Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাংলাদেশের বিজয়

মোদি-প্রিয়াঙ্কার বক্তব্য স্ট্যান্টবাজি নাকি জেদের বহিঃপ্রকাশ?

আতাউর রহমান

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৩ পিএম

মোদি-প্রিয়াঙ্কার বক্তব্য স্ট্যান্টবাজি নাকি জেদের বহিঃপ্রকাশ?

এক.

‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো।

বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।

থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,

জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝড়ে পড়লো কংক্রিটে।

মা….মাগো….চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্নো মার্কা আধ খাওয়া একটা সিগারেট

প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।

পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে। ’

দ্রোহের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার কালজয়ী কবিতা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের চিত্রটা এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কী নির্মম যাতনাটাই না সইতে হয়েছে সাত কোটি বাঙালিকে। তাদের কাটা রাইফেলের নলে কত তাজা রক্তই না লেগে ছিল। একাত্তরের ৯ টি মাস তাদের বুটের তলায় পিস্ট হয়েছে কত কত শত বাঙালির স্বপ্ন-সাধ। পাকিস্তান শাসক ও সেনাদের শোষণ-জুলুম আর রক্তচক্ষুর মূল লক্ষ্যই ছিল পূর্ববঙ্গের মানুষগুলোকে নি:শেষ করে দেওয়া। তারা পণ করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো দেবেই না উল্টো এখানকার সম্পদ লুণ্ঠন ও মেধাগুলোকে শেষ করে দেবে। এ কারণেই ১৪ ডিসেম্বর কাল রাতে ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ মেধাবী সন্তানগুলোর মধ্যে যারা যারা স্বাধিকার আন্দোলনে উচ্চকণ্ঠ ছিল তাদের শেষ করে দিয়েছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই জনবসতির সাত কোটি মানুষকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখার অভিলাশের কফিনে চূড়ান্ত পেড়েক ছিল এটি।

তবে বিধি বাম। সাত কোটি মানুষ ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৪ ডিসেম্বরের এত বড় ক্ষতের ঘাঁ না শুকাতেই এর দুদিন পর চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনে। বীরের মতো লড়াই করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কেতন উড়ায়।

প্রেম ও বিরহের কবি হেলাল হাফিজ তার ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় লিখেছেন,

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস

ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে

ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।

হেলাল হাফিজের সেই কল্পিত চরিত্র পাতা কুড়োনির মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হলো কই? মুক্তির ৫৩ বছরেও কি আমরা পেয়েছি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ? এখনও ভিন দেশি শকুন খাঁমচে ধরতে চায় আমার দেশের লাল সবুজের পতাকা। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত কম কি এসেছে। আর কত পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের।

দুই. ৩০ লাখ মানুষের রক্তে কেনা বিজয়।  হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রমের সৌধে দাঁড়িয়ে আছে এই বিজয়ের ভিত্তি। ৯ মাস বুক চিতিয়ে খেয়ে না খেয়ে মাটি কামড়ে আধমরা হয়ে স্বশ্রস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এসেছে স্বাধীন দেশের পতাকা। ১৬ ডিসেম্বর এই মহিমান্বিত বিজয় ও গৌরবের একক কৃতিত্ব বাংলাদেশিদের। ভারত ছিল আমাদের মিত্র। তাই বলে একাত্তরের বিজয় তাদের নয়; আজকের ১৮ কোটি বাংলাদেশির। এই বিজয় নিজেদের দাবি করে নরেন্দ্র মোদি যে পোস্ট করেছেন সেটি নি:সন্দেহে ধৃষ্টতা-ঔদ্ধত্য-পরশ্রীকাতরতা-পরিকল্পিত উস্কানি-নির্লজ্জতা ও অনধিকার চর্চার চূড়ান্ত রূপ। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তার এই বক্তব্য আমাদের মর্যাদাকে হেয় করেছে।  শুধু তাই নয়-ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই দাবি তার হীনমন্যতা, সংকীর্ণ মানসিকতা ও কট্টর সাম্প্রদায়িক চিন্তা ও চেতনার পরিচয় বহন করে। প্রতিবেশি দেশের বিজয়কে নিজ দেশের বিজয় দাবি করা কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারেরও চরম লংঘনও বটে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মোদির কাছে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া, তার দেশের দূতকে জরুর তলব করা। 

৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৮ কোটি মানুষের ৫৩ বছরের সবচেয়ে বড় অর্জনকে বিতর্কিত করতে চাইছেন মোদি।  অন্যের বিজয় চুরি করা এ কেমন মানসিকতা। এটি তার স্টেটসম্যানসুলভ আচরণ তো নয়-ই বরং এই ভূ-খণ্ডের মানুষগুলোর কষ্টে অর্জিত অর্জনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রয়াস। এই পোস্টের পর নরেন্দ্র মোদির মানসিক সুস্থতা নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়।  সত্যিই ঠিক আছেন তো তিনি; নাকি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

নিজের ভেরিফায়েড পেইজে ১৬ ডিসেম্বর নরেন্দ্র মোদির দেওয়া পোস্টটি আমি তুলে ধরলাম... 

Today, on Vijay Diwas, we honour the courage and sacrifices of the brave soldiers who contributed to India’s historic victory in 1971. Their selfless dedication and unwavering resolve safeguarded our nation and brought glory to us. This day is a tribute to their extraordinary valour and their unshakable spirit. Their sacrifices will forever inspire generations and remain deeply embedded in our nation’s history.

যেটির বাংলা করলে দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম- ‘আজ, বিজয় দিবসে, ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা সাহসী সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগকে আমরা সম্মান জানাই। তাঁদের নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের গৌরব এনে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসাধারণ বীরত্ব ও অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’

নরেন্দ্র মোদির পরপরই ভারতের পার্লামেন্টে বক্তৃতায় কংগ্রেসের নয়া সংসদ সদস্য গান্ধী পরিবারের সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও ১৬ ডিসেম্বরকে নিজেদের বিজয় দাবি করেছেন।  প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মোদিকেও ছাড়িয়ে গেছেন। লোকসভায় দেওয়া ভাষণে ‘মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়’ বলে মন্তব্য করেন কংগ্রেসের নেত্রী ও ওয়েনাডের এই সংসদ সদস্য। প্রিয়াঙ্কার এই বক্তব্য তার রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও চিন্তার দৈন্যতাকে ইঙ্গিত করে। নৈতিক দায় থেকে প্রতিবেশি বিপন্ন জাতির পাশে দাঁড়ানো আর তাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এক নয়।  মোদির পর মিসেস গান্ধীর এই সরলীকরণ বাংলাদেশের কোটি মানুষকে আঘাত করেছে।  

১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় নেতাদের বিজয়ের যে, দাবি সেটির মূলে রয়েছে পাকিস্তান সেনাদের আত্মসমর্পণের ইস্যুটি। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ্ খান নিয়াজি ঢাকার তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে ৯৩,০০০ সেনাদলের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করলেই একটি জাতির বিজয় নিজেদের দাবি করা যায় না।  

পিন্ডির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হয়েছি আমরা দিল্লির গোলামী করার জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভারতীয়দের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেই সঙ্গে আমি অহেতুক বিরোধীতার কোনো রাষ্ট্রের কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের বিরোধীতার বিপক্ষে। তবে আমাদের অস্তিত্বের প্রতি-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এমন যেকোনো তৎপরতা ও বক্তব্যকে ব্লাংক চেক দেওয়া যায় না।  

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫৪ তম বার্ষিকীতে এসে মোদি-প্রিয়াঙ্কাদের এমন বক্তব্য ১৮ কোটি মানুষকে আঘাত করেছে নি:সন্দেহে। হতে পারে মোদি-প্রিয়াঙ্কা পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজি থেকে এমন কথা বলেছেন। আবার এমনও তো ভাবার সুযোগ আছে যে, চব্বিশের গণআন্দোলনে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে হেরে গিয়ে যে দহনে ভুগছেন সেই জ্বালা থেকে উস্কানি দিচ্ছেন ভারতীয় নেতারা। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে জাতি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বিজয় আনতে জানে সে জাতি কারো ডিকটেশনে চলবে না। যে তরুণরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দেশকে রক্ষায় গোটা জাতিকে এক করতে শিখে গেছে তারা ভিন দেশি কারো চক্ষুকে ভয় করবে না। বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জের পর নেপাল-শ্রীলংকা-মালদ্বীপ তথা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের করায়ত্ব করে রাখার যে অভিলাষ ভারতের বিদেশ নীতিতে যুগ যুগ ধরে লালিত হয়ে আসছে সেটি উলট পালটে হয়ে যাচ্ছে। মোদির বক্তব্য সেই জেদের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ নয় তো!    

তিন. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাক এটি কে না চায়? প্রতিবেশি দুই রাষ্ট্রের সদ্ভাব পরস্পরকে লাভবান করবে। এই নিগুঢ় সত্যিটা তখনই কার্যকর হবে যখন বন্ধুত্বটা দুদেশের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠবে; শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে উইন-লস সমঝোতার দিন শেষে। মনে রাখতে হবে বন্ধুত্বে শোষণের মনো:বৃত্তি কিংবা দাবিয়ে রাখার প্রবণতা থাকে না, থাকে আস্থা ও সহযোগিতা। ভারতকে সেটি বুঝতে হবে। 

শেষ করব একটি উক্তি দিয়ে।  মার্টিন লুথার কিং বলেছেন— 

‘সবকিছুর শেষে আমরা আমাদের

শত্রুদের বাক্য মনে রাখবো না, কিন্তু

বন্ধুর নীরবতা মনে রাখবো। ’


লেখক: আতাউর রহমান

সাংবাদিক ও লেখক।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম