আদিবাসী কবিতার কথা
রেশমা হাওলাদার
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বইয়ের নাম আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ। আদিবাসী কবিতা বললেই মনে হয় আদিবাসীদের কবিতা বা আদিবাসীদের নিয়ে লেখা কবিতা। পুরো বইটি পড়ে আমার পক্ষে এর কোনোটিতেই স্থির হওয়া সম্ভব হয়নি। আমি কবিতা যেভাবে পড়ি সেটাকে ঠিক গতানুগতিক পড়া বলব না। বলব জার্নি। আমি কবির কবিতার সঙ্গে যেতে থাকি। আমি দেখি কবি আমাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারেন, আর নিতে নিতে আমাকে কি কি দেখাতে পারেন।
হাফিজ রশিদ খানের কবিতা পড়ি অনেকদিন থেকেই। অনেকদিন থেকে মানে এ কবি তার কবিতার মাধ্যমে আমি পাঠকের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই আছেন। কেন আছেন? কয়েকটি কারণ আমি আমার মধ্য থেকে বের করার চেষ্টা করেছি। একটি কারণ নিয়ে কথা বলব। প্রথম পেয়েছি তার প্রকাশভঙ্গির অকৃত্রিমতা। খুবই প্রাকৃতিক উপস্থাপন। সেখানে প্রকৃতি যেমন থাকে একই সঙ্গে সেই থাকায় থাকে প্রাকৃতিক সহাবস্থান বজায় রাখাও। এটার একটি আদর্শিক সততা আছে। অর্থাৎ কবি তার রুচির মিটারে আবদ্ধ নন। এ সৌন্দর্য বজায় রাখাতে কবিকে তার একটি শর্তহীন দীর্ঘ কাব্যিক জার্নির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখন একটি কবিতা থেকে কবিতার তিনটি কাব্যরস বা কাব্যালঙ্কার উপভোগ করা যায়।
এক, বানীনির্ভর একটি নির্মোহ কবিতা পড়া যায়। দুই, প্রভাবমুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিক প্রকৃতি পাওয়া যায়। এবং তিন, একজন কবির জার্নি দেখতে পাওয়া যায়। এ তিনটি বিয়ষের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হাফিজ রশিদ খানের আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ। আদিবাসী কবিতার সঙ্গে যেতে যেতে আমিও দেখি এবং অনুভব করি, ‘মায়াবী বৃক্ষের তলে বসে থাকি/দিনের অর্ধেক রাতের অর্ধেক/ মুখ সে কিছুটা দেখায় তো বুক দেখায় না/ অন্তরের জটিল জ্যামিতি নিয়ে/চলে তার সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্ব’।
এ দ্বন্দ্ব মানুষকে নতুন কিছুতে আগ্রহী করে তোলে। তাকে আবিষ্কারক হয়ে উঠতে উৎসাহ জোগায়। এ কবিতা যখন পড়ি আমি নিজের মধ্যের প্রকৃতিকে জেগে উঠতে দেখি। আমি মায়াবী বৃক্ষ হয়ে উঠি...।
সেই প্রাচীনকালের আলো-অন্ধকারের পৃথিবীর নিজস্ব রূপের গন্ধে আন্দোলিত হয়ে মানবজীবনের মহান আনন্দের সাগরে সাঁতার কাটার ইচ্ছা নিয়ে পড়ি, ‘প্রভু হে পুরনো দিনের কী চমৎকার/বৈসাবি উৎসবে/পাড়া গাঁর দীপান্বিত বাড়ির দাওয়ায়-দাওয়ায়/অমরাবতীর পরিদের সঙ্গে কেটেছে/নিভৃত সঙ্গমের কাল।’ অথবা অতিথিঘরের পাশে/বয়ে-যাওয়া নদীটার পাড়ে এক সোনালি বিকেল/আধভেজা বালু ও কাদামাটির কারুকাজে/মায়ের দরদি মুখের মতন/এঁকেছি এক নারীমূর্তি’/
ওই দৃশ্যে অজস্র শিশুর হাসি/আর প্রাণবন্ত নাবান্নের স্ফুতি
হাফিজ রশিদের কবিতায় আদিবাসীদের যে জীবন পাওয়া যায় তা’ই যেন প্রকৃত জীবন। নিশ্চয়ই সত্যটা এমন না। এটা আমার মনে হওয়া। আমার ভালো লাগার প্রভাব হয়তো। তবুও যে জীবনে গাছের ছায়া আছে, সবুজের সতেজ হাসি আছে, জীবনের স্পন্দন আছে তা’ই যেন এ কবিতার জীবনে চাষাবাদ হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন হাট বাজারি জীবনের মাঝে এ যেন একটা নিজের ঘর। স্নেহের আশ্রয়। যার ফলে এ কবিতায় ঘুরতে ঘুরতে হাফিজ রশিদের কবিতার ভূতিতেই থেকে যেতে ইচ্ছা করছিল। নিঃসঙ্গতা বিষয়ে ছোট্ট পরিসরের একটি দীর্ঘস্বরের কবিতা পাঠে এ আলোচনার শেষ করিছি-
‘অমর হবার বাসনা ছিল না বলে/তুমিও আমাকে ভালো বললে না আর/বিনম্র সন্ধ্যার আগে-আগে পাতলা রোদের মতো/ফেলে গেলে রাস্তায়-এখন যেখানে ঠান্ডা অন্ধকার...
আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ : হাফিজ রশিদ খান। প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল। প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী। মূল্য : ২০০ টাকা।