Logo
Logo
×

বাতায়ন

সবুরে মেওয়া ফলে, নোবেল পুরস্কার মেলে

Icon

অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৩১ পিএম

সবুরে মেওয়া ফলে, নোবেল পুরস্কার মেলে

নোবেল

১৯৮০’র দশকে জেনেটিক এবং জিনোমিক গবেষণায় একটি বিস্ফোরণ ঘটে। তখন থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার অধিকাংশই জিনতত্ত্ব ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। নোবেল পুরস্কারেও তার প্রতিফলন ঘটছে। প্রায়শ জিন গবেষকরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ের ‘দ্য শো’ তে দৃশ্যমান হচ্ছেন।  জিন বিষয়ক গবেষণার জন্য এ বছর শারীরবিদ্যা বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী যুগলের একজন, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জেনেটিক্সের অধ্যাপক, গ্যারি রুভকুন সাংবাদিকদের কাছে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা মেজর লিগ বেসবলের জন্য একটি শব্দ ব্যবহার করি, এটিকে 'দ্য শো' বলা হয়। যার অর্থ এটি যে কোনো শো নয়, এটিই ‘দ্য’ শো। 

নোবেল আপনাকে বিশ্বব্যাপী অকুস্থল-অভিসারী আলোকমালার মধ্যে টেনে আনবে। তিনি মজা করে বলেন, ‘ভিক্টর অ্যামব্রোসের সঙ্গে কাজ করা এবং যৌথভাবে এ পুরষ্কার পাওয়ার অর্থ হল আমরা দীর্ঘ সময় ধরে নিতম্বে সংযুক্ত অবস্থায় আছি’; ইংরেজি বাগ্ধারা নিতম্বে সংযুক্ত অর্থ দুজন মানুষের আবেগপ্রবণভাবে একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকা এবং একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটানো। 

তারা মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার এবং জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা ব্যাখ্যা করার জন্য পুরষ্কারটি পেয়েছেন। এ বিষয়ে জানার আগে জিনতত্ত্ব সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া দরকার। 

বংশবিস্তারের মাধ্যমে জীবের বংশধারা অব্যাহত থাকে। পিতামাতা ও পূর্বপুরুষদের বৈশিষ্ট্য ও গুণ বংশপরম্পরায় সন্তান-সন্ততির মধ্যে সঞ্চারিত হয়। জীব তার নিজের আকৃতিবিশিষ্ট ও গুণসম্পন্ন উত্তরাধিকারীর জন্ম দেয়। যে প্রক্রিয়ায় পিতামাতার আকার, আকৃতি, দেহের গঠন-প্রকৃতি, শারীরবৃত্ত, আচরণ ইত্যাদি নানাবিধ বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমিকভাবে তাদের সন্তান-সন্ততির মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তাকে হেরিডিটি অর্থাৎ বংশগতি বলে। আর যে জৈবকণার মাধ্যমে পিতামাতার বৈশিষ্ট্যসমূহের তথ্য সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তাকে জিন বলে। এজন্য বংশগতিকে প্রায়ই জেনেটিক্স হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায় বিজ্ঞানের যে শাখায় জিন সংক্রান্ত আলোচনা হয় তাকে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স বলে। গ্রেগর জোহান মেন্ডেলকে আধুনিক জিনতত্ত্বের জনক বলা হয়ে থাকে। লক্ষ্যণীয়, চেক রিপাবলিকের এই বিজ্ঞানী একজন ধর্মযাজক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না; তিনি বিজ্ঞানের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখেননি, বরং মানবদেহের জটিলতম একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন, ১৮৬৪ সালে।  

জিনের কার্যক্রম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় আলোচনা করতে গেলে ক্রোমোজোম, জিনোম, ডিএনএ, আরএনএ, কোডিং এই পরিভাষাগুলো অনিবার্যভাবে চলে আসে। প্রতিটি জীবকোষের নিউক্লিয়াসে প্রজাতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে। কোষস্থ নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থিত অনুলীপন ক্ষমতাসম্পন্ন, রঙ ধারণকারী এবং নিউক্লিওপ্রোটিন দ্বারা গঠিত যেসব সূত্রাকৃতির ক্ষুদ্রাঙ্গ বংশগতীয় উপাদান, মিউটেশন, প্রকরণ প্রভৃতি কাজে ভূমিকা পালন করে তাদেরকে ক্রোমোজোম বলে। সাধারণত ক্রোমোজোমগুলো বিভিন্ন গঠন বা ধরণের হয়। কোনো একটি প্রজাতির নিউক্লিয়াসে সাধারণত ক্রোমোজোমের একটি সেটকে বলা হয় জিনোম। মানুষের দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। প্রতি জোড়ার একটি করে ২৩টি ক্রোমোজোম মিলিতভাবে গঠন করে মানুষের জিনোম। সুতরাং মানুষের দেহকোষে এক জোড়া জিনোম আছে।

ক্রোমোজোমের প্রধান রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে- নিউক্লিক অ্যাসিড ও প্রোটিন। ক্রোমোজোমে দু ধরণের নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে: ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) এবং আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)। ডিএনএ প্রকৃত ক্রোমোজোমের স্থায়ী উপাদান এবং ক্রোমোজোমে এর পরিমাণ শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ। অন্যদিকে আরএনএ ক্রোমোজোমের স্থায়ী উপাদান নয় এবং পরিমাণ শতকরা ০.২-১.৪ ভাগ। জীবের প্রায় ৯০ ভাগ ডিএনএ ক্রোমোজোমে থাকে। ক্রোমোজোমে ডিএনএ ও প্রোটিন দুটোই থাকে, এর কোনটি জিন? উত্তর হচ্ছে ডিএনএ-র অংশবিশেষই জিন বা বলা যায় ডিএনএ-ই জিন। 

জিনকে জীবনের ব্লুপ্রিন্ট বলা হয়ে থাকে। কারণ জিনই হচ্ছে জীবের সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক যা পর্যায়ক্রমে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (সংক্ষেপে এমআরএনএ) ও প্রোটিন সৃষ্টির মাধ্যমে জীবের বাহ্যিক চরিত্রসমূহ ফুটিয়ে তোলে। অন্যভাবে বলা যায়, জিন ডিএনএ-র একটি অংশ যা একটি পলিপেপটাইড শিকল (প্রোটিন) গঠনের নির্দেশনা সম্বলিত বার্তা বহন করে। জিন থেকে এই নির্দেশাবলী ধারণ করে একটি আরএনএ কপি তৈরি হয়, যাকে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) বলা হয়, যা এই নির্দেশাবলী নিউক্লিয়াসের বাইরে প্রোটিন তৈরির কারখানা রাইবোজমে নিয়ে যায়। এমআরএনএ রাইবোজমকে মঞ্চ বানিয়ে ট্রান্সফার আরএনএ (সংক্ষেপে টিআরএনএ)-এর মাধ্যমে জিনের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অ্যামাইনো অ্যাসিড এনে একটির পর একটি সাজিয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রোটিন তৈরি করে। কোষে তৈরিকৃত সেই প্রোটিনসমূহই জীবের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে এবং কোষীয় সকল কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। 

পরিভাষাগতভাবে ব্যাখ্যা করে বলা যায়, ডিএনএ এই পুরো কাজটি রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন এই ৩টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকে। একটি ডিএনএ থেকে নতুন একটি ডিএনএ সৃষ্টি হয়, এ প্রক্রিয়াকে রেপ্লিকেশন অর্থাৎ প্রতিলিপন বলে, কোষ বিভাজনের সময় তা সংঘটিত হয়। ডিএনএ বেইজের ক্রমিকতা ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট পলিপেপটাইড তথা প্রোটিন উৎপন্ন হয় ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যে প্রক্রিয়ায় ডিএনএ থেকে এমআরএনএ তৈরি হয়, তা হলো ট্রান্সক্রিপশন; আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম দ্বারা ডিএনএ বেইজের ক্রমিকতা নকল করার মাধ্যমে এমআরএনএ তৈরি হয়। আর এমআরএনএ থেকে প্রোটিন (পলিপেপটাইড) তৈরির প্রক্রিয়া হলো ট্রান্সলেশন। বোঝাই যাচ্ছে, ডিএনএ থেকে প্রোটিন সরাসরি তৈরি হয় না। পরিবর্তে, ডিএনএ থেকে একটি ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) অণু সংশ্লেষিত হয় এবং প্রোটিন গঠনের নির্দেশ দেয়। সারাংশ করলে দাঁড়ায়- বংশগতির তথ্যসমূহ প্রবাহিত হয় ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে আরএনএ (এমআরএনএ)-তে এবং আরএনএ (এমআরএনএ) থেকে ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে প্রোটিনে (পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে), আর প্রোটিন তখন জীবের সকল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। এজন্য প্রোটিনকে বলা হয় জীবনের ভাষা এবং এই তথ্যপ্রবাহ প্রক্রিয়াকে বলা হয় সেন্ট্রাল ডগমা। বৃহদার্থে ক্রোমোজোমই বংশগতির ধারক ও বাহক, ক্ষুদ্রার্থে ডিএনএই বংশগতির ধারক ও বাহক, সূ²ার্থে জিনই বংশগতির ধারক ও বাহক। 

পরের জ্ঞাতব্য বিষয় জেনেটিক কোড। ডিএনএ চারটি নিউক্লিওটাইডের সমন্বয়ে গঠিত: অ্যাডেনিন (এ), থায়ামিন (টি), গুয়ানিন (জি) ও সাইটোসিন (সি)। আরএনএতে থায়ামিনের বদলে ইউরাসিল (ইউ) থাকে। নিউক্লিওটাইডসমূহ বিভিন্ন ক্রমিকতা (সিকোয়েন্স) অনুযায়ী ডিএনএ ও আরএনএতে সজ্জিত থাকে। ডিএনএ এবং আরএনএ-তে নিউক্লিটাইডসমূহ যে ক্রমিকতায় সজ্জিত থাকে এবং সে অনুসারে প্রোটিনের অ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্রমিকতা নির্ধারণ করে, তাকে জেনেটিক কোড বলে। বংশগতির বায়োকেমিক্যাল ভিত্তি জেনেটিক কোড।  মানুষের সন্তান যে মানুষ হয়, আমগাছ থেকে আমগাছই হয়, বাঘ থেকে বাঘই হয় তা ঐ নির্দিষ্ট জেনেটিক কোডের কারণেই হয়। এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে একটি জীবের ডিএনএর মধ্যে ঐ নিউক্লিওটাইডসমূহের নির্দিষ্ট ক্রমিকতা সেই জীবের জন্য অনন্য, অর্থাৎ ঐ ক্রমিকতা আরেকটি জীবের সাথে মিলবে না। আবার এই ক্রমিকতা যে ঐ জীবের শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট কোষের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, বরং তার সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। পৃথিবীতে মানুষ সহ যত প্রাণী আছে তাদের যাবতীয বৈশিষ্ট্য ডিএনএ-তে অ্যাডেনিন, থায়ামিন, সাইটোসিন ও গুয়ানিন কী রকম ক্রমিকতায় সজ্জিত থাকে তার উপর নির্ভর করে। মানুষ যে লম্বা বা খাটো হয়, চোখের রং আলাদা হয়, গোলাপ যে সুন্দর হয়, গাছের পাতা যে সবুজ হয়, জেসমিন ফুলে যে সুগন্ধ হয়, খেজুরে যে রস হয়, কোকিলের কণ্ঠ যে সমধুর হয়, মাছ যে পানিতে ডুবে থাকতে পারে, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে- সব ঐ নিউক্লিওটাইড চারটির সজ্জিত হওয়ার ক্রমিকতা তথা জেনেটিক কোডের ভিন্নতার কারণে হয়।

তাহলে দাঁড়ালো এই, জিন হচ্ছে ক্রোমোজোমের লোকাসে অবস্থিত ডিএনএ অনুর সুনির্দিষ্ট ক্রমিকতা, যা জীবের একটি নির্দিষ্ট কার্যকর সংকেত আবদ্ধ (এনকোড) করে এবং প্রোটিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়। 

বিবর্তনবাদ অনুযায়ী এককোষী আদিজীব বিবর্তিত হয়ে বহুকোষী জীবে পরিণত হয়েছে, যাদের প্রতিটি কোষের আলাদা আলাদা কর্মসূচি রয়েছে। জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনার ক্রমবর্ধনশীল জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিবর্তন সম্ভব হয়েছে। আমাদের অঙ্গ এবং টিস্যু বিভিন্ন ধরণের কোষ দিয়ে গঠিত। কোষের ডিএনএর মধ্যে হেরিডিটির সঞ্চিত তথ্যকে আমাদের শরীরের সব কোষের জন্য একটি ম্যানুয়াল অর্থাৎ নির্দেশিকার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কোষ বিভিন্ন, কিন্তু তারা যখন প্রোটিন তৈরি করে, তখন সে প্রোটিন একটি অনন্য সেট হয়। এটা কীভাবে সম্ভব? উত্তরটি জিনের ক্রিয়াকলাপের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। প্রতিটি কোষে একই ক্রোমোজোম থাকে, তাই প্রতিটি কোষে ঠিক একই সেট জিন এবং হুবহু একই নির্দেশাবলী থাকে, যে নির্দেশাবলী হুবহু অনুসরণ করে প্রোটিন তৈরি হয়ে থাকে। 

উদাহরণস্বরূপ এটি পেশীকোষ, অন্ত্রকোষ এবং বিভিন্ন ধরণের স্নায়ুকোষকে তাদের স্ব স্ব স্বতন্ত্র কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম করে। বিষয়টিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়: বিভিন্ন কোষের ধরণ, যেমন পেশী এবং স্নায়ুকোষের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য হয়। কীভাবে এই পার্থক্য রচিত হয়? উত্তরটি জিন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা প্রতিটি কোষকে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলী নির্বাচন করতে দেয়। জিনের কার্যকলাপ এমন সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যা নিশ্চিত করে যে, প্রতিটি কোষের মধ্যে শুধুমাত্র সঠিক জিনের সেট সক্রিয় থাকে। যদি জিনের নিয়ন্ত্রণ বিকৃত হয়, এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা অটোইমিউনিটির মতো গুরুতর রোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেহ এবং পরিবেশের পরিবর্তিত অবস্থার সাথে কোষের কার্যাবলিকে খাপ খাইয়ে নিতে জিনের ক্রিয়াকলাপকে ক্রমাগত সূ²ভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হয়।

জিনের কার্যকলাপের নিয়ন্ত্রণ বুঝতে পারা বহু দশক ধরে বিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং গ্যারি রুভকুন মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করেছেন এবং ট্রান্সক্রিপশন পরবর্তী জিনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এর ভ‚মিকা ব্যাখ্যা করে এ বছরের নোবেল জিতে নিয়েছেন। এটি ছিল জিনের কার্যক্রম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সে সংক্রান্ত একটি মৌলনীতির আবিষ্কার। গবেষণাটি তারা শুরু করেছিলেন সিনোর‌্যাবডাইটিস এলিগেনস (সংক্ষেপে সি. এলিগেনস)-এর দেহে। সি. এলিগেনস এক ধরণের কৃমি (নেমাটোড ফাইলামের অন্তর্গত), যা মাটির নীচে কঙ্কর ও অন্যান্য কনার ফাঁকে ফাঁকে জমা জলের মধ্যে বাস করে এবং জীবাণু খেয়ে বেঁচে থাকে। সাধারণ্যে কৃমি দেখতে সুন্দর নয়। কিন্তু এই কৃমির নামের শেষ শব্দ ‘এলিগ্যান্স’ ল্যাটিন থেকে উদ্ভুত; ল্যাটিন এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই যার অর্থ সৌন্দর্য। যার নয়নে যারে লাগে ভালো- যিনি এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছিলেন তার নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল। তবে এর দৈহিক স্বচ্ছতা ভালো লাগার একটা কারণ হতে পারে। প্রায় ১ মিমি দৈর্ঘ্য, ৩ দিনের একটি ছোট জীবনচক্র এবং ২-৩ সপ্তাহ আয়ুষ্কালের অধিকারী এই ছোট্ট প্রাণী। ছোট হলেও সি. এলিগেনসের দেহে বিশেষ ধরণের অনেক কোষ থাকে; যেমন স্নায়ু এবং পেশী কোষগুলি আকারে বড়, যেমনটা আরও জটিল প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। বহুকোষী জীবের মধ্যে টিস্যু কীভাবে বিকশিত এবং পরিপক্ক হয়, তা গবেষণার জন্য এটি অত্যন্ত দরকারী একটি মডেল। এর জিনগুলিকে বিবিধ জেনেটিক টুল ব্যবহার করে সহজেই ম্যানিপুলেট করা যায়। ল্যাবে অ-প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া ‘ই-কোলাই ওপি-পঞ্চাশ’ খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এটি সহজে কঠিন বা তরল মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। এটির একটি পরিচিত জেনেটিক ক্রমিকতা রয়েছে; এর জিন শতকরা ৬৫ ভাগের অধিক মানবরোগের সাথে সম্পৃক্ত জিনের সমগোত্রীয়। কম খরচে প্রচুর পরিমাণে মিউট্যান্ট স্ট্রেন পাওয়া যায়। অ্যামব্রোস এবং রুভকুন লিন-৪ এবং লিন-১৪ জেনেটিক লোকি-তে পরিবর্তনের কারণে বিকাশগত ত্রæটিযুক্ত মিউট্যান্ট সি. এলিগেনস নিয়ে কাজ করেছিলেন। 

জিনের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায় হল ম্যাসেঞ্জার আরএনএ তৈরি করা বন্ধ করা। আরেকটি হল প্রোটিন তৈরির কারখানায় এমআরএনএর পৌঁছানো বন্ধ করা। উভয় ক্ষেত্রেই, ফলাফল হল জিন দ্বারা এনকোড করা প্রোটিনের উৎপাদন রোধ করা, বা জীববিজ্ঞানীরা বলেন, জিনটি বন্ধ করে দেওয়া। অ্যামব্রোস ল্যাবরেটরিতে পদ্ধতিগত ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে সি. এলিগানসের লিন-৪ জিনের একটি ক্লোন তৈরি করেন এবং লক্ষ্য করেন যে, এটি কোন প্রোটিনকে কোডিং করছে না; অর্থাৎ লিন-৪ জিনটি লিন-১৪ জিনের নেতিবাচক নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করে তাকে বন্ধ করে দিচ্ছে। বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে তিনি আবিষ্কার করেন যে, লিন-৪ জিন একটি অস্বাভাবিকভাবে ক্ষুদ্র আরএনএ অণু উৎপন্ন করেছে, প্রোটিন উৎপাদনের জন্য যার কাছে কোন কোড নেই। প্রোটিনের পরিবর্তে এটি একটি ২২-নিউক্লিওটাইড ননকোডিং ছোট্ট আরএনএ এনকোড করেছে। প্রমাণিত তো হলো যে যে লিন-৪ থেকে উৎপাদিত ক্ষুদ্র আরএনএই লিন-১৪-এর কার্যকলাপ অবরুদ্ধ করার জন্য দায়ী। কিন্তু কীভাবে এটি ঘটছে, তা তখনও অজানা? সেই রহস্য ভেদ করতে হবে। 

সমান্তরালভাবে, রুভকুন তার পরীক্ষাগারে খুঁজে পেলেন যে, লিন-৪ একাধিক উপাদানের মাধ্যমে লিন-১৪-এর ‘৩ প্রাইম আনট্রান্সলেটেড রিজিওন’ (৩' ইউটিআর) নিয়ন্ত্রণ করছে। জিনের ক্রমিকতা (সিকোয়েন্সিং) তুলনা করে তারা দেখতে পেলেন যে, লিন-৪-এর ঐ ২২-নিউক্লিওটাইড ননকোডিং ছোট্ট আরএনএ এবং লিন-১৪-এর ঐ ৩' ইউটিআর উপাদানগুলির সিকোয়েন্সিংয়ের মধ্যে আংশিক মিল বা পরিপূরকতা রয়েছে। এই সাদৃশ্যই ধারণাগতভাবে নতুন এক ধরণের জিন-নিয়ন্ত্রক আরএনএ-র অস্তিত্বের প্রথম আভাস প্রদান করে; আর এই নতুন আরএনএটিই মাইক্রোআরএনএ। যখন একটি মাইক্রোআরএনএ একটি এমআরএনএ-তে তার পরিপূরক ক্রমিকতার সাথে আবদ্ধ (এনকোডেড) হয়, তখন এটি সাধারণত কোন প্রোটিন তৈরি করার আগে সেই এমআরএনএকে ভাঙ্গনের দিকে নিয়ে যায়। ২০০০ সালে, রুভকুন আরেকটি মাইক্রোআরএনএ লেট-৭ আবিষ্কার করেন, যার ফলে পরবর্তীতে মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীদেহে সমজাতীয় মাইক্রোআরএনএ সনাক্ত করা সম্ভব হয়। একটি একক মাইক্রোআরএনএ বিভিন্ন জিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আবার একটি একক জিন একাধিক মাইক্রোআরএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যার ফলে জিনের সমগ্র নেটওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় এবং সূ²ভাবে সামঞ্জস্য নিশ্চিত হয়। এ আবিষ্কার সমগ্র প্রাণীজগতে মাইক্রোআরএনএ সনাক্ত করার জন্য ক্লোনিং এবং সিকোয়েন্সিং প্রচেষ্টায় তড়িৎ গতি সঞ্চার করে; ফলশ্রুতিতে জানা যায় যে মাইক্রোআরএনএর একটি বিরাট বাহিনী বিদ্যমান রয়েছে, যা প্রোটিন-কোডিং জিনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ককে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অ্যামব্রোস এবং রুভকুনের আবিষ্কারটি ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, যা জিন নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন মাত্রা প্রকাশ করে। তারা বিবর্তনের ভিতর দিয়ে চলমান ট্রান্সক্রিপশন পরবর্তী জিন-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার রহস্য উন্মোচন করেন, যে প্রক্রিয়াটি মাইক্রোআরএনএর মধ্যস্ততায় সম্পাদিত হয় এবং জীবের বিকাশ ও প্রাপ্তবয়স্ক টিস্যুর কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। 

ঔষধের ক্ষেত্রে, বংশগত রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের পদ্ধতিতে জেনেটিক্স ইতোমধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। জেনেটিক্স দুটি মৌলিক ঘটনাকে আবৃত করে - উত্তরাধিকার এবং পার্থক্যকরণ। পারিবারিক ইতিহাস, প্রকারান্তরে যা হেরিডিটি, একজন ব্যক্তির রোগের ঝুঁকির একটি ভাল ভবিষ্যদ্বাণী হিসাবে বিবেচিত হয়। রোগের লক্ষণ প্রকাশের বেশ আগে (প্রিসিম্পটোমেটিক) জেনেটিক রোগ নির্ণয় অগণিত মানুষকে দীর্ঘ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে সক্ষম করেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্তন এবং কোলনের পারিবারিক ক্যান্সারের জন্য দায়ী মিউটেশনগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলিতে ব্যক্তিদের প্রিসিম্পটোমেটিক পরীক্ষাকে সম্ভব করেছে। হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ২০১৩ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় অপারেশন করিয়ে তার দুটো স্তনই কেটে ফেলেন। কারণ জেনেটিক স্ক্রীনিং করার পর ধরা পড়েছিল যে তার শরীরে মিউট্যান্ট বিআরসিএ১ জিন রয়েছে, যেটি তিনি হেরিডিটির মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছেন; জোলির মা ৫৬ বছর বয়সে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। যেসব নারীর অন্তত দুইজন নিকটাত্মীয় একজন মা, বোন বা কন্যা যাদের স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার হয়েছে তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। হেরিডিটির মাধ্যমে বিআরসিএ১ বা বিআরসিএ২ জিন প্রাপ্ত হলে শতকরা ৬০ জনের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জোলির ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল শতকরা ৮৭ ভাগ, আর ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার ৫০ ভাগ।

প্রশ্ন হচ্ছে মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার জেনেটিক্স তথা মানবকল্যাণে কী কাজে আসবে? এটি ওষুধ হিসাবে কার্যকর হবে কি না? ১৯৯০ এর দশক থেকেই এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। প্রথম ক্লিনিকাল ট্রায়াল খুব দ্রæত এসেছিল। এতে ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য লেট-৭ এর অনুরূপ একটি মাইক্রোআরএনএ ব্যবহার করা হয়েছিল, যার নাম এমআইআর-৩৪। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরের গবেষণায় দেখা গেল যে রোগের প্রথম দিকে এমআইআর-৩৪ টিউমারের বৃদ্ধিকে মন্থর করতে পারছে। কিন্তু আরএনএ ওষুধ যে ইমিউন সিস্টেমকে বিপজ্জনকভাবে উস্কে দিতে পারে, তা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় অথবা আরএনএ ওষুধকে কীভাবে মানবদেহে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায়, তা সেই সময়ে গবেষকরা খুব কমই জানতেন। চিকিৎসকরা মানবরোগীর দেহে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন, যেটি ইমিউন সিস্টেমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং চারজন মারা যায়। ট্রায়াল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ওষুধ কোম্পানির গবেষকরা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস যেন লিভারকে সংক্রমিত করতে না পারে এমন নির্দেশনা সম্বলিত একটি মাইক্রোআরএনএ ব্যবহার করেন। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক ফলাফল ইতিবাচক বলে মনে হয়। এটি একটি মাইলফলক ছিল। কিন্তু যখন গবেষকরা উদ্যাপন করছিলেন, অন্য একটি কোম্পানি ঘোষণা করে যে তারা হেপাটাইটিস সি-এর জন্য আরও কনভেনশনাল চিকিৎসা তৈরি করেছেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিতে মাইক্রোআরএনএ ওষুধ টিকতে পারবে না এ আশঙ্কায় ঐ প্রকল্প ওখানেই পরিত্যক্ত হয়। শুরুতে এমন কয়েকটি উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া সত্তে¡ও মাইক্রোআরএনএ-ভিত্তিক ওষুধের বিপুল সম্ভাবনা আছে বলে বিজ্ঞানীরা এখনও আশাবাদী। গবেষকরা মৃগীরোগ, স্থূলতা এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য মাইক্রোআরএনএ-ভিত্তিক থেরাপি তৈরি করছেন। কার্ডিওর নামক জার্মনির ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসার জন্য ডিজাইন করা মাইক্রোআরএনএ ইনহিবিটরের দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করছিল। কিন্তু তারা আর্থিকভাবে টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল; ডেনমার্কের কোম্পানি নভো নরডিস্ক গত মার্চে কার্ডিওর কেনার জন্য ১.১২ বিলিয়ন ইউএস ডলার দিতে সম্মত হয়েছে। এটি মাইক্রোআরএনএর প্রতি আস্থার সমুজ্জ্বল প্রতীক। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনো মাইক্রোআরএনএ-ভিত্তিক ওষুধ ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দ্বারা অনুমোদিত হয়নি, কিন্তু আরএনএ-র উপর ভিত্তি করে অন্যান্য ওষুধ অনুমোদিত হয়েছে, যেগুলো প্রায় একই রকমভাবে কাজ করে। ম্যাসাচুসেট্স বিশ^বিদ্যালয়ের ইউম্যাস চ্যান মেডিকেল স্কুলের আরএনএ বিশেষজ্ঞ আনাস্তাশিয়া খভোরোভা সম্প্রতি বলেছেন, ‘আরএনএ ওষুধগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বংশগত উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো জিনগত ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। তাদের এবং মাইক্রোআরএনএগুলির মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে মাইক্রোআরএনএ শরীর দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় এবং প্রায়শই অনেকগুলো জিনের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক মাইক্রোআরএনএ উদ্দীপিত বা দমন করার ফলে যেন অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হয় সে লক্ষ্যে সতর্কভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। নিরাপদ ও কার্যকর মাইক্রোআরএনএ ভিত্তিক ওষুধ আবিস্কার এখনও পিছিয়ে আছে, কিন্তু এটি আসছে, আমি আত্মবিশ্বাসী।’ এমআইআর-৩৪ নিয়ে পূর্বের গবেষণাকারীরা ফিরে এসেছেন, আরো উন্নত প্রযুক্তিতে সজ্জিত হয়ে। একাধিক জিনকে একই সাথে প্রভাবিত করার মাইক্রোআরএনএর যে সক্ষমতা তা টিউমারের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় ভ‚মিকা রাখে বলে তারা বিশ্বাস করছেন। তারা আশাবাদী যে বহুকাল যাবৎ অবাধ্য ক্যান্সার, যেমন প্যানক্রিয়াস অর্থাৎ অগ্নাশয়ের ক্যান্সার চিকিৎসায় তা ফলপ্রসূ হবে। নোবেল পুরস্কার এ বিষয়ের প্রতি আগ্রহে জোয়ার আনবে।

আরএনএ গত বছরও চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কারের বিষয়বস্তু ছিল, যা এমআরএনএ মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে কীভাবে মিথস্ত্রিয়া করে সে সম্বন্ধে বোঝাপড়ায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল। ইমিউন সিস্টেমের দ্বারা এমআরএনএর ধ্বংস এড়াতে একে কীভাবে পরিবর্তন করা যায় তা আবিষ্কার করা হয়েছিল; এটি ছিল কোভিড-১৯ সহ এমআরএনএ ভ্যাকসিন উৎপাদনের চাবিকাঠি। ২০২৩ সালে ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রু উইসম্যানের পুরষ্কারটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের নির্দিষ্ট ব্যবহারের সাথে যুক্ত ছিল; অপরদিকে এই বছরের পুরষ্কারটি আরএনএ তথা মাইক্রোআরএনএর জিন-নিয়ন্ত্রণ কর্মপদ্ধতির মৌলিক বোঝাপড়া আবিষ্কারের সাথে সম্পৃক্ত, যা মানবকল্যাণে বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর বিবিধ প্রয়োগের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গেঁথে দিয়েছে।

বাংলাদেশে জেনিটিক্স বিষয়ক গবেষণায় সাফল্য এখন পর্যন্ত কৃষিবিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বললে অত্যুক্তি হবে না। ধান সহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল শস্য, আয়রন, জিঙ্ক, প্রোভিটামিন-এ সমৃদ্ধ ধান উৎপাদন করা হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে জেনেটিকালি মডিফাইড (জিএম) ফসল উৎপাদন করা হয়েছে, যেমন: বিটি-বেগুন। কিন্তু চিকিৎসা, রসায়ন, পরিবেশ ও অন্যান্য বিজ্ঞানে জেনিটিক্স গবেষণাপ্রসূত ফলাফল দেশের কল্যাণে এখনও সেভাবে কাজে আসেনি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গবেষণা খাতে ফিবছর কয়েক শ কোটি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে রকম কোন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন কোথায়? চিকিৎসকদের নেতৃত্ব দিতে হবে, কিন্তু তাদের বর্তমান পেশাগত জীবনযাপনে গবেষণার সুযোগ বা অনুপ্রেরণা বা উদ্যম যথেষ্ট নয়। সাভারের গণকবাড়িতে রয়েছে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি’ (এনআইবি); সুপরিসর এলাকা জুড়ে নান্দনিক স্থাপত্য সৌন্দর্যমণ্ডিত অবকাঠামোগুলিতে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে, সেখানে জাতীয় জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু জিন বিষয়ক গবেষণায় তাদের অবদানও উল্লেখযোগ্য নয়। চিকিৎসকদের সাথে জিনোমিক্স বিশেষজ্ঞ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, জীবপ্রযুক্তিবিদ, ভাইরোলজিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, বায়োইনফরমেটিকস বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে একটা সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

প্রথম মাইক্রোআরএনএ এ বছরের নোবেল বিজয়ীরা ১৯৯৩ সালে আবিষ্কার করেছিলেন, ঐ সি. এলিগেনসের দেহে; তারা ঐ বছরই নামজাদা জার্নালে দুটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশিত ফলাফল বৈজ্ঞানিক সমাজের কাছে প্রাথমিকভাবে কান বধির করা নিস্তব্ধতার সাথে উপেক্ষিত হয়েছিল। জিন নিয়ন্ত্রণের আবিষ্কৃত অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে তখন কেবল সি. এলিগ্যান্সের একটি বিশেষত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল, মানুষ এবং অন্যান্য জটিল প্রাণীর ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হয়েছিল। এমনকি একে ‘অদ্ভুত’ বলে এবং আরো গুরত্বপূর্ণ আরএনএ অধ্যয়নের উপায়কে তা দুষিত করছে বলেও উপহাস করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল তারা আরেকটা মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করে দেখাক এবং তা যেন পুরো প্রাণীজগতে উপস্থিত পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদ্বয় তির্যক সমালোচনায় দমে যাননি। ২০০০ সালে রুভকুনের গবেষণাদল আরেকটি মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করে, যা লেট-৭ জিন দ্বারা এনকোড করা হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে আবিষ্কৃত মাইক্রোআরএনএ লিন-৪ শুধুমাত্র একটি জিন নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যেখানে ২০০০ সালের লেট-৭ পাঁচটি জিন নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং এটি সমগ্র প্রাণীজগতে উপস্থিত ও সংরক্ষিত ছিল। তারা দেখায় যে, সমস্ত প্রাণীর জীবন ৫০০ মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐ প্রক্রিয়াটির উপর নির্ভরশীল রয়েছে। নিবন্ধটি ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দেয় এবং পরবর্তী বছরগুলিতে শত শত বিভিন্ন মাইক্রোআরএনএ সনাক্ত করা হয়। করোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলি তাদের পুরস্কার প্রদানের ঘোষণাপত্রে উপরোক্ত ঘটনাবলি স্বীকার করে বলেছেন, ‘এখন আমরা জানি যে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মাইক্রোআরএনএর জন্য এক হাজারেরও বেশি জিন রয়েছে এবং মাইক্রোআরএনএ দ্বারা জিন নিয়ন্ত্রণ বহুকোষী জীবের মধ্যে সর্বজনীন’। মাঝখানে কেটে গেল একত্রিশ বছর। মনীষীরা পুরস্কারের লোভে কাজ করেন না। কিন্তু স্বীকৃতি পেতে কার না ভালো লাগে। ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রুভকুন সকর্মক সবুর করেছেন, মেওয়া ফলেছে; যে সে মেওয়া নয়, একেবারে নোবেল পুরস্কার। সমমানের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য আমাদের কতকাল সবুর করতে হয়, কে জানে! আদতে, আমরা কি সবুর শুরু করার মত আদৌ কোন অবস্থানে আছি?

লেখক: অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম