Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্বসভায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিক্ষিপ্ত বাংলাদেশ

Icon

মারুফ কামাল খান

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০৮ পিএম

বিশ্বসভায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিক্ষিপ্ত বাংলাদেশ

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রায় ষোলোটি বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অপ্রতিরোধ্য দুঃশাসন চালিয়েছেন। সব শেষে দেশের সহস্রাধিক সোনার ছেলেকে নৃশংসভাবে খুন করে এবং হাজার হাজার ছাত্র-তরুণকে বিকলাঙ্গ করে, জখম করে, অন্ধ করে দিয়েও ক্ষমতার কুরসি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। সবাইকে ফেলে নিজের জান নিয়ে ভারতে পালাতে হয়েছে। কারণ, সারা দুনিয়া তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভারত ছাড়া কেউ তাকে ঠাঁই দিতে রাজি হয়নি।

এই যে অমোঘ পরিণাম, অবশ্যম্ভাবী পরিণতি; এর জন্য হাসিনা ও তার দোসর-অনুচর-সুবিধাভোগীদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা, গ্লানিবোধ, ভুলস্বীকার ও শোধরাবার প্রবণতা, ক্ষমাপ্রার্থনা, আত্মসমালোচনা কিংবা আত্মশুদ্ধির কোনো আলামত কেউ লক্ষ্য করেছেন কি? না, তার সম্ভাবনাও নেই। তারা সেই ধাত ও জাতেরই নয়। তার বদলে এখনো তারা অন্যের দোষ খোঁজা, অপরের নিন্দা-সমালোচনা এবং 'আমরাই ভালো ছিলাম' এই আত্মম্ভরিতাভরা প্রচারণায় লিপ্ত। ওরা এখনো মনে করে যে, প্রোপাগান্ডা, চক্রান্ত, নাশকতা, অন্তর্ঘাত চালিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন অবস্থানে থাকা তাদের অনুগ্রহভাজনদের ওপর ভর করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করে, আর সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে তারা ক্ষমতায় চলে আসতে পারবে। এই অলীক দূরাশা তাদের কপালের ভোগান্তিকে দীর্ঘায়িত ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।

গণবিপ্লব, আর্মি ক্যু ও নির্বাচনে জেতা ছাড়া ক্ষমতায় আসার কোনো রাস্তা খোলা নাই। এর কোনোটাই আওয়ামী লীগের পক্ষে অর্জন করার কোনো সুযোগ অদূর ভবিষ্যতে নেই। কাজেই তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার আশায় আপাতত গুড়ে বালি। এখন তাদের মূল কৌশলই হবে টিকে থাকার মতো একটা সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা। তারপরও পুরনো ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতিকে সম্বল করে এদেশে আর কখনো আওয়ামী লীগের উত্থান সম্ভব কিনা তা নিয়ে আমার ঘোরতর সংশয় রয়েছে। তবে ওরা জুতার সুখতলার নিচে থেকে মাথা উঁচানো সুচালো পেরেকের মতো অনেকদিনই খোঁচাতে ও যন্ত্রণা দিতে থাকবে।

গত জুলাই-আগস্টের সফল ছাত্র-যুব-গণজাগৃতি বাংলাদেশকে যেভাবে বদলে দিয়েছে সেই বাংলাদেশকে আর অতীতের পুরনো কোনো খোপে ঢোকানো যাবে না। একসময় রাজাকার গালি দিয়ে যে-কোনো দাবি, আন্দোলন ও সমাজশক্তিকে অবদমিত করে ফেলা যেতো। এটা ছিল মস্ত এক রাজনৈতিক অস্ত্র। এবার নয়া প্রজন্মের ছাত্র-জনতা সেই গালি ও অপবাদের বিপরীতে 'তুমি কে আমি কে রাজাকার' ধ্বনি দিয়ে সেই মোক্ষম অস্ত্রকে অকেজো ও ভোঁতা করে দিয়েছে। এ রকম আরো অনেক আবেগাশ্রয়ী ধ্বনি ও রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইলের বোলচালও ক্লিশে হয়ে গেছে। সেগুলো ব্যবহার করে আর ফায়দা হাসিল করা যাবে না। এই পরিবর্তিত বাস্তবতা না বুঝে গো ধরে থেকে পুরনো ধারার দলগুলো বস্তাপচা কৌশলের পুনরাবৃত্তি করতে গেলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত কমতেই থাকবে।

তিনি কতদিন থাকবেন জানি না, তবে এই পরিবর্তন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তিত্বকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অর্থনীতিজ্ঞ এই শিক্ষাবিদ কখনো কোনো রাজনৈতিক ধারা বা দলে সমর্পিত হননি। তিনি যা করেছেন একান্ত নিজস্ব উদ্যোগ বা উদ্যমেই করেছেন। প্রবাসে থেকে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন তার একাডেমিক কর্তব্যের বাইরের কার্যক্রম। তারপর থেকে নিরলসভাবে চলতে থাকে দেশের এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে তার প্রয়াস ও উদ্যোগ। এই আন্তরিক কর্মনিষ্ঠা তাকে তুলে ধরেছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বপরিসরে। তিনি যেখানেই যান সেখানেই ক্ষমতাশীর্ষের ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ছুটে এসে তাকে সম্মান জানান। সাধারণ ফতুয়া-পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ও সাদাসিধা কটি আচ্ছাদিত ঋজুদেহী সদা হাস্যমুখের এই অধ্যাপককে সারা দুনিয়া শ্রদ্ধার আসনে বসালেও ক্ষমতার মদমত্ততায় হাসিনা তাকে ক্রমাগত হেনস্তা ও অপমান করে গেছেন। এর মাধ্যমে সারা দুনিয়ার চাইতে হাসিনা বেশি বুঝেন - এই দাম্ভিক বার্তা দিতে চেয়েছেন সবাইকে। হাসিনার এই অপরিণামদর্শিতা ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরো প্রসারিত এবং তার মর্যাদাকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বদেশেও তিনি হয়ে উঠেছেন নতুন প্রজন্মের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের অধিষ্ঠান এক ঝটকায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্ট্যাটাস বদলে দিয়েছে, অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। ড. ইউনূস ব্যাকরণ, ছক, গণ্ডি, বৃত্ত ও বলয় মেনে চলার মানুষ নন। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রচলিত বৃত্ত, চেনা বলয় ভেঙে এগিয়েছেন। তৈরি করেছেন নতুন পথ। রাজনীতি এবং রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায়ও তিনি এসেছেন নতুন পথ ধরে এবং সাবেকি ছকের বাইরে গিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। উচ্চকণ্ঠ না হয়ে এবং অতিকথন এড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার আকাঙক্ষায় স্পর্ধিত করে তুলেছেন। তারা আর তাদের মনের কথা ও দাবি অকপটে বলতে দ্বিধা করেনা। তাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকেও অনেক বড়ো করে তুলেছেন তিনি। এদেশের মানুষ আর খুব অল্পে তুষ্ট থাকবেনা। বিশ্বভূগোলে বাংলাদেশের এই যে স্ট্যাটাস বদল এবং জনগণের স্বপ্নের এই যে ঊর্ধচারিতা, পুরনো ধারার রাজনীতি দিয়ে কি আগামীতে তা ধরে রাখা যাবে? না হলে মানুষ কি তা মানবে?

বাংলাদেশের হাসিনাকালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দেড়শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিককে চাকরিচ্যূত করে দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওরা হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আমিরাতের আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকায় তার অফিসে বসে ফোনটা তুলে ইউএইর প্রেসিডেন্টকে বললেন, আমাদের দেশের অনেক নাগরিক আপনার দেশে কারাদণ্ড ভোগ করছেন। আমার অনুরোধ আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন, মুক্ত করে দিন।

বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে ছুটে যেতে হয়নি। ঢাকায় বসে তার একটি ফোনেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়ে গেল। আমিরদের বিত্তের গৌরব ও রাজতান্ত্রিক অহঙ্কারের কথা আমরা জানি। কিন্তু সম্পদহীন ও হীনবল একটি মিসকিন দেশে সদ্য ক্ষমতাসীন রাজকীয় ঐতিহ্যহীন একজন সরকারপ্রধানের একটা ফোনকল এভাবে বরফের পর্বত গলিয়ে ফেলবে, এমনটা অতীতে ভাবাও দুঃসাধ্য ছিল।

পরের পর্ব জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের। সেখানে আমাদের ড. ইউনূস যা করলেন তার বিবরণ দিতে ল্যাটিন সেই প্রবাদটিই উচ্চারণ করতে হয় : 'ভেনি, ভিডি, ভিচি' - আমি এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম।

বায়োলজিক্যালি চুরাশি বছর বয়সি একজন তরুণ জাতিসংঘে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে যে গতি, ক্ষিপ্রতা ও ডাইনামিজম দেখালেন এবং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটলেন তা বিষ্ময়-জাগানিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সব প্রোটোকল ও রীতি ভেঙ্গে জাতিসংঘ সদর দফতরে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসলেন এবং পরম আন্তরিকতায় জড়িয়ে ফটোশট দিলেন, এটা অকল্পনীয়। শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নয়, শক্তিমন্ত রাষ্ট্র থেকে শুরু করে গরিব-দুনিয়ার প্রতিনিধিরা পর্যন্ত প্রায় সব দেশের নেতারাই তার সঙ্গে বসতে, ছবি তুলতে প্রদর্শন করেছেন পরম আগ্রহ। তিনি হয়ে উঠেছিলেন যেন এবারের অধিবেশনের মধ্যমণি। এই কৃতিত্ব তার একান্ত নিজস্ব হলেও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তিনি আমাদের অবহেলিত দেশটিকেও বিশ্বসভায় কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসেবে অভিক্ষিপ্ত বা প্রোজেকটেড করেছেন। বাংলাদেশের স্ট্যাটাস তিনি অনেক ধাপ উঁচুতে তুলে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত পার্সোনা, ক্যারিশমা ও গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে এই অধিবেশনকালে ড. ইউনূস দেশের স্বার্থে যা যা অর্জন করেছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে তুলনারহিত। এর মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা ও বাংলাদেশের অবস্থানকে তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছালেন সেখান থেকে আর অধোগতিকে কি ভবিষ্যতে মানতে চাইবে দেশের মানুষ?

দেশে ফেরার পর অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের নতুন নেতার সামনে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বল্পতম সময়ে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ  ড. ইউনূসকে সমাধা করতে হবে তার জন্য যোগ্য, উপযুক্ত ও লাগসই টিম বাছাইয়ের সুযোগ ও অবকাশ তাঁর হয়নি। তার নিজের কর্মধারা বৈপ্লবিক ও উদ্ভাবনী হলেও তার টিম হয়েছে ঢিমেতালের গতানুগতিক ধারার। অনেকেই অবসরকালীন মেজাজে রুটিন ও ফাইল ওয়ার্কে সময় পার করতে এসেছেন। অনেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একটা নির্বাচন করে দিয়ে চলে যাওয়াকেই নিয়তি ধরে সরকারে এসেছেন কেউ কেউ। এ সরকারকে যে-সব নীতিনির্ধারণী দায়িত্ব পালন ও সংস্কার কাজ সমাধা করতে হবে এবং নানামুখি যে-সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, সে-সবের জন্য মানসিক প্রস্তুতি তাদের নেই। তারা জানেন না যে, প্রাতিষ্ঠানিক কতকগুলো শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে না গেলে পরের নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার মুখ থুবড়ে পড়বে। 

ড. ইউনূসের টিমের দুই-চারজন বাদে বেশিরভাগেরই গতিশীলতা, নেতৃত্বের গুণাবলী, স্মার্টনেস ও আধুনিকতারও অভাব রয়েছে। এই টিমকে ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার উপযোগী করাটা খুব দরকার। না হলে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চলতে পারবেন না এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পিছিয়ে পড়বে।

বর্তমান সরকারের পাওয়ার হাউস হচ্ছেন ড. ইউনূস নিজে এবং সশস্ত্রবাহিনী। আন্দোলনে বিজয় অর্জনকারী ছাত্র-তরুণেরা এ সরকারের ভ্যানগার্ড। এই ত্রিশক্তির সঠিক সমন্বয়, বিন্যাস ও প্রয়োগের মাধ্যমে ইপ্সিত লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবে। কোনো পক্ষই যেন বেশি কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও বাড়াবাড়ি না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে আস্থায় রাখতে হবে। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল ও সমাজশক্তি সমূহের সঙ্গে নিবিড় সমঝোতা ও কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নে চুক্তির মাধ্যমে অনাবশ্যক উৎপাত ও অস্থিরতা এড়াতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আজ যেখানে পৌঁছেছে, মানুষের প্রত্যাশা যে চূড়া স্পর্শ করেছে, সেই নতুন বাংলাদেশকে আর পুরনো খাপের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলা যাবে না। 

লেখক পরিচিতি: মারুফ কামাল খান, সাংবাদিক ও লেখক;বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেসসচিব।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম