Logo
Logo
×

বাতায়ন

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস

কাঙ্ক্ষিত সংস্কার টেকসই হতে হবে

Icon

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাঙ্ক্ষিত সংস্কার টেকসই হতে হবে

সদাশয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে এবং ছয় কমিশনপ্রধানের নামও ঘোষিত হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা বলেছেন, গণমাধ্যমের সংস্কার নিয়েও কমিশন হবে। ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণার পর গণমাধ্যম, চিকিৎসা ও শিক্ষা বিষয়েও কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য-চিকিৎসা দুটিই বড় খাত; ফলে এ দাবি ওঠার যৌক্তিকতা আছে। পালিয়ে যাওয়ার আগে পূর্বতন সরকার গণহত্যা তদন্তকরণার্থেও একটি কমিশন গঠন করেছিল; তা নিয়ে এখন আর আওয়াজ লক্ষ করা যায় না। সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুমের ঘটনা তদন্তেও একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে-হাইকোর্টের জজ মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ কমিশনের প্রধান। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র তুলে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত ১২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য; এ কমিটি আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়েও রিপোর্ট করবে বলে কমিটির প্রধান জানান দিয়েছেন। একজন বলতেই পারে, কমিশনের সয়লাব চলছে এখন।

একনজরে ছয় কমিশন হচ্ছে, বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ সংস্কার, বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কার, ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন সংস্কার, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার, আলি রিয়াজের নেতৃত্বে (প্রথমে শাহদীন মালিক) সংবিধান সংস্কার কমিশন। সরকারপ্রধান কমিশনের কাজের জন্য নব্বই দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন।

এ কথা অনস্বীকার্য, এ সমাজ তথা রাষ্ট্র ও সরকারের নানা সংস্কার দরকার। ছয়টি বিষয়ে ঘোষিত কমিশনের বাইরেও বৃহত্তর পরিসর রয়েছে। আবার এ কথা আসবে, একটি অনির্বাচিত তথা জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়া সরকারের পক্ষে কতটা সংস্কার করা সম্ভব হবে। সংস্কার নিয়ে মোটা দাগে দুটি কথা বলাই যায়-প্রথমত, অনির্বাচিত সরকার হিসাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে যাবে কি না কিংবা সেটা সমীচীন হবে কি না অথবা ততটা সময় সরকার নেবে কি না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে থাকা রাজনৈতিক দল এ সরকারকে সংস্কারের জন্য কতটা সময় দেবে? ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৭ সালের অনির্বাচিত-অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল একটি নির্বাচন করে সরে দাঁড়ানো, যদিও ২০০৭ সালের সরকার একটু বেশি সময়ই নিয়েছিল। কিন্তু এবারের অন্তর্বর্তী সরকারকে কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে সরে গেলেই হবে না; বরং কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার করেই নির্বাচন দিতে হবে। ছয়টি কমিশনের একেকটির একাধিক সুপারিশ থাকবেই। প্রশ্ন আছে, অন্তর্বর্তী সরকার সেসব সুপারিশের সবকটিই বাস্তবায়নের দিকে যাবে কি না। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক, সেনাপ্রধান সরকারের মেয়াদ সম্বন্ধে একটা ধারণা দিয়েছেন। আবার সেটার ব্যাখ্যা নিয়েও কথা উঠেছে। আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচন, নাকি সংস্কারের পর আঠারো মাস! আবার ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন রিপোর্ট দিতে পারলেও সেই আলোকে সংস্কারের সময়টাই বা কতদিনের! সরকার এ ব্যাপারে ঝেড়ে কাশছে না।

মানুষের স্বল্প সময়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা এ সরকারের কাছে এবং বাস্তবে জনগণ নির্বাচনের জন্য খুব হাপিত্যেশ করছে না। কিন্তু কতগুলো বিষয়ে জনআকাঙ্ক্ষা আছেই। সেই প্রত্যাশা নির্বাচিত সরকারের চেয়ে এ অন্তর্বর্তী সরকার পূরণ করুক, এটাই জনআকাঙ্ক্ষা। নির্বাচন বিষয়ে সংস্কার লাগবেই; কেননা, বিগত সরকারের পনেরো বছরে তিনটি ক্ষেত্রে চরম অভিঘাত এসেছে, সেগুলো হলো নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়া, দুর্নীতির ব্যাপকতা আর সর্বস্তরে দলীয়করণ। সর্বস্তরে দলীয়করণের ব্যাপারটি নির্বাচনের পরিসরকেও আঘাত করেছে এবং বাকিটা যাবে প্রশাসন-পুলিশ সংস্কার কমিশনের দিকে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনব্যবস্থায় আদতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানুষ ভোট প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোটের আয়োজনই কেবল মানুষকে ভোটমুখী করতে পারে। এজন্য নির্বাচন কমিশনসহ ভোটের সব স্তরে সংস্কার দরকার হবে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ অবস্থা থেকে যথার্থ অর্থেই মুক্তি দিতে হবে। ভোটের সঙ্গে জড়িত সব মেশিনারিজকেও সুষ্ঠু ভোটের জন্য প্রস্তুত করার প্রস্তাব থাকবে কমিশনের সুপারিশে। বলতেই হবে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দলীয় বিবেচনায় মনোনয়ন এবং দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। দেশের সব মানুষকে কেন রাজনীতির মধ্যে টানতে হবে, তা বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বদ মতলব ছিল। গ্রাম-বাংলার আবহমান সংস্কৃতির ধ্বংস ডেকে এনেছে ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌরসভার নির্বাচন দলীয়ভিত্তিতে করার কারণে। এই কমিশনের প্রধান জনাব বদিউল আলম মজুমদার দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কথা বলছেন, ফলে গণমানুষ অপেক্ষায় থাকবে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে উন্নয়ন প্রশাসনের স্লোগান জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও জনপ্রশাসন, পুলিশ এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সেক্টর সেভাবে জনমুখী হতে পারেনি। বরং সর্বত্র সেবার মান পড়ে গেছে; ক্ষেত্রবিশেষে সেবাপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে, হচ্ছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সম্মুখীন। পুলিশি সেবার আরও অধোগতি হয়েছে। মোটের ওপর আমলাতন্ত্রকে জনবান্ধব বলার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। অথচ তাদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েই চলছে। এহেন অবস্থায় বিগত পনেরো বছর সরকারি কর্মীদের দলীয় ছাতার নিচে আনা হয়েছে কিংবা সরকারি আধিকারিকরাই ওই ছাতার দিকে ছুটে গেছে। বুঝবার আছে-এক. ২০১৮ সালের নির্বাচন আমলাদের হাত দিয়েই হয়েছে। বলা হয়, মুখ্যত পুলিশ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেও জনপ্রশাসন আর সেই সঙ্গে সব সেক্টরের কর্মচারীর ঢোল-তবলা বাজিয়েছে। একটি সরকার পড়ে যাওয়ার পর আমলাদের বর্তমান দুর্গতি অতীতে দেখা যায়নি। পুলিশকে এভাবে পিছু হটতে কবে দেখা গেছে? ফলে সংস্কার এবং ব্যাপক সংস্কার লাগবেই। কিন্তু জনপ্রশাসন এবং পুলিশের বর্তমান আইনবিধি বদলে সেটা কতটা এবং কতদিনে করা সম্ভব হবে!

মুয়ীদ চৌধুরী ভূমি ও ভূমি রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে একটি কমিটির প্রতিবেদক; সেই প্রতিবেদনে চমৎকার কিছু সুপারিশ থাকলেও সাবরেজিস্ট্রারদের আপত্তির কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। মুয়ীদ চৌধুরী যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা-সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন সিএসপি আমলা। বহুজনের আশঙ্কা, জনপ্রশাসন সংস্কার সুপারিশে সেই সিএসপি ধাঁচ চলে এলে বাস্তবায়ন কঠিনই হবে। অপরদিকে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব সফর রাজ ভালো সুপারিশ করবেন বলেই প্রত্যাশা। কিন্তু আমলাতন্ত্রের প্রচলিত আইন-বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য না হলে আইন-বিধিও বদলাতে হবে। কবে আর কখন তা হবে?

দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যপরিধি প্রজ্ঞাপন জারি না হলে কমিশনের কাজ স্পষ্ট হবে না। দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন দিয়েই দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। দরকার কমিশনের সদিচ্ছা। দরকার দুদককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা। কমিশনের সুপারিশ যাই-ই হোক, একটি সরকার না চাইলে দুর্নীতি একরত্তিও কমবে না। দুদক, কর-শুল্কের গোয়েন্দা সেল এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বর্তমানেই কিন্তু দুর্নীতির অতলে নেমে গেছে দেশ। তো? বিচার বিভাগের সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই কথা বিবেচনাযোগ্য। জুডিশিয়াল সেপারেশনের পর এ বিভাগের কতটা উন্নতি হয়েছে, সে পর্যালোচনা করা আবশ্যক। সরকার বলেছে, কোনো হস্তক্ষেপ নেই। মানুষ দেখেছে ঠিক বিপরীত চিত্র। এ মতদ্বৈধতার মীমাংসা কীভাবে? আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হলেই বিচারালয়ে সুবাতাস বইবে, তাই কি? উচ্চ আদালতের নানা আদেশ নিয়ে তো প্রশ্ন উঠেছে। বলা হয়েছে, সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল, নয়তো ছিল সরকার পক্ষের গাফিলতি। তারপরও এ সংস্কার নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। বলা আবশ্যক, কোর্ট-কাচারি মানুষের ভোগান্তির জায়গা, যেখানে হয় না যথাসময়ে মামলার নিষ্পত্তিকরণ। এসবই তো মানুষের চাওয়া। এর একটিও যদি নিরসন হয়-কমিশন সার্থক হবে।

সংবিধান সংস্কার নিয়ে কাজ শুরুর আগেই নানা মত উঠে এসেছে। বিশেষত, কমিশনের প্রধান সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছেন। কমিশনের প্রধান হিসাবে নাম ঘোষিত হওয়ার পর জনাব আলী রিয়াজের বক্তব্য সেভাবে আর আসেনি। সংবিধান পুনর্লিখন, নাকি খোলনলচে বদল, কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কার অথবা নির্বাচনসংক্রান্ত ধারাগুলোর সংস্কার-বিতর্ক আছেই। নিশ্চয়ই কমিশনের সদস্যরা নানাজনের মতামত গ্রহণ করবেন। তবে একটি সংবিধান পুনর্লিখনের যন্ত্রণা বহুবিধ, পদ্ধতিও জটিলতর। একটি সংসদ বিদ্যমান অবস্থায় আরও একটি নির্বাচন, নির্বাচনকালে একটি অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনই হয়তো এখনকার প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদহীন একটি সরকার ঠিক কী প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার করবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ডকট্রিন অব নেসেসিটি দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা যাবে কি?

মোটা দাগে স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও বৈষম্য বিলোপ এবং দলীয়তন্ত্রের বাইরে থাকাই জুলাই অভ্যুত্থানের বড় দাবি। ছয়টি কিংবা আরও বেশিসংখ্যক কমিশনের নানা সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রত্যাশা কিছুটা বাস্তবায়ন হয়তো করলই, কিন্তু এর পরের রাজনৈতিক সরকার সেটি না চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সব আবার আগের অবস্থায় যাতে ফিরিয়ে নিতে না পারে, সেজন্য এ সংস্কারটি অতি জরুরি। কেননা, পঞ্চাশ বছর ধরেই জাতি রাজনৈতিক সরকারের চরিত্র দেখে অভ্যস্ত। ১৯৭২ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক সরকার কাঙ্ক্ষিত ভোটব্যবস্থা করে যায়নি। সবাই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে মরিয়া ছিল। ফলে একটি সংস্কার যদি হয়, তা যাতে রাজনৈতিক সংস্কার বদলে দিতে না পরে, সেই সংস্কার চাই-অন্যথায় লাউ আর কদু তো একই; যে পাত্রে আর যেভাবেই রান্না করা হোক না কেন। মনে রাখা আবশ্যক, চাইলেই কাল বা পরশু আরেকটি জুলাই অভ্যুত্থান ঘটবে না। ফলে এখনই উপযুক্ত সময়।

মোহাম্মদ আবদুল মাননান : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম