
গয়েশ্বর রায়ের সঙ্গে নসরুল হামিদ।ছবি : সংগৃহীত
নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে হামলায় আহত ঢাকা-৩ আসনের প্রার্থী বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দেখতে গেছেন একই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বুধবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে আহত গয়েশ্বরকে দেখতে তার নয়াপল্টনের কার্যালয়ে যান নসরুল হামিদ।প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন তিনি।
এ সময় তাদের মধ্যে কিছু সময় কথা হয়।গয়েশ্বর রায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন নসরুল।গয়েশ্বরও নসরুলকে এই রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
পরে দু’জনই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় নসরুল হামিদ বিপু বলেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর হামলার ঘটনায় তিনি মর্মাহত।এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়।এ সময় দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।
হামলাকারীদের ‘অবুঝ’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিচার চাইবেন না বলে জানান গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
হামলার ঘটনাকে অনকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে বিপু বলেন, এ ঘটনায় আমরা লজ্জিত, যে দলেরই হোক না কেন খারাপ পরিস্থিতি প্রশয় দেব না।
এ সময় গয়েশ্বর বলেন, ‘আমার একটা বিশ্বাস ছিল কেরাণীগঞ্জের বুকে কখনও কেউ আমাকে অসম্মান করবেন না। কারণ আমি আমার নিজের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে দল-মত নির্বিশেষে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেরাণীগঞ্জের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখি।’
নসরুল হামিদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তুলে ধরে নসরুল হামিদ বলেন, গণতন্ত্রের টানাপোড়েনেও আমরা চেষ্টা করছি ১০টা বছর, আমার পাশে বসা নসরুল হামিদ বিপু, মাননীয় মন্ত্রী আমার ছোট ভাই, কারণ আমরা ১০টি বছর বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো চলছি, ১০টি বছর। আমরা একে অন্যের আমন্ত্রণে একসঙ্গে হয়েছি অনেকবার। কেরাণীগঞ্জে আমরা উভয়ে উভয়ের ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছি।
হামলার প্রসঙ্গ টেনে গয়েশ্বর বলেন, পুলিশ প্রশাসনের লোক আমার নেতাকর্মীদের হয়রানি করছে সেটা একটা বিষয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দুজনের মধ্যে কখনও ঝগড়া-ঝাটি হয়নি।এই কনফিডেন্সের ওপরই নির্বাচনটা করতেছিলাম। কালকে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনাটা আমার গাড়িতে ওঠার আগে, কিছু অতি উৎসাহী ছেলেপেলে থাকে, কখনও কখনও কোনো মিছিলে গোয়েন্দাদেরও লোক থাকে, তারাও কখনও কখনও কোনো ঘটনা ঘটিয়ে দিয়ে একটা নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে।
নসরুল হামিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি বিপু স্বীকার করবে যে, এখানে অতি উৎসাহী বা গোয়েন্দাদের কেউ থাকতে পারে ভোটের আগে খারাপ পরিবেশ তৈরির জন্য, এটি হতেও পারে, নাও হতে পারে।
গয়েশ্বর বলেন, আমি ওদেরকে নিবৃত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপরও হামলার হাত থেকে আমি বাঁচি নাই। যা-ই হোক আপনাদের আশির্বাদ, মা-বাবার আশির্বাদ আমি বেঁচে আছি, এটাই বড় কথা। আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আমার এই বয়সে এত রক্তপাতের পর আমার হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা না। ছুটির দিন ছিল, যানযট ছিল না, একটানে আসতে পারছিলাম। বেঁচে আছি, দোয়া করবেন। আর আমি এর বিচারও চাই না। যারা করছে তারা অবুঝ, তারা তাদের আবেগ, এই আবেগ রাজনীতির জন্য কতটুকু ক্ষতিকারক....। অসুস্থ অবস্থায় নির্বাচনের মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, অনেকে আসছে আমাকে দেখতে আমি ধন্যবাদ জানাই তাকে সহানুভূতিশীল মনোভাবের জন্য। আমি তার পাশে অবশ্যই থাকবো, অতীতেও ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকবো, এখন তার দলের লোক অবুঝ, আবেগ প্রবন সেটা তার দলীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কখনও কাউকে মামলা মোকাদ্দমা দেওয়ার মত মনোভাব কখনও ছিল না, আমিও মন্ত্রী ছিলাম, সে কারণে আমি কারো বিরুদ্ধে মামলাও দিতে চাইব না।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আশা করি এর মীমাংসা হবে এবং আমি আরও আশা করি যে, নির্বাচন হবে, হবে না, ৩০ তারিখ পার হবে, ৩০ তারিখের পরে কেরাণীগঞ্জের মানুষ সবাই, মিলেমিশে একসঙ্গে বাস করবো।’
গয়েশ্বররের বক্তব্য শেষে গণমাধ্যমকর্মীরা নসরুল হামিদ এই হামলার দায় এড়াতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা ইতোমধ্যে শুনতে পেয়েছেন যে, দাদার পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব নিবিড় সম্পর্ক। আমার বাবার সঙ্গেও উনি চলেছেন। বাবা বহুদিন ধরে কেরাণীগঞ্জে রাজনীতি করছেন। আমার বাবা ওনার (গয়েশ্বর) শিক্ষকও ছিলেন। সুতরাং আমাদের সঙ্গে ওনাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রাজনীতির বাইরেও আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক।
কেরাণীগঞ্জের সম্প্রীতির রাজনীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা চাইছি, বিগত বছর যা হইছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ভুলে গিয়ে গত ১০ বছর আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি করছি। আপনারা গণমাধ্যমে দেখে থাকবেন, ১০ বছরে ছিল অন্যরকম কেরাণীগঞ্জ এবং সেই সংস্কৃতিটাই আমরা বজায় রাখতে চেয়েছি।
গয়েশ্বরকে উদ্দেশ করে এক পর্যায়ে নসরুল হামিদ বলেন, দাদা আমার বাসায় কালকে যাবেন।উনি দীর্ঘদিন ধরে ওখানে রাজনীতি করছেন। আমাদের থেকে অনেক সিনিয়র এবং তিনি আমাদের গুরুজন।’
অতি উৎসাহীরা এই হামলা চালিয়েছে জানিয়ে বিপু বলেন, আমরা দুজন রাজনীতি করবো, আমরা নির্বাচন করবো, এখন পর্যন্ত আমরা ভালো আছি। আমাদের পরিস্থিতি ভালো, কেরাণীগঞ্জের পরিস্থিতি এখনও শান্ত। আমরা মনে করি যে, কোনো ধরনের খারাপ পরিস্থিতি মোটেও আমরা প্রশয় দেবো না। আগেও কোনোদিন দেইনি।
প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির এ প্রার্থীর গণসংযোগে হামলা হয়েছে। কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের শুভাঢ্যা বেগুনবাড়ী এলাকায় এ হামলা হয়।
এতে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হন। হামলায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মাথা ফেটে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে বিএনপি নেতাকর্মীরা বেগুনবাড়ী এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগ করছিলেন।
পরিচর্যা ক্লিনিকের সামনে পৌঁছলে শতাধিক লোক লাঠিসোটা হাতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় হামলাকারীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গুরুতর আহত করে।
অনেকে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী একটি দোকানে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন। পরে সেখান থেকে তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবদলের সভাপতি মোকাররম হোসেন সাজ্জাদ জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধানের শীষের পক্ষে গণসংযোগ করছিলেন।
হঠাৎ যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শতাধিক নেতাকর্মী সশস্ত্র অবস্থায় তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোজাদ্দেদ আলী বাবু, বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সুলতান নাসের, জয়নাল আবেদীন বাবুল, হীরা, আবু কাওসার, ঢাকা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হাজী মাসুম, শ্রমিক দল নেতা আমজাদ হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মো. রাশেলসহ অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
এদিকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরেই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আসেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। সেখানে আগে থেকেই ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক চলছিল।
তার মাথার কয়েকটি স্থানে ব্যান্ডেজ রয়েছে। এ সময় গয়েশ্বরকে অনেকটা নিস্তব্ধ দেখা যায়। পরে দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যান।
ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে গয়েশ্বর বলেন, এরা আলবদর, আলশামসের মতো আচরণ করছে। হামলার জন্য নির্বাচন কমিশনকেই দায়ী করেন তিনি।