সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক শহিদ আসাদ
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিগত ৫৬ বছরে দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয় মোট তিনবার-১৯৬৯, ১৯৯০ ও ২০২৪ সালে। সংঘটিত পৃথক তিনটি অভ্যুত্থানের সঙ্গে তিনটি নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। নাম তিনটি যথাক্রমে আসাদ (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান), মিলন (ডা. শামসুল আলম) ও আবু সাঈদ। আসাদ ১৯৬৯ সালে দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। আসাদ নামটিতে সে কী জাদু আর অনুপ্রেরণা ভর করেছিল সেদিন! বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকায় নির্মিত ‘আইয়ুব গেট’-এর নামফলক ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন নাম দেয় আসাদ গেট (এখনো বর্তমান); শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী বলে পরিচিত ‘আইয়ুবনগর’ নামটিও (বর্তমান শেরেবাংলা নগর) বদলে রাখা হয় আসাদনগর, ‘আইয়ুব এভিনিউ’ হয় আসাদ এভিনিউ। মোটকথা, দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় আইয়ুব খান নামটি ছিল, তা তুলে দিয়ে শহিদ আসাদের নামটি বসানো হয়।
১৯৬৯ সালের কথা। আসাদ গোটা জাতিকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করেছিলেন।
আজ শহিদ আসাদ দিবস। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ এলে মনে পড়ে শহিদ আসাদের কথা। আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। ২০ জানুয়ারি শহিদ হন তিনি-১৯৬৯ সালের এ দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আসাদের এ আত্মত্যাগ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। ‘খুনের বদলে খুন চাই, আইয়ুব খানের রক্ত চাই’, ‘আসাদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, আসাদের মন্ত্র, জন-গণতন্ত্র’, ‘আইয়ুব মোনেম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’-এসব স্লোগানে মুখরিত হয় দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত; দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আইয়ুববিরোধী ক্রোধের দাবানল। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী তিনদিনের শোক পালন শেষে ২৪ জানুয়ারি হরতালের ডাক দেয়। সেদিনের মিছিলে পুলিশ আবারও গুলি চালালে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর রহমান প্রাণ হারান। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শহিদ হলে গণ-আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ নেয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকথায় আসে চূড়ান্ত বিজয়। ইতিহাসের কেমন বাস্তবতা; আসাদ হত্যার মাত্র অল্পদিনের ব্যবধানে ২৫ মার্চ পাকিস্তানের ‘দণ্ডমুণ্ডের মালিক’ কথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শহিদ আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। শোষণহীন সমাজ ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ঢাকা হল (বর্তমান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) শাখার সভাপতি; ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। ছাত্রজীবনেই তিনি নরসিংদীর শিবপুর-হাতিরদিয়া-মনোহরদীসহ আশপাশের এলাকায় কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। মওলানা ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮ গ্রামবাংলায় ‘হাট-হরতাল’ ডেকেছিলেন। ভাসানীর ডাকে আসাদুজ্জামান হাতিরদিয়া বাজারে হাট-হরতাল সফল করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হাতিরদিয়া বাজারে কৃষক সমিতির কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আইয়ুবের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত হন। আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। গ্রেফতার এড়াতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। আসাদের এলাকায় কৃষক হত্যাকাণ্ডে জনতা ফুঁসে উঠে; ব্যাপক গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। শতরকমের বাধা আর প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে মওলানা ভাসানী ৯ ডিসেম্বর হাতিরদিয়া এসে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। আসাদ আত্মগোপনে থাকলেও তার পরিবার ও সমর্থকরা এ প্রতিবাদ সমাবেশকে সফল করে তোলেন।
আসাদদের বাড়ি বর্তমান নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। তার বাবা এমএ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ; অসাধারণ মেধাবী এবং অত্যন্ত সজ্জনব্যক্তি হিসাবে তাকে এলাকার সবাই সম্মানের চোখে দেখত। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আইটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষিকা।
বর্ধিষ্ণু ধানুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। পরিবারটি খুবই শিক্ষিত। ছেলে শহিদ হওয়া তথা গণ-অভ্যুত্থানের পর দুঃসহ স্মৃতি বহন করে আরও অন্তত সাতাশ বছর বেঁচেছিলেন আসাদের শোকবিহ্বল বাবা-মা।
সুপরিসর বাড়িটি এলাকায় ‘মিয়াজিবাড়ি’ নামে সমধিক পরিচিত। আসাদের বাবা ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে তিনি ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন। ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার এক বিরল সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। ‘তাহের মৌলভী সাহেব’ নামে তার ব্যাপক পরিচিতি। বাবার এমন আদর্শের ছোঁয়ায় সন্তানরাও গড়ে উঠে। তাহের-মতিজাহান দম্পতি এমনই পরম সৌভাগ্যবান, অন্য সন্তানদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হিসাবে দেখে যেতে পেরেছেন। শহিদ আসাদসহ তাদের দুই ছেলে (ইতিহাস বিভাগ) ও দুই মেয়ে (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন; অন্য দুই ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সবার বড় কেএম খুরশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ছেলে এফএম রশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কারিগরি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। খুবই গৌরবের কথা-আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও এর নকশা তৈরিতে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সহযোগী হিসাবে দেশীয় প্রকৌশলী রশীদুজ্জামানেরও (শহিদ আসাদের পিঠাপিঠি অগ্রজ) অংশগ্রহণ রয়েছে।
শহিদ আসাদের মা মারা যান ১৯৯৫ সালে, বাবা মারা যান ১৯৯৬ সালে। সব সন্তানেরই লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা ও কর্মোদ্যম সবকিছু সচক্ষে দেখে যান তারা। আরও গর্বের কথা, তাদের এক সন্তানের আত্মদানের বিনিময়ে গণ-অভ্যুত্থান সফল পরিণতির দিকে এগোয়।
আসাদ শিবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে (ছাত্ররাজনীতিতে অধিক মনোযোগী হয়ে এক বছর পিছিয়ে) আইএ পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। আসাদ ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি না পাওয়ায় ফলাফল বাতিল করে ১৯৬৮ সালে তিনি আবারও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একইসঙ্গে এবং একই বিষয়ে (ইতিহাস) সেবার আসাদের পাশাপাশি বসে এমএ পরীক্ষা দেন অনুজ এইচএম মনিরুজ্জামানও। গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পর (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায়, উভয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাশ করেছেন। আসাদ ছিলেন ঢাকা হলের (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ৩০২ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র।
শহিদ আসাদ জীবনের বিনিময়ে আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইলেন। বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান তাৎক্ষণিক লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। এ কবিতায় সংগ্রামী জনতাকে কবি অনুপ্রাণিত করেন এভাবে-‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’। আসাদের নামে ঢাকার আসাদ গেটের নামকরণ। নরসিংদীর শিবপুরে সরকারি শহিদ আসাদ কলেজ, শহিদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল, শহিদ আসাদ সরণিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা আসাদের স্মৃতি বহন করছে। সরকার ২০১৮ সালে আসাদকে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেছে। আসাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের দীর্ঘদিনের দাবি, স্কুলের পাঠ্যসূচিতে শহিদ আসাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এতে নতুন প্রজন্ম শহিদ আসাদ ও তার আলোকিত পরিবারের কথা জানতে পারে।
বিমল সরকার : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক