পদত্যাগের গুঞ্জন নিয়ে যা বললেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৫:০৩ এএম
বিএনপির সঙ্গে কয়েক যুগের সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপি করে আসা এই জ্যেষ্ঠ নেতার পদত্যাগের পরদিনই দল ছাড়ার খবর আসে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানে। শুধু তাই নয়, আরও অন্তত ৫-৭ জন সিনিয়র নেতার বিএনপি ছাড়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছেন, যাদের ৫ জনই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন।
সিনিয়র কয়েক নেতার পদত্যাগে বিএনপিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ নিয়ে চিন্তিত ও বিব্রত হাইকমান্ড। আরও যারা করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
এটা দলে ভাঙন সৃষ্টির কোনো ষড়যন্ত্র কিনা, সে ব্যাপারে সতর্ক হাইকমান্ড। এ মুহূর্তে পদত্যাগের কারণ কী হতে পারে- তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে যারা এরই মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তাদের ব্যাপারেও সন্ধান চলছে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, হাইকমান্ডের ওপর ক্ষোভের পাশাপাশি ‘সরকারের চাপ’ বড় একটা কারণ হতে পারে।
সূত্র জানায়, আরও যেসব নেতার পদত্যাগের গুঞ্জন রয়েছে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। আর কেউ যাতে এমন অবস্থান না নেন- সে ব্যাপারে দলটির হাইকমান্ড সতর্ক।
পরপর দুদিনে দুই জ্যেষ্ঠ নেতার পদত্যাগের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন শুরু হয় যে বিএনপির আরও অন্তত ৫-৭ নেতা দল ছাড়ছেন। এদের মধ্যে আছেন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এছাড়া আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান দলে স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ না পেয়ে হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ আছেন। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে জায়গা না হলে তিনিও পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
উল্লেখিত পাঁচ নেতাই দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি করে আসছেন। তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও দলের প্রতি ত্যাগ নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। এদের মধ্যে অন্তত তিনজনের আরও আগেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার কথা ছিল। গত কাউন্সিলেও তাদের নাম ছিল আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত তাদের স্থায়ী কমিটিতে না নিয়ে তাদের অনেক জুনিয়রকে ঠাই দেয়া হয়েছে দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে। এ নিয়ে তারা হাইকমান্ডের প্রতি কিছুটা ক্ষুব্ধ।
৫ ভাইস চেয়াম্যানের কেউ কেউ প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। কেউ আবার নিশ্চুপ আছেন।
সবশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূণ্য পদে জায়গা হয়েছে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান টুকুর। স্থায়ী কমিটিতে উল্লেখিত নেতাদের নাম বহু দিন ধরেই ঘুরেফিরে আসছিল। কিন্তু তাদের সেই মূল্যায়ন এখনও করা হয়নি। এ কারণে তারা দলের হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দল পরিচালনায় স্থায়ী কমিটির নেতা ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না। যদিও স্থায়ী কমিটির পর ভাইস চেয়ারম্যানরাই বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে বলেন, দলের কোনো সিদ্ধান্তই জানতে পারি না। প্রতিদিন শুনতে পাই নয়াপল্টনে স্কাইপে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে ডেকে ডেকে কথা বলেন। কী বলেন, কী সিদ্ধান্ত নেন তাও জানি না। দলে আছি কী নেই তাও জানি না।
এমতাবস্থায় চারদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, বিএনপি থেকে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওপর বীরউত্তম, মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতা যে কোনো সময় পদত্যাগ করছেন।
তবে পদত্যাগের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই। এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আরও অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এর পর আমি নিজে থেকে অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছেন ‘এটি ভুয়া খবর।’
দলের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তা কীভাবে দূর করা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষোভ দূর করা সম্ভব নয়; ক্ষোভের কারণ দূর করতে হবে।
সম্প্রতি এক মামলায় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি আদালত থেকে জামিনেও মুক্ত হন। এর পর এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, রিজভী (বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী) ছাড়া কেউ তার অথবা তার পরিবারের খোঁজ নেননি। দলের নেতাদের সহমর্মিতাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বিএনপি ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যে দলে আছি, সে দল ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর পদত্যাগের বিষয়ে বলেন, ‘এটা একটা ভিত্তিহীন খবর, আমি দল ছাড়ছি না। এ নিয়ে কোনো মিটিংয়ে অংশ নেইনি।’
বিএনপি পোড় খাওয়া নেতাদের একজন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রাম বিএনপির সবচেয়ে সিনিয়র নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়নি। দুই দুবার কাউন্সিলে চট্টগ্রাম থেকে দুই নেতাকে (সালাউদ্দিন কাদের ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী) স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে যারা একসময় অন্য দল করতেন। তারা রাজনীতিতেও নোমানের জুনিয়র। এ কারণে নোমান ক্ষুব্ধ।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে রাজপথে দৃশ্যমান আন্দোলন কর্মসূচি না দেয়া, খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ‘অকারণে’ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া ও দল পুনর্গঠনসহ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিনিয়র নেতাদের অবজ্ঞা, সম্প্রতি অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে দুই নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে নিয়োগ দেয়া নিয়ে মান অভিমান চলছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। এসব ক্ষোভের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা ও মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতেও কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
বিগত কয়েক বছরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরীর পর মঙ্গলবার বিএনপি ছাড়েন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের কেউ প্রথমবারের মতো দল ছাড়লেন।
তিনি দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরাবর লেখা চিঠি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সাবেক এই সেনাপ্রধান বুধবার রাতে যুগান্তরকে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে এর কিছুক্ষণ পরই তার স্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, দল থেকে পদত্যাগের বিষয়টি গুঞ্জন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি দলের সুসময়ে অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। নেতাকর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে খালেদা জিয়া যে সরকার গঠন করেছিলেন তখন অনেক নামিদামি নেতা আমাদের দলে এসেছেন। তাদের দেখে মনে হয়, দেশের এমন পরিস্থিতিতে এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, আর সহ্য হচ্ছে না। সে কারণে তারা প্রস্থান করতে চান। দুই-একজন দল ছাড়লে বিচলিত হওয়ার কিছুই নেই।
তিনি বলেন, বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্ম, একটি বটগাছ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মানুষ এখানে আসবে বিশ্রাম নেবে, পিপাসা মেটানোর পর আবার চলে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। এদের বেশি গুরুত্ব দেয়ার দরকার মনে করে না বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বারবার বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এখন আবার নতুন ষড়যন্ত্রের আভাস শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কোনো কাজ হবে না। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু কোনোভাবেই তা সফল হয়নি।
তিনি বলেন, যারা যাচ্ছেন তারা ক’দিন পর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের নানামুখী চাপের কারণে কেউ কেউ পদত্যাগপত্র দিচ্ছেন। আমরা এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না।
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তারেক রহমান এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সেখানে কেউ যদি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর অহেতুক দোষ চাপান সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।