বিএনপির একদফা আন্দোলন: নেতৃত্বে এবার মাঠ পর্যায়ের নেতারা
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫৫ পিএম
একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনকে আরও বেগবান করে কৌশলে সাফল্য পেতে চায় বিএনপি। এজন্য কর্মসূচি সফলে এবার নেতৃত্বে রাখা হয়েছে তৃণমূল (মাঠ পর্যায়ে) নেতাদের। ইতোমধ্যে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের কোনো নেতা গ্রেফতার হলেই পরবর্তী নেতাকে দেওয়া হচ্ছে দায়িত্ব। প্রতিদিন অন্তত অর্ধশতাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন হাইকমান্ড। নিষ্ক্রিয় নেতাদেরও সক্রিয় করা হচ্ছে। চলমান অবরোধ কর্মসূচিতে পর্যায়ক্রমে একেকটি সাংগঠনিক জেলাকে নামানো হচ্ছে মাঠে।
তফশিল ঘোষণার পর নেতাকর্মীদের ‘অলআউট’ নামার পরিকল্পনা রয়েছে। সারা দেশ থেকে ঢাকাকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চায় দলটি। এজন্য জেলা-মহানগর এবং গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় অবরোধ আরও জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতাদের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, সরকার আবারও একতরফা সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে চক্রান্ত শুরু করেছে। তবে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ে সংকল্পবদ্ধ। অচিরেই এই অবৈধ সরকারের পতন হবে। বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করা যাবে না। কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সর্বশেষ ব্যক্তিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।
সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে। এমনকি নিজ বাসা ও ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়ের বাসায়ও রাতে অবস্থান না করতে নির্দেশনা রয়েছে। একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তফশিলের আগে ও পরে এবং ভোট পর্যন্ত-তিন ধাপের কঠোর কর্মসূচি কী হবে তা আগেই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছে। তবে তফশিলের পর টানা কর্মসূচি চলবে। সে কর্মসূচি হবে আরও কঠোর। এতে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই মাঠে থাকবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সহসম্পাদক ও জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছি না। প্রথমত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকনির্দেশনায় ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মী ও সমর্থকরা একদফা আন্দোলনে শামিল আছে। ইতোমধ্যে দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের বহুসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে চলমান যে আন্দোলন, তাতে মোটেই ভাটা পড়েনি। বরং গ্রেফতার-নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনমুখিতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যাবে-এজন্য নেতাকর্মীরা বদ্ধপরিকর।
কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, নির্বাচন ঘিরে বিএনপিকে ভাঙতে নানামুখী তৎপরতা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। এক্ষেত্রে কোনো কোনো নেতাকে প্রলোভনসহ নানা ধরনের সুবিধার কথা বলা হতে পারে। তবে দলের মধ্যে ভাঙনের ষড়যন্ত্র ও পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। বরং একদফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকেই মনোযোগ তাদের।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন যুগান্তরকে বলেন, যত নির্যাতন-নিপীড়ন আসুক বিএনপির নেতৃত্বের কোনো সংকট হবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই চলছে দল। তার নির্দেশে তৃণমূলের নেতারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সব নেতাকর্মী এখন ঐক্যবদ্ধ।
সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর নিয়ে বিশেষ কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে আন্দোলন জোরদার করতে বিভিন্ন জোনে ভাগ করেছে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ। প্রতিটি জোনে কেন্দ্রীয় ও মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এসব জোনের ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের (কেন্দ্রীয় নেতা) তাদের নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন জোরদার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, তাকে ঢাকা মহানগরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নির্বাচনি এলাকার নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে বলা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে তিনি তার সংসদীয় এলাকায় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন। একই কথা জানিয়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের একজন সাবেক সংসদ সদস্যও। তিনি বলেন, তাকে নির্বাচনি এলাকার আন্দোলন জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, অবরোধ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এ কাজটি সফলভাবে করতে হলে জেলা পর্যায়ে আন্দোলন তীব্র হতে হবে। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ের সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচল এবং যেসব এলাকায় ট্রেন রয়েছে তা চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়টির ওপর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নজর দিচ্ছেন বেশি।
ওই স্থায়ী কমিটির সদস্য আরও বলেন, কঠোর কর্মসূচি থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ বা পথ নেই তাদের। অবরোধের বিকল্প হিসাবে হরতাল ছাড়া ভিন্ন কোনো কর্মসূচি এখনো খুঁজে পাননি। অধিকাংশ নেতা ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের মধ্যে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তফশিলের পর টানা হরতাল ও অবরোধ একই সঙ্গে পালনের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ পণ্ডের পরদিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জামায়াতে ইসলামী। পরে একই দাবিতে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর-তিন দিন দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ, দ্বিতীয় দফায় ৫ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে তারা। তৃতীয় দফায় বুধবার ভোর ৬টা থেকে আবারও দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি চলছে, যা কাল শুক্রবার ভোর ৬টায় শেষ হবে।