টেন্ডুপাতায় উত্থান ওমর ফারুকের, বিনাশ ক্যাসিনোয়
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০১৯, ০৬:২৮ এএম
ক্যাসিনো সম্রাটের সঙ্গে ওমর ফারুক চেৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
২৩ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগের ৭ম জাতীয় কংগ্রেস। সাত বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা ওমর ফারুক চৌধুরীর ইচ্ছা ছিল ওই কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করা। এ কারণে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর যুবলীগ থেকে বাদ পড়ছেন এই আঁচ পেয়ে কংগ্রেসে যেন সভাপতিত্ব করার শেষ সুযোগটুকু তাকে দেয়া হয় সে জন্য দেনদরবার করছিলেন। কিন্তু তার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না। তাকে যুবলীগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন যুবলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে তার যুবলীগে রাজনীতি করার অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।
ওমর ফারুক চৌধুরীর বিষয়ে অভিযোগের অন্ত নেই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। তিনি যুবলীগের রাজনীতিতে এসে অনেকটাই আঙুল ফুলে কলাগাছ। একসময় তামাকের বিকল্প টেন্ডুপাতার ব্যবসা করা ওমর ফারুক যুবলীগের রাজনীতির সুবাদে এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। তার অঢেল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব করেও পার পেয়ে যাচ্ছিলেন ওমর ফারুক। অবশেষে ধরা খান ক্যাসিনোকাণ্ডে। ঢাকার ক্লাব ব্যবসার আড়ালে যারা অবৈধ জুয়ার ব্যবসা করে আসছেন, তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্য ওমর ফারুকের। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুগ্ম সম্পাদক কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, সহসভাপতি এনামুল হক আরমানের ক্যাসিনো ব্যবসার সুবিধাভোগী ছিলেন তিনি। রিমান্ডে দেয়া জিজ্ঞাসাবাদে এসবের সত্যতা স্বীকার করেছেন সম্রাট ও খালেদ। সম্রাট জানিয়েছেন, ভিআইপিরা তার কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়েছেন। তার ডেরা থেকে প্রতি মাসে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বেরিয়েছেন তারা। এসব ভিআইপির মধ্যে ওমর ফারুকও রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্যাসিনো সম্রাট ছিলেন ওমর ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে সভাপতি পদে সম্রাটের পদোন্নতি হয়েছে ওমর ফারুকের হাত ধরেই। সম্রাটকে যুবলীগের শ্রেষ্ঠ সংগঠক আখ্যা দিয়েছিলেন খোদ যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ওমর ফারুক।
ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে দলীয় পদ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাচারিতা, ইচ্ছামাফিক পদ দেয়া-পদ বাতিল করা ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে ওমর ফারুকের বিপক্ষে।
৭১ বছর বয়সী এ নেতা দীর্ঘ সাত বছর চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে ছিলেন সংগঠনটির। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে আওয়ামী লীগের বৃহৎ এই সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে ঝরে পড়লেন তিনি।
ক্যাসিনোকাণ্ডের শুরুতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ তিন নেতার গ্রেফতারের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। তিনি ওই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেন।
প্রশাসনকেও দুষেছেন। যুবলীগের প্রশ্নবিদ্ধ নেতাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এর পরের দৃশ্যপট অন্যরকম। এর পর থেকেই তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে রোববার তার বিষয়ে এ অব্যাহতির সিদ্ধান্ত এলো।
তিন বছর মেয়াদি যুবলীগ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব টেনে অর্ধযুগ পার করেছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। নানা অজুহাতে যথাসময়ে সম্মেলন করেননি তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আগামী ২৩ নভেম্বর সংগঠনটির সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এর আগে ২০১২ সালের ১৪ জুলাই সর্বশেষ জাতীয় কংগ্রেসে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ওমর ফারুক চৌধুরী। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর থেকে নির্জন-নিভৃতে চলে যান যুবলীগ চেয়ারম্যান। অভিযান শুরুর পর থেকেই নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে থাকে তার বিরুদ্ধে।
ব্যাংক হিসাব তলব ও বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিপদ বুঝে ছিটকে পড়েছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
নিজেকে তরুণ ভাবাপন্ন ৭১ বছর বয়সী ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই একক ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। শুরুতে সাবেক নেতাদের পরামর্শ ছাড়াই একটি ঢাউস কমিটি গঠন করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি অনেক নেতাকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। ফ্রিডম পার্টি ও যুবদলের অনেকে টাকার বিনিময়ে ঠাঁই পেয়েছেন যুবলীগে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা জানান, বিগত সাত বছরে তারা চেয়ারম্যানের ভয়ে তটস্থ ছিলেন। মুখবুজে সব অপকর্ম সহ্য করেছেন। সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিয়েছেন। আমাদের শুধু সম্মতি দিতে হয়েছে।
তার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দিলেই তাৎক্ষণিক বহিষ্কার, অফিসে আসতে বারণ পর্যন্ত করা হয়েছে। তারা বলেন, তার সব অপকর্ম জায়েজ করার মেশিন ছিল যুব জাগরণ প্রকাশনা। এখান থেকে নানা বই ও প্রকাশনা বের করে সবার কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করতেন।
বর্তমান ও সাবেক যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসে ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে যুবলীগের ঐতিহ্য বিলীন হতে শুরু করে।
অর্থের বিনিময়ে দলে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিতাড়িতরাও। অর্থের বিনিময়ে দলে অযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ অনেক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় গোলারটেক মাঠে ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তরের কয়েকটি ওয়ার্ডের যৌথ ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করেন ওমর ফারুক চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আপনি বলছেন ৬০টি ক্যাসিনো আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপনারা ৬০ জনে কি এতদিন আঙুল চুষছিলেন? তা হলে যে ৬০ জায়গায় এই ক্যাসিনো, সেই ৬০ জায়গার থানাকে অ্যারেস্ট করা হোক। সেই ৬০ থানার যে র্যাব ছিল, তাদের অ্যারেস্ট করা হোক।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অপরাধ করলে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। প্রশ্ন হলো- এখন কেন অ্যারেস্ট হবে। অতীতে হলো না কেন, আপনি তো সবই জানতেন। আপনি কি জানতেন না? নাকি সহায়তা দিয়েছিলেন সে প্রশ্নগুলো আমরা এখন তুলব। আমি অপরাধী, আপনি কী করেছিলেন? আপনি কে, আমাকে আঙুল তুলছেন?’
সেদিন উত্তেজিত হয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাকে অ্যারেস্ট করবেন? করেন। আমি রাজনীতি করি, ১০০ বার অ্যারেস্ট হব। আমি অন্যায় করেছি, আপনারা কী করেছিলেন? আপনি অ্যারেস্ট করবেন, আমি বসে থাকব না। আপনাকেও অ্যারেস্ট হতে হবে। কারণ আপনিই প্রশ্রয় দিয়েছেন।’
ওমর ফারুক চৌধুরী আরও বলেন, ‘এখন হঠাৎ করে কেন জেগে উঠলেন? কারণটি কী? এটি কি বিরাজনীতিকরণের দিকে আসছেন? দলকে পঙ্গু করার কোনো ষড়যন্ত্রে আসছেন? নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্রে আসছেন?’
যুবলীগের অনেক নেতা জানান, ২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ওমর ফারুক। এর আগের কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান।
এর পর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের শীর্ষ পদ পাওয়ার পর সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন এবং ধনাঢ্য জীবনযাপন করছেন; যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।
ওমর ফারুক ৬৪ বছর বয়সে হয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। অথচ যুবলীগের ইতিহাসে এর আগে ৫০ বছরের বেশি বয়সী কেউ চেয়ারম্যান হননি। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে শেখ ফজুলল হক মনি যখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় আসার সময় ওমর ফারুক শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান (মঞ্জু) এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হলে ওমর ফারুক দলবদল করেন। জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
ওমর ফারুক চৌধুরী নাজিউর রহমানের ভায়রা এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলে তিনি সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে তিনি উত্তর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন।
সদ্য পদ হারানো নেতা ওমর ফারুক তামাকের বিকল্প ‘টেন্ডুপাতা’ থেকে শুরু করে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেছেন। ঋণখেলাপি হয়েছেন। রাজনীতিতেও দীর্ঘ সময় সুবিধা করতে পারেননি।
বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন, আওয়ামী লীগ করেও লম্বা সময় ছিলেন পেছনের কাতারে। তবে যুবলীগ তাকে নিয়ে গেছে শীর্ষে। যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর শোধ করেছেন পুরনো ব্যর্থতার দেনা।
২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ওমর ফারুক। এর আগের কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। এর পর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের শীর্ষ পদ পাওয়ার পর সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন এবং ধনাঢ্য জীবনযাপন করছেন। যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।
এ নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সমালোচনাও আছে। যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাদের সরাসরি আলাপ করার সুযোগও কম ছিল। যুবলীগের বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। পিয়ন থেকে দফতর সম্পাদক হওয়া কাজী আনিসও ‘কমিটি–বাণিজ্য’ করে অনেক বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। আনিস এখন পলাতক।
আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা এসএম ইউসুফ ছিলেন তার রাজনৈতিক মুরব্বি। বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে টেন্ডুপাতা আমদানি শুরু করেন ওমর ফারুক। তামাকের বিকল্প এ টেন্ডুপাতা বিড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় আসার সময় ওমর ফারুক শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান (মঞ্জু) এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হলে ওমর ফারুক দলবদল করেন। জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
তৎকালীন মন্ত্রী নাজিউর রহমানের উৎসাহে ওমর ফারুক জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর কিছু দিন নীরব ছিলেন ওমর ফারুক। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলে তিনি সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে তিনি উত্তর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন। ওই কমিটির মেয়াদ ছিল ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে উত্তর কমিটিতে সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদের আমলে যুব সংহতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওমর ফারুকের আয় বাড়তে থাকে। মালিক হন পোশাক কারখানার। ওমর ফারুক চৌধুরী নিজেও গত সোমবার বলেন, তিনি ১৯৮৮ সালে রাউজানে পোশাক কারখানা স্থাপন করেছিলেন, যা পরে চট্টগ্রাম শহরের জুবিলি রোডে স্থানান্তর করেন।
তবে এই ব্যবসা করতে গিয়ে সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয় ওমর ফারুকের। ব্যাংকঋণের দায়ে নগরের একটি বাড়ি এবং রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের জমি ও ঘর নিলামে ওঠার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। নিলামে তোলার দিনক্ষণও ধার্য করেছিলেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে নিলাম ঠেকান তিনি।
সম্পদ নিলামে ওঠার দুই মাস আগেই যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন ওমর ফারুক চৌধুরী। আওয়ামী লীগও ওই বছরের শুরুতে ক্ষমতায় আসে। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে তার। ব্যাংকঋণের একটি অংশ পরিশোধ করেছেন তিনি। কিন্তু এখন আর ওমর ফারুক চৌধুরীর দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।
প্রসঙ্গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে অপসারণের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যুবলীগ নেতাদের বিষয়েও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, যুবলীগের এক নেতা অস্ত্র উঁচিয়ে চলে। আরেকজন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়।
এর পর গণমাধ্যমে যুবলীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতায় ঢাকার ৬০টি জায়গায় ক্যাসিনো পরিচালনার খবর প্রকাশ হয়। ১৮ নভেম্বর ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস, ওয়ান্ডারার্স এবং গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ মদ ও ৪০ লাখের বেশি টাকা উদ্ধার করে র্যা ব। ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে ওই দিনই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ইয়াংমেনস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
পাশের ওয়ান্ডারার্স ক্লাব থেকেও জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ক্লাব পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। এর পর ধানমণ্ডির কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে অভিযান চালিয়েও ক্যাসিনো চালানোর প্রমাণ পায় র্যা ব। অস্ত্র-গুলি ও ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয় ক্লাবের সভাপতি কৃষক লীগের সহসভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে।
এর মধ্যে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি করা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গ্রেফতার করা হয় মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবির পরিচালক লোকমান ভূঁইয়াকে।
দুবাই থেকে গ্রেফতার করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে। পরে গ্রেফতার করা হয়েছে ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানকে ‘শুদ্ধি অভিযান’ নাম দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সন্ত্রাস, চাঁদবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের ভাসানচরে পাঠানো হবে।
ক্যাসিনো ব্যবসায় যুবলীগ নেতাদের মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তলব করা হয়েছে ব্যাংক হিসাব। সবশেষ তাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
যুবলীগের পদ হারিয়ে ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এখনও তেমন কিছু প্রমাণ হয়নি। গণমাধ্যমে খবরের কারণে তাকে যুবলীগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে দাবি করে ওমর ফারুক বলেন, মিডিয়া ট্রায়ালেই আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যম অনেক কিছুই লিখেছে। এ কারণে আমাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
ওমর ফারুকের ভাষ্য, ‘আপনারা (সাংবাদিক) লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, আমি আর দল করতে পারব না, রাজনীতি করতে পারব না। মিডিয়া ট্রায়াল শেষ। আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর মানে ‘ইউ আর নো মোর’। এখন আমি যতই সত্য কথা বলি, তা মিথ্যা ফিকশন হয়ে যাবে। তাই আর কিছু বলতে চাই না।’
ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসার পর পদচ্যুত হওয়ার আগেই আড়ালে চলে যান ওমর ফারুক। প্রায় এক মাস যাননি দলীয় কার্যালয়ে। আসন্ন কংগ্রেসের কার্যক্রম থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যমে যা লেখা হচ্ছে, তাতে কি আর সানন্দে বাইরে যাওয়া যায়? সে জন্য বাইরে যাই না, ঘরেই থাকি। আমার উচিত সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিজেকে স্বচ্ছ প্রমাণ করা, সেই প্রক্রিয়াতেই আছি।
তিনি যোগ করেন, ‘আমি তো শাস্তি পেয়েছি-ই। কয়েক দিন ধরে গৃহবাস এবং রোববার দল থেকে গেট আউট। কষ্ট যা পাওয়ার পেয়েছি। সর্বোচ্চ কষ্ট পেয়েছি। এখন তো আর রাজনীতি করতে পারব না, নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে।’
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে ওমর ফারুক বলেন, ‘সম্রাট রিমান্ডে কী বলেছেন তা আপনি নিজে দেখেছেন বা শুনেছেন কী? উনি (সম্রাট) যা খুশি বলতে পারেন। এসব তথ্য আমলে নিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া কেমন হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’