যেভাবে সরাসরি রাজনীতি থেকে ইতি ঘটে সিরাজুল আলম খানের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৩, ০৬:১২ পিএম
সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের শেষ ৪০ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও ছিলেন প্রাদপ্রদীপের আলোয়। তাকে নিয়ে আগ্রহ দেখাতেন প্রায় সবাই। সরাসরি রাজনীতি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন এই তাত্ত্বিক।
দাদাভাই নামে পরিচিত বাংলাদেশেল রাজনীতির এই রহস্য পুরুষ আজ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সহযোদ্ধাদের মধ্যে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের পরিচিতি 'তাত্ত্বিক নেতা' হিসেবে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। আবার শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে জাসদ গড়ে তোলা এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনীতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের মতো ইতিহাসের নানা টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহের সাথেও উঠে আসে সিরাজুল আলম খানের নাম। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না রেখেও কিভাবে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির একজন নেপথ্য নিয়ন্ত্রকে।
পাকিস্তান বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বহু ঘটনার নেপথ্য নায়কদের একজন হয়েও নিজে কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে তার রাজনীতির হাতেখড়ি।
৬৬ থেকে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর মূলত তিনিই ছিলেন ক্যাটালিস্ট। ৭০ এ জেল থেকে বেরিয়ে শেখ মুজিব জাতীয় নেতা হলেন তবে যে সাংগঠনিক বিস্তৃতি হলো তার মূল নায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তার এক ধরণের বলয় তৈরি হয়েছিলো তাকে কেন্দ্র করে। তারা স্বাধীনতার কথাও বলতেন সমাজতন্ত্রের কথাও বলতেন। এ নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে বিবাদ হয়। শেখ মুজিব সিরাজুল আলমসহ তার আস্থাভাজনদের নিয়ে বিএলএফ গঠন করেছিলেন যাতে আরও শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ।
পরবর্তীতে শেখ মনির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে জাসদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সিরাজুল। পরে সরকার পরিচালনা নিয়েও শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে মতবিরোধ হয় তার। এর ফলে সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীরাই একটা সময় হয়ে উঠেন দেশের প্রধান বিরোধী দল।
তবে নিজের কাজের স্মৃতিচারণ করে বলা একটি বইয়ে সিরাজুল আলম খান বলেছেন ছাত্র জীবনে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবার মুক্তি সংগ্রাম কিংবা আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন বা ভিয়েতনামের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম তাকে আলোড়িত করেছিলো দারুণ ভাবে।
পনের আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনার সময় ভারতে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার তৎপরতার অবসান হয় আরও পরে মূলত জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র চলে আসা ও ৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে।
ওই বছরেই ২৬ নভেম্বর আটক হয়ে পাঁচ বছর জেল খাটেন সিরাজুল আলম খান। ৮১ সালে ১ মে মুক্তি পেয়ে লন্ডন চলে যান রাজনীতির রহস্যপুরষ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে তার সরাসরি জড়িত থাকার আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটে সেখানেই।
আর এর মধ্যেই কয়েক খণ্ডে পরিণত হয় তার রাজনৈতিক চিন্তার সর্বশেষ ফসল জাসদ।
সবমিলিয়ে গত ৪০ বছর নিজেকে রাজনীতি থেকে আড়ালে রাখেন সিরাজুল। দীর্ঘদিন আমেরিকায় বসবাস করেন। সেখান থেকে দেশে আসলে রাজনৈতিক সহচররা তার কাছে বারবার গেছেন। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় হননি। রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথাও বলেননি।