
প্রিন্ট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৯ এএম
সর্বজনীন মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি

শায়রুল কবির খান
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংবিধানসম্মত সব অধিকার ভোগ করার বিষয়টি সর্বত্রই সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের পবিত্র সংবিধানেও রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস-মালিকানা জনগণের ওপর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে ঘোষিত আছে। মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখাসহ নানাবিধ ধর্মীয়-আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অবাধ-স্বাধীন অংশগ্রহণ এবং সার্বিক উপভোগের নিশ্চয়তা সংবিধানে সুরক্ষিত থাকলেও বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত করেছে। সরকার সম্পূর্ণরূপে কলুষিত হয়ে পড়েছিল।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় ২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি-গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের কাছে বহুবিধ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন তিনি।
৪ দিনের সফর শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নাগরিক সমাজের গুরুত্ব সীমিত করা হয়েছে।’ তার বক্তব্যে ক্রমবর্ধমান নজরদারি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রতিশোধমূলকভাবে বাকস্বাধীনতা হরণ করার বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়েছে।
বিভিন্ন আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে এনজিওগুলোর ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আরোপ এবং ব্যাপকভাবে বাকস্বাধীনতা হরণের ফলে তাদের জন্য ফলপ্রসূভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন এবং কখনো কখনো ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে।
বাকস্বাধীনতা; রাজনৈতিক কর্মী, বিরোধী দল এবং সাংবাদিকদের সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা ছিল না। নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজের ভূমিকা জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের সময়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। এ বিবেচনায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে প্রতিবাদ সমাবেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল।
হিন্দু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল হওয়া থেকে সুরক্ষা প্রদানের ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন পক্ষগুলোর ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে সরকারকে বাধাহীন অনুমতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকারবিষয়ক কমিটি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের পাশাপাশি এসব অভিযোগের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের সুপারিশ করেছে।
সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ইচ্ছামতো প্রয়োগ অথবা অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে এ আইনের কয়েকটি বিধি রদ ও পুনর্বিবেচনা করা সংক্রান্ত বিভিন্ন সুপারিশ উপস্থাপন করেছিল। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সাড়া এবং আইনটি পুনর্বিবেচনা করার প্রক্রিয়া গতিশীল করার লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণের প্রত্যাশা করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার কোনো বিষয়ে কর্ণপাত করেনি; বরং ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ‘আমি ডামি’ নামে একতরফামূলক প্রহসনের একটি নির্বাচনের আয়োজন করে।
২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যালোচনায় বাংলাদেশের চতুর্থ ইউপিআরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুপারিশ করে, একইসঙ্গে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর ও গুমের অভিযোগগুলোর স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানায়। নির্যাতনবিরোধী সনদ কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারের (সিএটি) অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষরের সুপারিশও করে অনেক দেশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে আনা সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিষয়েও আলোচনা হয়। নতুন এ আইনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক আইনগুলোর সঙ্গে সেটিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সংশোধন করা দরকার।
এর মধ্যে কানাডার প্রতিনিধি সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যালোচনায় ১১৮টি দেশের অংশগ্রহণ, পর্যালোচনা সভার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল পাকিস্তান, কিউবা ও রুমানিয়ার ওপর। পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর সুপারিশমালা গৃহীত হওয়ার কথা ছিল জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনে।
এ পর্যালোচনা সভায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছিলেন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিনিধি। আওয়ামী সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশের কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করেই দমননীতি অব্যাহত রেখেছে। এ দমননীতির মধ্যে ২০২৪ সালর ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সব সদস্য দেশ থেকে পালিয়ে যান এবং তাদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেন।
জাতিসংঘ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে। বাংলাদেশে দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা, গ্রেফতার, হত্যা ও হত্যার পর লাশ গায়েব করা, গুম করা-এর সবকিছু হয়েছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে উঠে এসেছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কিছুই ছিল না।
বর্তমানে শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে। এ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি সরকার গঠন করলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের ‘১৯-দফা’ এবং বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ‘২০-৩০ ভিশন’র আলোকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘৩১ দফা’র ভিত্তিতে সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবে।
শায়রুল কবির খান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী