Logo
Logo
×

বাতায়ন

ইলিশের দাম যেভাবে নাগালে আসবে

Icon

মো. বশিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইলিশের দাম যেভাবে নাগালে আসবে

চাষের মাছ রুই, কাতল উৎপাদনের যাবতীয় খরচের পর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ ইলিশ মাছ, যা শুধু ধরা থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর বাইরে কোনো খরচ নেই, তার দাম প্রতি কেজি ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ভাবা যায়! মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষ ইলিশ খাবে, তাই ফরিদা আখতারের বক্তব্যকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ২৫ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে নেটিজেনরা ইলিশ রপ্তানির পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। কেউ বলছেন, ইলিশ একটি রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলছেন, এটি একটি কূটনৈতিক মাছ। কারণ গত কয়েক বছর ধরেই মাছটি নিয়ে চলছে হরেকরকম রাজনীতি ও কূটনীতি। বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, বিখ্যাত সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’ তাদের ১৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘ইলিশ এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক’ নিয়ে মূল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আসলে সুস্বাদু ইলিশ পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। জিআই সনদপ্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে ইলিশ এখন সমাদৃত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশেই। এরপর ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন একদল বিজ্ঞানী। পুকুরে ইলিশ চাষ করা যায় কি না; টিনজাত করে ইলিশ বিক্রি করা যায় কি না-এরকম গবেষণাও হয়েছে। তারপরও দিনদিন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মাছটি। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ মাছ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুটি ভাইরাল সংবাদ দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। আমি একজন কৃষিবিদ হিসাবে মনে করি, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া এ ইলিশের আকাশচুম্বী দাম হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে মনে করছি, ইলিশের বাজারজাতকরণে তদারকি সংস্থার দুর্বলতার কারণে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠা। এছাড়া, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মাছটির প্রজনন হুমকির মুখে পড়ছে, ভাটা পড়ছে উৎপাদনেও। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যের প্রভাব তো রয়েছেই, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দিনদিন ইলিশের দাম বাড়ছে।

মৎস্য অধিদপ্তর অবশ্য প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে তাদের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে। ২০০২-০৩ সালেও যেখানে বছরে ইলিশ ধরা পড়ত দুই লাখ টনের কম, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। এক যুগে ইলিশ আহরণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ সময়ে জনসংখ্যা কি দ্বিগুণ হয়েছে? না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৪১ লাখ। ২০২৩ সালে ১৭ কোটি ২৯ লাখ। জনসংখ্যা ও ইলিশের উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করলে মাথাপিছু ইলিশের সরবরাহ বাড়ার কথা? প্রশ্নটা এজন্য করলাম, আমাদের গ্রামে প্রতি শুক্রবার এবং সোমবার হাট বসত। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ মাছ হাটে দেখতে পেতাম। তখনও এটার দাম বেশি ছিল। তবে গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও মাঝে মধ্যে এ সুস্বাদু মাছটি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারতেন। সে দৃশ্য এখন কমে গেছে। মনে হয় ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, আয় ও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি ও কিছু মানুষের হাতে অসদুপায়ে অর্জিত টাকার ছড়াছড়িতে ইলিশ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কাছে আরও অধরা হয়েছে। বর্তমানে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অজুহাত দিয়ে দাম বৃদ্ধির কথা বলে উসকে দিচ্ছে কেউ কেউ। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, ‘যে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের সমপরিমাণও নয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি দেশি ভোক্তাদের ইলিশপ্রাপ্তিতে বা বাজারমূল্যে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে গেল?

ভাইরাল সংবাদের পক্ষে যুক্তি-দাবিগুলো বাস্তবায়ন আজও সম্ভব কি না-এটা আলোচনা করে সমাধানে চেষ্টা করব। সমাধানের শুরুতে আমারও কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে, চড়া দামে বিক্রি হওয়া ইলিশের কত টাকা ঢোকে জেলেদের পকেটে? জাতীয় এ মাছ বিক্রিতে লাভবান হচ্ছেন কারা? এছাড়া নদীতে কেন ইলিশের আকাল পড়েছে? কেন ইলিশ মাছ বছরের কোনো একটি সময়ে এসেও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না? এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে জড়িত আছে মহাজন, ব্যাপারী, আড়তদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের ভূমিকা। কারণ নদী বা সমুদ্র থেকে জেলেরা মাছ ধরে ঘাটে আনার পর, সে মাছের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের হাতে থাকে না। সরাসরি চলে যায় মহাজনের বাক্সে। মহাজনের নিয়োজিত কর্মী প্রাথমিকভাবে একটি দাম নির্ধারণ করে ‘ডাক’ তোলেন। মাছের বাক্স ঘিরে ভিড় থাকে ব্যাপারীদের। একের পর পর দাম হাঁকানোর পর, যে কোনো একজন ব্যাপারী সে মাছ কিনে নেন। বিদেশে এলসি হলেও আড়তদাররা এখান থেকেই মাছ কেনেন। স্থানীয় বাজারেও এখানকার মাছ বিক্রি হয়। এরপর ব্যাপারী রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বা আড়তে মাছ পাঠান। বিশেষ করে তা যায় রাজধানী কাওরান বাজার ও যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়তদারের কাছে। এখানে আবার ডাক তোলা হয়। ডাক শেষে বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের থেকে ক্রেতাদের হাতে মাছ বিক্রি হয়। মহাজন থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত যে চার থেকে পাঁচ হাত হয়েছে, তাদের প্রত্যকেই শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লাভ করে থাকে। এভাবেই ঘাট থেকে শুরু করে খুচরা ক্রেতা পর্যন্ত নির্ধারণ হয় ইলিশের দাম।

এ পেশায় জড়িত জেলে, ট্রলার মালিক, আড়তদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে জাল, ট্রলার মেরামত ও অন্যান্য খরচ মেটাতে ট্রলার মালিকদের তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। ট্রলার মালিক অনেক সময় আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নেন। এ দাদনের বদলে অর্থ না দিয়ে মাছ দিতে হয়। যেসব ট্রলার মালিক দাদন নেন, তারা আর কোনো দিনই এ জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেন না। সমুদ্রগামী একটি ট্রলারকে সাগরে ১০ দিনের জন্য ১৬ জন জেলের যাত্রা করতে জ্বালানি, বরফ, বাজারসদাইসহ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। আবার কখনো তা আরও বেশি। জেলে হারুনে সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, মাছ ধরা পড়লে যা লাভ হয়, তার অর্ধেক নেন ট্রলার মালিক। এরপর যা থাকে, তা ২০ ভাগ করা হয়। এ ২০ ভাগের মধ্যে ১৬ জন জেলের এক ভাগ করে ১৬ ভাগ, মাঝির ২ ভাগ এবং বাবুর্চি ও ইঞ্জিনচালকের ১ ভাগ। জেলেরা যদি পর্যাপ্ত ইলিশ না পান, তাহলে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হয় ট্রলার মালিককে। ফলে কোনো ট্রলার মালিক যদি অনেক ইলিশ পেয়েও যান, তিনি আগের লোকসান পুষিয়ে নিতে চান।

জনগণের জন্য প্রতি কেজি ইলিশ মাছের খুচরা বিক্রিমূল্য সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা নির্ধারণ চেয়ে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। রাজধানীর কাওরান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন বাজারে ইলিশের আড়তে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযান এবং আইন করে কি ইলিশ মাছের দাম কমানো সম্ভব? ইলিশের উৎপাদন, বাজার, আবহাওয়া, দাম-এসব নিয়ে নানা কথার মধ্যে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত (২২ দিন) নদীতে ইলিশ ধরা, পরিবহণ, মজুত ও বিক্রি বন্ধ থাকবে। মা ইলিশ রক্ষায় ইলিশের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনা নিয়ে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে ভিত্তি ধরে বেঁধে দেওয়া এ সময়ের মধ্যে কেউ ইলিশ মাছ ধরতে পারবে না।

দেশের বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও ভারতে রপ্তানি হচ্ছে ১২০০ টাকায়। এটি কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। অবশ্য ব্যবসায়ী একটি সূত্র বলেছে, প্রকৃতপক্ষে ওই দরে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না। তারা বেশি দামেই এ মাছ ভারতে পাঠাচ্ছেন, খাতাকলমে দেখানো হচ্ছে ১০ ডলার বা ১২০০ টাকা। আর সরকারি মূল্যের অতিরিক্ত টাকার লেনদেন চলছে হুন্ডিতে।

তাই সবার আগে দরকার দাম কমানোর জন্য চোরাচালান রোধ করা। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া। চাঁদাবাজি বন্ধ করা। তাছাড়া জেলেদের যাবতীয় খরচ যেমন ডিজেলের দাম, জালের দাম, সুতা এবং রশির দাম কমাতে হবে। ইলিশের এক একটি ঘাট থেকেই মোবাইলের মাধ্যমে পুরো দেশের ইলিশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রশাসন যদি সত্যিকার অর্থে ঘাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং জেলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে, তবে ইলিশ মাছের দাম নাগালের মধ্যে আসবে। ইলিশ নিয়ে নিত্য গবেষণা চলছে। কিন্তু কী করলে ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আনা যাবে, সেই গবেষণাটা বেশি দরকার। অবশ্যই বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম : উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

mbashirpro1986@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম