Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

উগ্র বাজার অর্থনীতি : সবার মঙ্গল নেই

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উগ্র বাজার অর্থনীতি : সবার মঙ্গল নেই

খুবই বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেছেন। সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানের দিকে। অধিষ্ঠিত হয়েই ট্রাম্প কী বলেন তারই অপেক্ষা। বক্তব্য পাওয়া গেল-সেই পুরোনো কথাই। আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করে তুলতে হবে। উল্লেখ্য, অর্থনীতি, সামরিক শক্তিসহ প্রায় সব দিক থেকে আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর দেশ। আর কত মহান করবে তারা, কোন উচ্চতায়, কোন নতুন মূল্যবোধে-পরিষ্কার নয়। তবে একটা বিষয় বুঝি, আমেরিকা মহান আছে, যদিও তাদের কথিত প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ব্রিকস’ তৈরি হচ্ছে। আর চীন তো আছেই। ১৯৭১ সালে যে চীনের সঙ্গে আমেরিকা গোপনে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, সেই চীনই আজ আমেরিকাকে টেক্কা দিচ্ছে। এমন টেক্কা যে অভিষেক অনুষ্ঠানে ‘দাওয়াত’ পেয়ে শি জিনপিং অনুষ্ঠানে যাননি। এটাই ঘটনা। ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। গোকুলে হয়তো আরও অনেকেই বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। চিরকাল সমান যায় না। যায় না ঠিকই আছে। কিন্তু আমেরিকা আবার ‘মহান’ হলে আমাদের অবস্থা কী হবে? আমাদের অবস্থা তো কাহিল। আমেরিকার বন্ধু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) যন্ত্রণায় তো আমরা কাহিল হয়ে পড়েছি। মাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ, যা আমেরিকা এমনিতেই দিয়ে দিতে পারে যে কোনো দেশকে। না তারা আমাদের দুর্দিনে তা দেয়নি। দিয়েছে আইএমএফের মাধ্যমে। তার এই ঋণেই এখন আমরা কাহিল।

আমেরিকা যখন মহান হচ্ছে, আরও মহান, তখন আমরা ভগ্নপ্রায় অর্থনীতি নিয়ে কাহিল। একটি কাগজে দেখলাম আইএমএফ বলছে, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করতে হবে, যা বর্তমানে আছে ১২-১৩ শতাংশ। টাকার প্রবাহ হ্রাস করতে হবে। ডলারের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। ভ্যাটের আওতা আরও বাড়াতে হবে। ভর্তুকি আরও কমাতে হবে। অবশ্য ইতোমধ্যেই ১০০টি পণ্য/সেবার ওপর ভ্যাটের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসবই মধ্যবিত্তের পণ্য। এ মধ্যবিত্তের অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। অর্থ উপদেষ্টা নিরেট ভদ্রলোক মানুষ। সরকারের বাইরে থাকলে এর প্রতিবাদ করতেন বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সেই তিনিই এ কাজটি করলেন। আর তার ‘পাত্রে’ যে জিনিসগুলো আইএমএফ শর্ত হিসাবে তুলে দিয়েছে, তা তো রীতিমতো বিষতুল্য। যেমন, ডলারের দাম বাড়াতে হবে। ব্যাস, একটাতেই যথেষ্ট। বাকি কিছু লাগে না। আমাদের অর্থনীতি যেসব ‘ছাড়’-এর ওপর দাঁড়িয়ে, আইএমএফ তাই ধরতে বলেছে। এ জায়গায় কি ট্রাম্প আমাদের বাঁচাতে পারেন না? আলবৎ পারেন। কিন্তু তা হবে না। তিনি ব্যস্ত বিশ্বকে নিয়ে। বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি নাকি ২ শতাংশ বেড়েছে। এটা আগের হিসাব নাকি বর্তমানের হিসাব, তা আমরা জানি না। তবে এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে, আগামী বাজেট হবে আরও বড়। অথচ আমার ধারণা ছিল, এখন থেকে বাজেট হবে আরও ছোট। ছোট ছোট প্রকল্প। ব্যয়বাহুল্য পরিত্যাজ্য। অহেতুক খরচ কমবে। অন্তত সেসব খরচ, যে বিষয়ে প্রতিদিন খবর ছাপা হচ্ছে দুর্নীতির। না, তা হচ্ছে না। বাজেটের আকার বাড়বে। এর অর্থ কী? অর্থ একটা বুঝি। বাজেটে করের বোঝা বাড়বে। ঋণের বোঝা বাড়বে। এভাবে টাকা তোলা হবে। ভ্যাট বাড়বে, আয়কর বাড়বে, শুল্ক বাড়বে। আর মূলে তো রয়েছেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এক টাকা বাড়লে কর, দ্রব্যের মূল্য বাড়বে দুই টাকা। কারণ ডলারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। আবার ভর্তুকি কমবে। টিসিবি যে পণ্য রাস্তায় বিক্রি করে, তার দাম বাড়বে। কারণ, এতে ভর্তুকি আছে। গ্যাসে ভর্তুকি আছে, বিদ্যুতে ভর্তুকি আছে। এসবের দাম বাড়বে ভর্তুকি তুলে নিলে। আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর, ভর্তুকিনির্ভর, তৈরি পোশাকনির্ভর, প্রবাসী আয়নির্ভর।

এখন অবশ্য একটি বিষয় পরিষ্কার। রোজগার করে গরিবরা, খায় ধনীরা। টাকা পাচার করে ধনীরা। টাকা দেশে আনে গরিবরা। এই যে এত বড় প্রবাসী আয়, তা কে আনে? এ প্রবাসী আয়ের ৯০ শতাংশই গরিব কৃষকের ছেলেমেয়েদের। তারা বিদেশে যায় লেখাপড়া না করে। এসএসসির আগেই ছোটে সৌদি, মালয়েশিয়ায়। খাটে, শ্রম দেয়। ডলার পাঠায়। কোটির অধিক বাংলাদেশি বিদেশ থেকে ২২-২৫ বিলিয়ন ডলার সরকারিভাবে দেশে পাঠায়। বেসরকারিভাবে কত, কেউ জানে না। এদিকে পোশাকশিল্পে ৩০-৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। গরিবের ছেলেমেয়ে সব। তারাই দিন-রাত কাজ করে পোশাক তৈরি করে, যা রপ্তানি হয়। আর রপ্তানি হয় অন্য কিছু পণ্য। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ‘সলিড’ আয় এ প্রবাস আয় এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই টাকার পুরোটাই গরিবের ছেলেমেয়েদের। তাদের টাকাই আমাদের আয়। শিল্প খাতের আয় খুব কম। অন্যদিকে কৃষি খাতের পুরো আয় আমাদের গরিব কৃষকের। অর্থাৎ তারা ডলার দেশে আনে।

আর আমাদের রাজনীতিকরা দেশের নাগরিকদের দুই ভাগে ভাগ করেছেন। দ্বৈত নাগরিক এবং নাগরিক। এই দ্বৈতরা গরিবের রোজগারের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেয় অর্থ পাচারের মাধ্যমে। আবার গরিবরা ডলার দেশে আনে ডলারে। এমনকি তারা উলটো অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় ডলার দেশে আনে, কী অদ্ভুত অবস্থা! আজ বুঝতে পারছি এই ‘দ্বৈত ভাইদের’ কথা। তারা বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসা সবই বিদেশে করে রেখেছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে। কী সুখ, কী আনন্দ। ট্রাম্পের দেশেও এরা প্রচুর সংখ্যায়। এদের ধরে এনে দেশে বিচার করা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। অর্থ পাচার সম্পর্কে শ্বেতপত্রে যা রয়েছে, তার সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, এতে বেশি কিছু নেই। এর থেকেই বোঝা যায় এই টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা কী।

ট্রাম্পের মহান আমেরিকায় গড়ে উঠেছে আমাদের গরিবের টাকায়। এক সময় যেমন ইউরোপের দেশগুলোর জন্ম হয়েছিল লুটের টাকায়, উপনিবেশের টাকায়। আজ আমেরিকা গড়ে উঠেছে আমাদের টাকায়। আর ট্রাম্প সেই কৃতিত্ব নিজের করে নিচ্ছেন। তারা বুদ্ধি করে পণ্য ‘অ্যাসেম্বল’ করে টাকা তৈরি করে। পণ্য তৈরি করে চীন, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া। বুদ্ধি থাকলে এমনই হয়। আমাদের বুদ্ধি কম। তাই আয়-দায়ও কম। দেখা যাচ্ছে, মূলত রোজগারে গরিবরা, খাওয়া-দাওয়ায় ধনীরা। দেশের ভেতরেও একই অবস্থা। এক হিসাবে দেখা যায়, দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারের পরিমাণ প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। দেশে জিডিপির আকার হচ্ছে মাত্র ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের বাজারের মূল্য মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা কোত্থেকে আসে? নিশ্চিতভাবেই কৃষক ও গরিবের টাকা।

এই যে অবস্থা, তার কথা কি ট্রাম্প জানেন? মনেই হয় না। তিনি যদি সত্যি সত্যি মহান আমেরিকা গড়ে তুলতে চান, তাহলে তার উচিত হবে সারা বিশ্বকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ার। পুঁজিবাদ, উগ্র বাজার অর্থনীতি ‘প্রমোট’ করা তাদের দায়িত্ব। এ উগ্র বাজার অর্থনীতিতে সবার মঙ্গল নেই। অথচ ট্রাম্প সম্ভবত এ নীতিতেই বিশ্বাস করেন এবং তা প্রমোট করেন। আমরা আশা করব, সত্যি সত্যি ট্রাম্প চার বছরে দুনিয়াটাকে বদলে দেবেন। খোলনলচে বদলে দেবেন। যাতে আমরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম