নৌকায় ভোট দিন উন্নয়ন দেব: শেখ হাসিনা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:০০ পিএম
দলের নির্বাচনি ইশতেহারে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ গড়ার অঙ্গীকার করে আবারও নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি দেব।
বুধবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত ক্ষমতাসীন দলের এবারের ইশতেহারের স্লোগান, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। এ ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঘোষিত ইশতেহারে জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গঠন এবং গণতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিগত ১৫ বছরের সরকার পরিচালনার পথপরিক্রমায় যা কিছু ভুল-ত্রুটি, তার দায়ভার আমার। সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাদের। আমাদের ভুল-ক্রটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমরা কথা দিচ্ছি, অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব। তিনি বলেন, বাবা-মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছি শুধু আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ শেষ করে এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। এ কাজ করতে গিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। কিন্তু বাবার কথা ভেবে, আপনাদের কথা ভেবে আমি পিছপা হইনি।
আ.লীগই পারবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিতে: শেখ হাসিনা বলেন, যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন, সুস্থ রাখেন, ততদিন যা কর্তব্য হিসাবে আমি গ্রহণ করেছি, সেখান থেকে সরে আসব না। আপনাদের সেবক হিসাবে কাজ করার মধ্য দিয়েই আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিতে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এ উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা থাকতে হবে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এ দেশের যা কিছু মহৎ অর্জন, তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, নাগরিকমুখী, কল্যাণমূলক দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ার মাধ্যমে জনগণকে উন্নত সেবা দেওয়া এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারবদ্ধ। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ, উদ্যোগী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক প্রশাসন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বাঙালিদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি: ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাঙালিদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আমরা রূপকল্প-২০২১-এর ঘোষণা দিয়েছিলাম। দিনবদলের সনদ হিসাবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করি। এরপর শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ২০১৪ ও ২০১৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আমরা সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছি। অনুষ্ঠানে মাথাপিছু আয়, জিডিপি ও বাজেটের আকার, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে সরকারের অর্জনগুলো তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে: শেখ হাসিনা বলেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সব সময়ই যে আমরা শতভাগ সফল হয়েছি, এমন দাবি করব না। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা যা বলি, তা বাস্তবায়ন করি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়নবিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। সফল না হলে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধ স্পৃহায়। অগ্নিসন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দি করতে চায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার ওপর এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে।
সন্ত্রাস করে নির্বাচন বানচালের স্বপ্ন পূরণ হবে না: শেখ হাসিনা আরও বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট পাবে না এটা বুঝতে পেরে আগে থেকে এবার তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহন পোড়ানো, মানুষ হত্যা, রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। মা ও শিশুর অগ্নিদগ্ধ লাশ সবার বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের হীন কাজ আর সহ্য করা যায় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জনগণের সাড়া না পেয়ে ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে এসব নাশকতা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করছে। সন্ত্রাস করে নির্বাচন বানচাল করার স্বপ্ন-সাধ কোনোদিনই তাদের পূরণ হতে দেবে না এ দেশের জনগণ। সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩-১৬ সময়ে যেমন আপনারা ওদের প্রতিহত করেছিলেন; আসুন, এবারও সম্মিলিতভাবে ওদের প্রতিহত করি। স্বাধীনতাবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী এ শকুনের দল আর কোনোদিন যাতে বিষময় দন্ত-নখর বসিয়ে দেশকে ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে, আসুন, এই বিজয়ের মাসে এ শপথ নিই।
ছোটখাটো অভিঘাত আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকের বাংলাদেশ দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। সম্ভাবনার হাতছানি দেওয়া দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা দুরন্ত বাংলাদেশ। ছোটখাটো অভিঘাত আজ আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। করোনা মহামারিসহ নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে সেই প্রমাণ আমরা রেখেছি।
এর আগে সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার ছাপযুক্ত শাড়ি পরে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ কমিটির সদস্যরা তাকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে পৌঁছানোর পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
এরপর ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক স্বাগত বক্তব্য দেন। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ইশতেহার ঘোষণার আগে সরকারের উন্নয়ন চিত্র এবং বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার জীবনী নিয়ে দুটি ভিডিও ডকুমেন্ট দেখানো হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ-সদস্য, শিক্ষাবিদ, সিনিয়র সাংবাদিক, ইমাম, শিক্ষার্থী, কৃষক, হকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, বিদেশি কূটনৈতিক ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে: আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে আমাদের নির্বাচন করতে হবে। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হন্তান্তর করেনি। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা হন্তান্তর করবে নির্বাচিত সরকারের হাতে, আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এ আগুন সন্ত্রাস জ্বালাও-পোড়াও বারবার দেখেছি। এসব ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস মোকাবিলা করেই আমরা লাল-সবুজের পতাকা হাতে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাব ইনশাআল্লাহ। সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ হাসিনা আমাদের কাছে একজন ‘ইন্সপায়ারিং লিডার’। বাংলাদেশে গত ৪৮ বছরে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে সাহসী নেতার নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে দক্ষ প্রশাসকের নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে সবচেয়ে সফল ডিপ্লোমেটিকের নাম শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, আইআরআই তাদের গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে। আমরা ভয় পাব কাকে? আমাদের জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।
উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যে এই ইশতেহার: সূচনা বক্তব্যে ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ইশতেহার প্রণয়নে আমরা সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিয়েছি। তাদের সুপারিশ ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়েছি। তিনি বলেন, গত দেড় দশকে সব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। উন্নত বাংলাদেশ স্থাপনে এটাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায় সে লক্ষ্যে এই ইশতেহার।
ড. রাজ্জাক বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামী লীগ। এ সাফল্য দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে অঙ্গীকারের দলিল হিসাবে আমরা নির্বাচনের ইশতেহার প্রণয়ন করেছি। আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, এবার আমাদের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। এই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ সমাজের দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি আমাদের মূল লক্ষ্য।