির নির্বাচন হয়েছে সেটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব। আওয়ামী লীগ ও তাদের নিযুক্ত প্রশাসনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সেটি প্রমাণে সোচ্চার থাকব।
আপনার দল বিএনপি থেকে দায়িত্ব না নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আছে কি না-এমন প্রশ্নে ব্যারিস্টার খোকন বলেন, না, দল থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
আইনজীবী ফোরামের চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, চিঠিটি আমি পাইনি, তবে শুনেছি। আর চিঠিটি সম্ভবত দিয়েছে এই কারণে যে, আপনারা জানেন- এই নির্বাচনটায় অনেক কলঙ্ক ছড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এবারই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভোট গণনার আগে সরকারি দলের লোকজন ব্যালট বাক্স লুটপাট করে নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে সেই ব্যালট বাক্স পুলিশ উদ্ধার করেছে, আবার সুপ্রিম কোর্টে ফিরিয়ে আনছে।
এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, এখানে যদি সুষ্ঠু ভোট গণনা হতো তাহলে জাল-জালিয়াতি যা করেছে বা অবৈধভাবে ভোট ঢুকিয়েছে, তারপরও আমি দেড় থেকে দুই হাজার ভোটে জিততাম। শুধু আমি নয়, প্রথম যে ১২শ’ ভোট গণনা হচ্ছিল সেখানে আমাদের ১৩ জন এগিয়ে ছিল। পরবর্তীতে ডিএজি-এজিরা ভোট গণনার সময়, কল করার সময় তারা জালিয়াতি করেছে। আমি শেষে এসেছি, আসার পর ১২শ’ ভোটের মধ্যে আমারটা রক্ষা হয়েছে।
তিনি বলেন, এটা একটা বিশাল ষড়যন্ত্র ছিল। তারপরও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ভোট দিয়েছে, আমি নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচিত হয়ে আমি কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম যে, আমরা পুনর্নির্বাচন চাই। এর আগে আমরা একটা দরখাস্তও দিয়েছিলাম ঘোষণার আগে যে, পুনরায় ভোট গণনা চাই, সেটা অ্যালাউ করে নাই। সুতরাং আমার সভাপতি পদসহ পুনর্নির্বাচন চাই। কারণ, আমি কমপক্ষে দেড় হাজার ভোটে জয়ী হওয়ার কথা ছিল। আমার প্যানেলের কমপক্ষে ১২ জন এগিয়ে ছিল। তারা কিন্তু কারচুপি করে গদি তারা নিয়ে গেছে।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, আমাদের দল থেকেও আমরা বলেছিলাম যে, পুনর্নির্বাচন চাই। আমরা পুনর্নির্বাচনের দাবিতে অটল। পুনর্নির্বাচন হলে আমরা মেনে নেবো। আমার সভাপতি পদেও আমি পুনর্নির্বাচন চাই। আমরা অপেক্ষা করছি সিদ্ধান্তের আগে। ফল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করবে ২ তারিখে জেনারেল মিটিংয়ে। পুনর্নির্বাচন হলে আমরা খুব খুশি হবো, আইনজীবীরাও খুশি হবে। সম্ভবত এ জন্যই চিঠিটা দেওয়া হয়েছে।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, এবারের নির্বাচনে ফোরামের শক্তিশালী একজন নেতার আচরণ ছিল রহস্যজনক। তিনি পুনঃভোট গণনার বিপক্ষে ছিলেন। আমরা তার সম্পর্কে অনেক গুজব শুনে যাচ্ছি। খুব ইমপর্টেন্ট, শক্তিশালী নেতা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার আঁতাত ছিল কিনা- এ ব্যাপারে আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে খুব গুজব আছে। আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি এ ব্যাপারে কি করা যায়।’
তবে ওই নেতা কে, তার নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান ব্যারিস্টার খোকন।
সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি প্যানেল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে আমি কতবার নির্বাচিত হয়েছি, আমার পরাজয়ের কোনো ইতিহাস নাই। কে কি বললো না বলবো ইট ডাজন্ট ম্যাটার। আমার প্যানেল জিততো, মেজরিটিতে। সেখানে মেজরিটি পেলাম না, এই ভুল সিদ্ধান্ত বা আওয়ামী লীগের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আর সমিতি চিঠি দিয়েছে যে আমরা এখনো পুনর্নির্বাচনের দাবিতে অটল আছি, দেখা যাক পুনর্নির্বাচন দেয় কিনা।
দায়িত্ব না নেওয়া সংক্রান্ত সংগঠনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত, দায়িত্ব নেওয়া বা না নেওয়ার কী আছে?’
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র কেন্দ্রীয় নেতা, উপদেষ্টামণ্ডলী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিগত ৬ ও ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের পর গত ১০মার্চ ঘোষিত ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ন্যায়সংগত যৌক্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, এই মর্মে জানানো যাচ্ছে যে, আপনারা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ মেয়াদকালের দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। দলের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে দলীয় এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পালন করবেন।’
প্রসঙ্গত, এবারের নির্বাচনে ১৪টি পদের বিপরীতে সভাপতিসহ চারটি পদে বিজয়ী হয় বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল। অপরদিকে সম্পাদকসহ ১০টি পদে বিজয়ী হয়েছে সরকার সমর্থিত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। গত ৬ ও ৭ মার্চ নির্বাচন শেষে ৯ মার্চ দিবাগত রাতে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করেন নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল হিসেবে পরিচিত) বিজয়ী হচ্ছেন- সভাপতি পদে এ এম মাহবুব উদ্দিন (খোকন) এবং সদস্য পদে সৈয়দ ফজলে এলাহী, ফাতিমা আক্তার ও মো. শফিকুল ইসলাম শফিক।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ (সাদা প্যানেল হিসেবে পরিচিত) বিজয়ীরা হচ্ছেন- সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক, সহ-সভাপতি পদে রমজান আলী শিকদার ও দেওয়ান মো. আবু ওবাঈদ হোসেন সেতু, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী, সহ-সম্পাদক পদে মো. হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ হুমায়ন কবির। সদস্য পদে মো. বেলাল হোসেন শাহীন, খালেদ মোশাররফ রিপন, মো. রায়হান রনি ও রাশেদুল হক খোকন।
নির্বাচনে এই দুই প্যানেল ছাড়াও সভাপতি পদে মো. ইউনুছ আলী আকন্দ ও মো. খলিলুর রহমান বাবলু (এম কে রহমান) এবং সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানা যুথি ও ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া এবং মো. সাইফুল ইসলাম কোষাধ্যক্ষ পদে প্রার্থী হয়েছিলেন।