স্বজনহারাদের সহানুভূতি না জানিয়ে দেশে আনন্দ ফুর্তি চলছে: জিএম কাদের
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৬:৩৮ পিএম
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় দেশের মানুষ শোকাহত। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের আহাজারি চলছে। স্বজনহারাদের প্রতি সহানুভূতি না জানিয়ে দেশে আনন্দ ফুর্তি চলছে। দেশের একদিকে আহাজারি অন্যদিকে আনন্দ ফুর্তি।
জি এম কাদের বলেন, যখন হাসপাতালের বেডে দ্বগ্ধ মানুষ অসহনীয় কষ্টে কাতরাচ্ছেন, তখন রাজনৈতিক নেতারা এটা নিয়ে একে-অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপের রাজনীতি শুরু করছে। দুর্ঘটনা ঘটলেই দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিরোধী পক্ষ আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নাশকতা করছে কিনা-তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি নাশকতা হয়েই থাকে, তাহলে সরকার নাশকতা ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। নাশকতা ঠেকাতে যারা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
বৃহস্পতিবার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয় মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতীয় মহিলা পার্টি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জি এম কাদের এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও জাতীয় মহিলা পার্টির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি।
সভায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে না পারলে রাষ্ট্র তো শোক প্রকাশ করতে পারে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে স্বজনহারাদের প্রতি সহানুভ‚তিটুকু জানানো যেত।
এখন ব্যর্থতা ঘোচাতে অপরকে দোষারোপ করা হচ্ছে। আমরা নিহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, যারা ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না। যাদের ব্যর্থতা, অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতির কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে শিক্ষা নিতে হয়, যাতে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কেউ জানে না। তদন্ত কমিটি কী সুপারিশ করলো কেউ জানে না।
জিএম কাদের বলেন, দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী বা দায়ীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে-তা কেউ জানতে পারে না। এখন সব কিছুতেই গলদ। ভবন তৈরি হয় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। গ্যাসের লাইন বৈধ না অবৈধ তার ঠিক নেই। এগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে যারা, তাদের খোঁজ নেই। এত বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে কিন্তু কারণ উদঘটনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর হতে পারে না।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, নারী-পুরুষের বৈষম্য স্বাভাবিকভাবেই দূর হয়ে যাচ্ছে। তবে সবার আগে দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষমতার বৈষম্য দূর করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে।
দেশের মানুষের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতা এখন একটি গোষ্ঠী বা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা থাকলেই অধিকার নিশ্চিত হয়। দেশের মানুষের হাত থেকে ক্রমেই ক্ষমতা দূরে সরে যাচ্ছে। তাই দেশের মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।
জিএম কাদের বলেন, ১৯৭১ সালে দেশের মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তি চেয়েছিল। মুক্তির জন্য দেশের মানুষ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, ভূখণ্ড পেয়েছি এবং একটি সংবিধান পেয়েছি। কিন্তু, সেই সংবিধানে যা লেখা ছিলো তা থেকে আমরা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেছি।
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হলে আগে ক্ষমতার বৈষম্য দূর করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে পারলেই দেশ থেকে বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ক্ষমতার বৈষম্য কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে এক শ্রেণির মানুষ ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে। আর দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। এক শ্রেণি এত ধনী হচ্ছে যে তারা দরিদ্রদের চিনতেই পারছেন না। সাধারণ মানুষের কাছে অধিকার বলতে কিছুই নেই। নাগরিক হিসেবে মানুষের যে অধিকার থাকার কথা ছিলো তা এখন আর নেই। মানুষকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, নারীদের ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, দেশের সব উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। আন্দোলন সংগ্রামে নারীদের আরো এগিয়ে আসতে হবে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, নারীকে বাদ দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম অসম্ভব। আগামী নির্বাচনে জাতীয় মহিলা পার্টিকে আরও শক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তৃতায় অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, নারীকে পুরুষের চেয়ে দুর্বল ও অধম ভাবার একটি চর্চা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো রয়েছে, এর পরিবর্তন হতেই হবে।
তিনি বলেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈরিতা থাকলে চলবেন না। একে অন্যের সহযোগী হতে হবে। পুরুষকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
সালমা ইসলাম এমপি আরও বলেন, এখনো বিভিন্ন স্থানে নানা পর্যায়ে নারীরা নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং অধিকারবঞ্চিত। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত হাতে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালমা ইসলাম আরও বলেন, আমরা অনেক উন্নতি করেছি। আমাদের মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। পরীক্ষার ফল থেকে শুরু করে চাকরি, ব্যবসা, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নারীরা।
সালমা ইসলাম বলেন, আমি মনে করি আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এই যে অবস্থানে এসেছেন এর নেপথ্যের কারিগর তার স্ত্রী শেরিফা কাদের। তেমনিভাবে আমাদের প্রিয় মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর আজকের এ অর্জনের পেছনেও রয়েছেন তার সহধর্মিনী।
নারী দিবস পালনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার নিউইয়র্কের সমাজতন্ত্রীবাদী কর্মী এবং গার্মেন্টস শ্রমিক থেরেসা মার্কাইল প্রথমে নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য সমাবেশ করেন।
পরবর্তীকালে ১৯১০ সালে আমেরিকার সমাজতন্ত্রীদের অনুপ্রেরণায় জার্মানে আন্তজার্তিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্ব দেন জার্মান রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিন। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রথম আন্তজার্তিক নারী দিবস পালন করা হয়।
পরে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তজার্তিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে সারাবিশ্বে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আন্তজার্তিক নারী দিবসের এবারের প্রতিতপাদ্য ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন।’
সালমা ইসলাম বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্মে নারীকে অনেক অধিকার দিয়েছে। আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা অনেকেই তা জানি না। পবিত্র কোরআনে নারীদের অধিকারের বিষয়ে অনেকগুলো আয়াত আছে।
যেমন: সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের পরিচ্ছদ। একইভাবে সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, তাই আসুন আমরা শপথ নেই। আমাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হই। মনে রাখতে হবে, সবার আগে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। আমাদের অধিকার সম্পর্কে আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে। কবির ভাষায়, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। তাই আমাদের জাগতেই হবে।
বিশেষ অতিথির বক্ততায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি শেরিফা কাদের এমপি বলেন, নারীর অধিকার রক্ষা এবং বৈষম্য দূর করতে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীর মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
জাতীয় মহিলা পার্টির যুগ্ম আহবায়ক নাজমা আখতার এমপির সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হেনা খান পন্নি, অ্যাডভোকেট লাকী বেগম, মহিলা পার্টির নেতাদের মধ্যে ডা. সেলিমা খান, অধ্যাপিকা বিলকিস আখতার পুতুল, খাইরুন নাহার, রিতা নূর, জেসমিন নূর প্রিয়াংকা, শাহনাজ পারভীন, আইরিন গমেশ ও রেশমা।
উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ দিদার বখত, মহিলা পার্টির নেত্রীদের মধ্যে তাসলিমা আকবর রুনা, মিনি খান, শারমী আখতার, মেহেরুন্নেসা হিয়া, শ্যামলী, রীনা, কিয়া মাসুদ।
যুব সংহতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয় মিলনায়তনে জাতীয় যুব সংহতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি এবং বিশেষ অতিথি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি।
জাতীয় যুব সংহতির আহবায়ক এইচ এম শাহরিয়ার আসিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সদস্য সচিব আহাদ ইউ চৌধুরী শাহীন।
বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক এ আদেল, যুব সংহতির কেন্দ্রিয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হেলাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন হেলাল, সাইফুল ইসলাম, নেওয়াজ আলী ভূঁইয়া, দ্বীন ইসলাম শেখ।