Logo
Logo
×

বাতায়ন

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’: একটি পর্যালোচনা

Icon

মো. আসিফ হাসান রাজু

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১২ পিএম

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’: একটি পর্যালোচনা

ছবি : সংগৃহীত

নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ও বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ২০১৭ সালে প্রকাশিত সাড়াজাগানো বই ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’-এ তিনি পৃথিবীর তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের সমাধানের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। বইটিতে তার আলোচনার বিষয়বস্তু তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে যথা— শূন্য দারিদ্র্য (Zero Poverty), শূন্য বেকারত্ব (Zero Unemployment) এবং শূন্য নিট কার্বন নির্গমন (Zero Net Carbon Emissions)। তিনি মূলত একটি উন্নত, টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের জন্য এই তিনটি শূন্যের লক্ষ্যকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘Zero Poverty’ বা শূন্য দারিদ্র্যের আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য কোনো স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অবস্থা নয়, বরং এটি একটি মানবসৃষ্ট অবস্থা, যা সম্পদের অসম বণ্টনের ফলস্বরূপ তৈরি হয়েছে। 

তিনি বিশ্বাস করেন, দারিদ্র্য নিরসনের জন্য আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। তার মাইক্রোফাইন্যান্স উদ্যোগ, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক, দারিদ্র্য দূরীকরণে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ক্ষুদ্রঋণ, বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। নারীরা এই ঋণগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছেন। তিনি মনে করেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দরিদ্রদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খোলা যাবে, যেখানে লাভের চেয়ে সমাজের কল্যাণ বেশি প্রাধান্য পাবে। তার দ্বিতীয় ধারণা Zero Unemployment বা শূন্য বেকারত্ব। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন— উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থান করা সম্ভব। কেননা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু সঠিক অর্থায়নের অভাবে অনেকেই তাদের সম্ভাবনা পূর্ণ করতে পারেন না। 

ড. ইউনূস তুলে ধরেছেন, যদি মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ ও প্রয়োজনীয় অর্থায়ন দেওয়া যায়, তবে তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটি স্বাবলম্বী জীবিকা গড়ে তুলতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল থেকে আমরা দেখতে পাই— ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করে অনেক মানুষ চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পেরেছেন, যা সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে সহায়ক। 

মূলত ড. ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি হলো— প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে, যা প্রয়োজন সঠিক পরিবেশ এবং সহায়তার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করা। তৃতীয়ত তিনি Zero net carbon emissions  বা পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। 

তার মতে, পৃথিবীর টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক ও শিল্প প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু সামাজিক ব্যবসার উদাহরণ দিয়েছেন, যেগুলো টেকসই উন্নয়ন কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, যদি ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য শুধু লাভ না হয়, বরং পৃথিবীকে রক্ষা করার একটি দায়িত্ব হয়, তবে পৃথিবীর জলবায়ু সংকট অনেকাংশে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’ বইটিতে তিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর ওপর যে দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, আমি মনে করি তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং সময়োপযোগী। 

তিনি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন। বইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো— তিনি জটিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধারণাগুলোকে বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে সহজ করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন কীভাবে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। 

তবে কিছু সমালোচক মনে করেন, ড. ইউনূসের তিনটি শূন্যের লক্ষ্য অত্যন্ত আদর্শিক, তবে এর বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও নিট কার্বন নির্গমনের মতো বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে হলে শুধু একটি দেশ বা অঞ্চল নয়, পুরো বিশ্বের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাইক্রোক্রেডিটের কিছু সীমাবদ্ধতা যেমন উচ্চ সুদের হার এবং ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক চাপ সম্পর্কে বইটিতে তেমন আলোচনা করা হয়নি, যা কিছু পাঠকের দৃষ্টিতে একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

পরিশেষে আমি মনে করি, একটি উন্নত ও টেকসই বিশ্ব গড়ার জন্য বইটিতে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো দেখিয়েছেন, তা প্রচলিত ধারণ্র বাইরে গিয়ে দেখায়, ব্যবসা শুধু লাভের জন্য নয়, বরং মানুষের কল্যাণ ও সমস্যা সমাধানের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

লেখক: শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এইউবি) 

ইমেইল: ahrazu@aub.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম