Logo
Logo
×

বাতায়ন

দাম বৃদ্ধির অযৌক্তিক কারণ চিহ্নিত হোক

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দাম বৃদ্ধির অযৌক্তিক কারণ চিহ্নিত হোক

নিত্যপণ্যের দাম যে নতুন করে বেড়েছে এবং তা একযোগে, সেটা নিয়ে কেউ তর্ক করবে না। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাজার কাওরান বাজার পরিদর্শনে গিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টাও বললেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন। ডিম, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য তিনি সরবরাহ সংকটকেই প্রধানত দায়ী করেছেন। এও বলেছেন, সরবরাহে ঘাটতি থাকলে মনিটরিংয়ে খুব একটা সুফল মিলবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যে তিনটি পণ্যের ‘যৌক্তিক দাম’ স্থির করা হয়েছিল, সেগুলোও কিন্তু ওই দামে বিক্রি হচ্ছে না। ‘অতিরিক্ত দামে’ বিক্রির দায়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে জরিমানা করার কিছু ঘটনাও ঘটেছে এর মধ্যে। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। রাজধানী ও বন্দরনগরীর বড় দুই ডিমের আড়তে দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য-বেশি দামে খামার থেকে কিনে ‘যৌক্তিক দামে’ বেচা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ডিমের যৌক্তিক দাম কার্যকরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নতুন করে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; যেটা আবার পরীক্ষামূলক। এর ফল দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। ডিমের সঙ্গে মুরগি ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বাজারে এর সরবরাহ কম।

বাজারে সবজির সরবরাহও কম। এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহণ ব্যয় ও চাঁদাবাজির প্রভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি হচ্ছে না বলেই খবর মিলছে। এ অগ্রগতি টেকসই হবে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে অবশ্য। অতীতেও জাতীয় নির্বাচনের আগে দলনিরপেক্ষ সরকার এলে বা মাঠে সেনাবাহিনী থাকলে এ ধরনের চাঁদাবাজির সাহস কেউ দেখাত না। চাঁদাবাজি তো পুলিশের তরফ থেকেও হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার আমলে পুলিশ অবশ্য নজিরবিহীন চাপে রয়েছে। এর একটা প্রভাব পণ্যবাজারে পড়ার কথা। জ্বালানি তেল, বিশেষত ডিজেলের দামও কিছুটা কমে এসেছে। এ অবস্থায় পরিবহণ ব্যয় অন্তত বাড়ার কথা নয়। মহাসড়কে অবরোধের ঘটনাও কমে এসেছে। সড়ক ও সেতুতে টোল বৃদ্ধির খবরও নেই। এ অবস্থায় সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে আসলে অন্যান্য কারণে।

সাধারণভাবে অনেকে বলেন, বাজারে তো পণ্যের ঘাটতি নেই; তাহলে দাম বাড়ছে কেন? ঘাটতি আছে না নেই, সেটা বুঝতে আমরা কিছুটা নির্ভর করি সরকারি তথ্য-উপাত্তের ওপর। যেমন, ‘ডিমে আমরা উদ্বৃত্ত’ তথ্য দেওয়া হতো। এখন বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, এক্ষেত্রে সম্প্রতি আমরা ঘাটতির শিকার হয়েছি। বর্তমান সরকারের আমলে নতুন করে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে এ প্রেক্ষাপটেই। বিগত সরকার আমলের শেষদিকে শুরু হয়েছিল এ প্রক্রিয়া। তবে কখনোই বিপুল পরিমাণ ডিম একযোগে আনা হয়নি। আনা হচ্ছিল ধাপে ধাপে; নিয়ন্ত্রিতভাবে। ডিমের ওপর আরোপিত উচ্চশুল্কও কমানো হচ্ছিল না। সেটা সম্ভবত এজন্য যে ভারত, চীন, পাকিস্তানে ডিমের দাম আমাদের প্রায় অর্ধেক। বিদ্যমান শুল্ক ও অন্যান্য খরচ দিয়ে আনলেও দেশীয় বাজারের চেয়ে কমে এর আমদানি সম্ভব। শুল্ক কমিয়ে বেশি কম দামে ডিম আনলে আবার স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মার খাওয়ার সম্ভাবনা। তারা তো কম দামে ডিম জোগাতে পারছেন না উৎপাদন ব্যয় বেশি বলে। এসব জটিলতায় পড়ে সরকারকেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতে হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বাণিজ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মতের অমিল থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা কিন্তু ডিম আমদানির বিপক্ষে; বিশেষত ছোট খামারিদের সঙ্গে তিনি একমত। হাসিনা সরকারের সময়ও এ মন্ত্রণালয়ের ছিল একই মনোভাব। তবে ডিমের ডজনপ্রতি দাম ১৮০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেওয়ায় এর কর-শুল্কে ছাড় দেওয়া হবে বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে; যদিও এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত পরিপত্র জারি হয়নি। আমদানিকারকরা হয়তো আছেন এর অপেক্ষায়। ডিমের বাজারে প্রভাব রাখার মতো আমদানিও নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীতেই নাকি প্রতিদিন ডিম লাগে এক কোটি পিস। সারা দেশে চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার কোটি। বেকারিশিল্প আর রেস্তোরাঁয়ও ডিম লাগে প্রচুর। ১৬-১৭ কোটি মানুষের দেশে অবশ্য আরও বেশি ডিম পরিভোগ হওয়ার কথা, বিশেষ করে প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যান্য উৎসে ‘প্রবেশাধিকার’ যেহেতু খুব সীমিত।

একদা পারলেও এখন ভরা মৌসুমেও ইলিশের ধারেকাছে যেতে পারে না সাধারণ মানুষ। হালে ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিপ্রতি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। সোনালি মুরগির দামও বাড়তির দিকে এজন্য যে, এর সরবরাহ কমেছে। কোন পণ্যের সরবরাহ কতটা কমেছে, সেটা বোঝার সহজ পদ্ধতি হলো-ওই পণ্যের মোকাম থেকে সরবরাহ পরিস্থিতি দেখা। খবরে প্রকাশ-বগুড়া ও যশোরের মতো উৎপাদন অঞ্চল থেকে সব ধরনের সবজির সরবরাহ গেছে কমে। কমার চিত্রটি উদ্বেগজনক। এর কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, অসময়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হওয়ায় ‘শীতকালীন আগাম সবজি’র উৎপাদনও মার খেয়েছে এবার। এর মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলসহ তিনটি অঞ্চলে থেকে থেকে যে বন্যা হয়ে গেল, তাতেও সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব অঞ্চল থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিম, মুরগি ও সবজির সরবরাহ হতো বৈকি।

বন্যায় আমনেরও ক্ষতি হয়েছে ওইসব অঞ্চলে। বৃষ্টিবাদলের সময় সেচ তেমন লাগে না বলে এর আবাদ বরাবরই লাভজনক। শহর-বন্দরে বসে আমরা যখন ডিম ও সবজির দাম নিয়ে চিন্তিত, তখন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কিন্তু বিপর্যস্ত ব্যয়সাশ্রয়ী ধানের মৌসুম হারিয়ে। মুরগি আর মাছের খামারিরা ভেঙে পড়েছেন বিনিয়োগ হারিয়ে। বাজারে মাছের দামও কিন্তু নতুন করে বাড়ছে। এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমনকি সাতক্ষীরা বেল্টে অতিবৃষ্টির। এতে খামার গেছে ভেসে; মাছ আহরণ কমেছে। এখন আবার সাগর ও বেশকিছু নদী অঞ্চলে চলছে মাছ শিকারে বিরতি। জেলেদের কিছু খাদ্য সহায়তা জুগিয়ে বছরের পর বছর এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইলিশ আহরণে এটার সুফল মিলছে বলেই মনে করা হয়; যদিও দামে এর কোনো প্রতিফলন নেই। এসব কর্মসূচি চলাকালে বাজারে আবার ‘নদীর মাছের’ সরবরাহ যাচ্ছে কমে। এ মুহূর্তে খামারের মাছের সরবরাহ যখন কম, তখন নদী ও সাগর থেকে এর জোগান কমে এলে সেটা কিন্তু বিপদের।

ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও সবজির দাম বাড়ার সময়টায় বাজারে মাছের যেটুকু সরবরাহ আছে, সেক্ষেত্রে কেজিপ্রতি দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ার খবর কিন্তু রয়েছে। আর কিছু পণ্য রয়েছে ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’। এর মধ্যে পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেল ও চিনির কথা বলা যায়। এগুলোরও কোনো কোনোটির দামে আছে বৃদ্ধির প্রবণতা। এটা দেখেই অন্তর্বর্তী সরকার মাঝে পেঁয়াজ ও আলুর কর-শুল্ক কমিয়েছিল। অন্য দুটি পণ্যেরও শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় পরে। এর কোনো কোনোটির আমদানি হালে ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার যে খবর মিলছে, তা কিন্তু উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক বাজারেও আছে এসবের দাম কিছুটা বাড়ার প্রবণতা। মধ্যপ্রাচ্য সংকটে জ্বালানির বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এসব দিকে সরকারের দৃষ্টি থাকার কথা। এর চেয়ে জটিল পরিস্থিতিতেও আমরা ছিলাম বৈকি।

দেশীয় বাজারে এ কারণেও মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে চড়া। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর এটা কমার প্রবণতা দেখা দিলেও এখন আবার তা বাড়বে। সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির কোনো সূচকের হিসাবেই আর গোলমাল হবে না। সত্যিকার পরিস্থিতি স্বীকার করে তা বলিষ্ঠভাবে মোকাবিলাই সঠিক পন্থা। আর এ সরকারের তো কোনো রাজনৈতিক দল নেই যে তারা আগামী দিনে নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে তাদের রয়েছে সংস্কারের এজেন্ডা। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারটির কাছে রয়েছে বিরাট জনপ্রত্যাশাও। হাসিনা সরকারের আমলে টানা মূল্যস্ফীতির শিকার মানুষ যেমন একটা সহনীয় বাজার দেখতে চায়; তেমনই চায় সময়ে সময়ে বাজার অস্থির হওয়ার প্রকৃত কারণ জানতে। পণ্যবাজার যথাসম্ভব শান্ত করে আনার উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের উচিত হবে এ জনজিজ্ঞাসার সদুত্তর দেওয়া।

দেশে উৎপাদিত কিংবা আমদানিকৃত কোনো ধরনের পণ্যের বাজারই যে সুষ্ঠুভাবে চলছে না, সেটা স্পষ্ট। থেকে থেকে গুরুতর অভিযোগও উঠছে, যার জোরালো তদন্ত কখনো হয়নি। সেটা হলে পণ্যবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির লুক্কায়িত কারণগুলো হয়তো জানা যেত। উৎপাদক, আমদানিকারক আর ভোক্তার মাঝে যে সাপ্লাই চেইন, তাতে ঢুকে থেকে থেকে ওঠা অভিযোগগুলোর সত্যতা খুঁজে দেখা প্রয়োজন বৈকি। অতিসম্প্রতি ডিমের উচ্চদাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় এ দিকটায় সরকারের দৃষ্টি গেছে বলেই মনে হয়। কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তার কিছু লুক্কায়িত কারণ থাকে বৈকি। নজরদারি সংস্থার কাজ হলো সেটা খতিয়ে দেখে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া। বর্তমান সরকার ঘটনা ধরে ধরে এগুলোর কারণ যথাযথভাবে চিহ্নিত করে গেলে পরবর্তী সরকারের জন্যও সেটা হবে বিশেষ সুবিধাজনক। পণ্যের দাম কখনো বাড়বে না, তা নয়। তবে অযৌক্তিক কারণে দাম বৃদ্ধি তো মেনে নেওয়া যায় না।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম