Logo
Logo
×

রাজনীতি

ক্যাসিনো সম্রাটের দরবার জনশূন্য

Icon

যুগান্তর রিপোর্ট

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৫:৩১ এএম

ক্যাসিনো সম্রাটের দরবার জনশূন্য

ক্যাসিনো সম্রাটের দরবার জনশূন্য। ছবি: সংগৃহীত

নেতাকর্মী ও ক্যাডারবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন ঢাকার আলোচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে কোথায় গেলে কিংবা অফিসে বসলে কয়েকশ’ সাঙ্গাপাঙ্গ ঘিরে থাকত তাকে। সম্রাট সম্পর্কে যারা জানেন না প্রথম দেখায় তাকে মনে হতে পারে মন্ত্রী-এমপি! ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসার সেই সম্রাটই এখন প্রজাশুন্য। তার দরবারে আনাগোনা নেই নেতাকর্মীদের।   

রাজধানী কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনে কার্যালয় ক্যাসিনো সম্রাটের। সম্রাটকে আটকের গুঞ্জন চাউর হলে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে ওই ম্যানশন। 

অথচ রাজধানীতে টেন্ডারবাজি ও ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ জুয়া আর ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান শুরুর পর ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে সম্রাট সহস্রাধিক নেতাকর্মী নিয়ে ওই কার্যালয়ে উপস্থিত হন। সেই রাত থেকে সাঙ্গপাঙ্গরা পাহারা দিয়ে রাখেন তাদের সম্রাটকে। এমন ভাবে ঘিরে রাখেন কেউ যেন তাদের নেতাকে নিয়ে না যেতে পারে। এমনকি ১৯ সেপ্টেম্বরও ওই কার্যালয়ে অবস্থান করেন সম্রাট। এসময় বহু নেতাকর্মী ছিল দাপুটে এই নেতার পাশে। ভূঁইয়া ম্যানশনে তাদের জন্য রান্নাবান্নার আয়োজনও করা হয়।

কিন্তু কয়েকদিন পর জানা যায়, সম্রাট তার কার্যালয়ে নেই। তবু শত শত নেতাকর্মী ওই কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে ওই কার্যালয়কে ঘিরে কৌতূহল কমে আসে নেতাকর্মীদের। কমে যায় পদচারণা। 

গত দুদিনে সরকারের প্রভাবশাল দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে সম্রাটের কার্যালয়। সবাই ধরে নিয়েছেন যে, সম্রাট ধরা পড়ছেন। 

শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘অপেক্ষা করুন, যা ঘটবে দেখবেন। আপনারা অনেক কিছু বলছেন, আমরা যেটি বলছি ‘সম্রাট’ হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। 'আমি এটি এখনও বলছি- সম্রাট বলে কথা নয়; যে কেউ আইনের আওতায় আসবে। আপনারা সময় হলেই দেখবেন।’

এর পর দিন রোববার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্লিজ, ওয়েট অ্যান্ড সি’।

এরপরই সম্রাটের নেতাকর্মীরা বুঝে ফেলেন যে, সম্রাটের আর রেহাই নেই। তারা পিছুটান নেয়া শুরু করেন। 

সোমবার কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনের ফটকের সামনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে আগের মতো নেতাকর্মীদের ভিড় নেই। অনেকটা শুনশান নীরবতা। দুই-একজন কর্মী এলেও কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। এসে উঁকি দিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। শুধু গেটে তালা লাগিয়ে দুজন দারোয়ান বসে আছেন। তাঁরা জানান, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট কয়েকদিন আগে এসেছিলেন। তাঁর মা অসুস্থ। এ জন্য মাকে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত রয়েছেন। কোন হাসপাতালে আছেন, তা জিজ্ঞেস করলেও হাসপাতালের নাম বলতে পারেননি দুই দারোয়ান।

সূত্র জানায়, ক্যাসিনো গডফাদার ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গোয়েন্দাজালে আটকা পড়েছেন। তার অবস্থান ঘিরে নজরদারি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দারা।

তিনি যেখানে আত্মগোপন করেছেন, সেখান থেকেই তথ্য আসছে সংস্থাগুলোর কাছে। যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। গ্রেফতার করে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। দায়িত্বশীল একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ঢাকার জুয়াড়িদের কাছে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। জুয়া খেলাই তার পেশা ও নেশা। প্রতি মাসে ঢাকার বাইরেও যান জুয়া খেলতে। বিশেষ করে টাকার বস্তা নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। সেখানে জুয়ার পাশাপাশি নারীসঙ্গও উপভোগ করেন। 

সম্প্রতি রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যা বের হাতে ধরা পড়েন সম্রাটের ডান হাত হিসেবে পরিচিত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এর পর ধরা পড়েন রাজধানীর টেন্ডার কিং আরেক যুবলীগ নেতা জিকে শামীম। এ দুজনই অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন সম্রাটকে। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। প্রকাশ্যে চলে আসে সুন্দর অবয়বের আড়ালে সম্রাটের কুৎসিত জগত। এতে করে বেকায়দায় পড়েন সম্রাট। 

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, জুয়া-ক্যাসিনোবিরোধী পুলিশ ও র্যা বের অভিযানের শুরুতে সম্রাট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

এ সময় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে কেউ স্পর্শ করবে না- এমন বিশ্বাস ছিল। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে রাখতে অভিযানের শুরুর দিকে তিনি দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাকরাইলে মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের কার্যালয়ে অবস্থান নেন।

কিন্তু অভিযানের গতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় তিনি ঘাবড়ে যান। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পর সম্রাট গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন।

যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, খালেদ ও জিকে শামীম গ্রেফতারের পর নড়ে বসেন সম্রাট। গ্রেফতার এড়াতে নানা মহলে লবিং শুরু করেন। যুবলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে চান যে, তাকে ছাড়া ঢাকায় যুবলীগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মতো কেউ নেই। এভাবে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই এসব করেন সম্রাট।

বর্তমানে নিরাপদ কোনো স্থানে আত্মগোপনে আছেন ক্যাসিনো সম্রাট। তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। পাশাপাশি তার সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, প্রভাবশালী বন্ধুরা কেউ তার ফোন না ধরায় সম্রাট বেকায়দায় পড়েছেন। অভিযান শুরুর পর থেকে দু-একজন ছাড়া অধিকাংশ প্রভাবশালী তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। তার ফোনও ধরেন না।

কাজেই এ পরিস্থিতিতে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগও পাচ্ছিলেন না। এর পরও তিনি অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বর্তমান আস্তানায় চলে আসেন। সেখানে পৌঁছার পর ওই নেতা খুশি না হলেও তাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন বলে জানায় সম্রাটের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে সম্রাটের ওপর নজরদারি শুরু করে।

যুবলীগ অফিস থেকে বের হওয়ার পর প্রথম দিকে তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি থাকলেও গত কয়েক দিন একাই ঠিকানা বদল করেছেন।

প্রভাবশালী নেতার বাসায় তিনি একাই গেছেন। ঘনিষ্ঠ কাউকে কিছুই জানতে দেননি। এতকিছুর পরও তিনি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি।

বিশেষ করে তিন-চার দিন ধরে সম্রাটের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে একাধিক সংস্থার কাছে।

তিনি যাতে পালাতে না পারেন, সে জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি আরও জোরদার হয়েছে। সব মিলে অবস্থা এমন যে- তাকে গ্রেফতার করা এখন সময়ের ব্যাপার।

গ্রেফতারে বিলম্বের কারণেই সম্রাট বারবার অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন। তার ঠিকানা বদলের বিষয়টিও গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই হচ্ছে বলে জানা গেছে।

পরিস্থিতি দেখে সম্রাটও মোটামুটি নিশ্চিত যে, তিনি গ্রেফতার হবেন। কাজেই যে কোনোভাবে গ্রেফতার এড়াতে সব ধরনের চেষ্টা করেছেন তিনি।

তদবির করছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার কাছে। কিন্তু এ সময়ে কেউ তার পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না। অধিকাংশই এড়িয়ে চলছেন।

তার ফোনও ধরছেন না। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অভিযানের বিষয়ে রয়েছেন কঠোর অবস্থানে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমের সামনে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের এ অভিযান নিয়ে জিরো টলারেন্সের কথা বলছেন।  এ জন্য সম্রাটের পক্ষে কেউ তদবির করার ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছেন না।

সূত্রটির দাবি, সম্রাট অসুস্থতার অজুহাতে দেশ ছাড়ার পাঁয়তারা করছেন। কিন্তু এখন তার বৈধপথে বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এরই মধ্যে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত চিঠি দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্রাট পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। তিনি ঢাকাতেই আছেন। সম্রাটের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সবাই সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম