মারুফ কামাল খান। ফাইল ছবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাঙলা' গানটি আমার কাছে বড়ই সুমধুর লাগে। এ গান আমার পরাণের অথৈ গহিনে নাড়া দেয়। আবেগ সঞ্চার করে। আমি এ সংগীতে আলোড়িত, আন্দোলিত ও প্রাণিত হই। কিন্তু এ গান তো সবার মধ্যে সমঅনুভূতি সৃষ্টি করে না। অনেকের কাছেই এ গান ম্যাড়মেড়ে, এর সুর আবেদনহীন ও পানসে লাগে। এই গানের বাণী আমার মতো সবার প্রাণে আবেদন সঞ্চার করে না। তো কী করতে হবে? জোর করে কোনো কিছু কাউকে তো ভালো লাগানো যায় না।
এই যে আবেগের কথা বললাম, সেই আবেগ সবার সমান না। তাছাড়া আবেগের ব্যাপারটা সময়, পরিস্থিতি, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার ওপরেও অনেকটা নির্ভর করে। মানুষের বেড়ে ওঠার পরিবেশ এবং তার আদর্শ, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিও আবেগকে প্রভাবিত করে। আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের লোক তাদের বেশিরভাগের আবেগ এবং নতুন জেনারেশনের আবেগ, অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস সবক্ষেত্রে এক নাও হতে পারে। আর এই এক না হলেই যে সব কিছু উচ্ছন্নে গেল, এমন নয়। আর এক না হলেই যে শোরগোল তুলতে হবে, মাতম সৃষ্টি করতে হবে- এটাও কোনো সভ্যতা ও আধুনিকতার লক্ষণ নয়।
দীর্ঘকাল ধরে ফ্যাসিবাদ-কবলিত ও স্বৈরাচার-শাসিত দেশে-সমাজে-পরিবেশে বসবাস করতে করতে আমাদের মধ্যে খুবই টোটালিটারিয়ান বা সর্বগ্রাসী কিছু মনোভঙ্গি শেকড় গেড়ে বসেছে। আমরা নিজের মতবাদ, ধারণা, অনুভূতি ও আবেগের বিপরীত কোনো কিছুই সহজভাবে নিতে পারি না। আমরা উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠি এবং উৎকট প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি।
অথচ রবিঠাকুরই আমাদের পরামর্শ দিয়ে গেছেন-
"মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।"
আমার মতবাদ ও অনুভূতি যেমন সত্য, ঠিক তেমনই অন্যের মতবাদ ও অনুভূতিও সমান সত্য। তাই সবার মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখানো এবং প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এবং সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে যে মতামত ও অনুভূতি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে তাকে গ্রাহ্য করা ও মেনে নেওয়াই গণতন্ত্রের দাবি।
আমাদের দেশের পাকিস্তানি পর্বে যে রাজনীতি ও সংস্কৃতির চর্চা চলেছে তাতে শাসক আর শাসিতের অনুভূতি বিপরীত হয়ে উঠেছিল। শাসকেরা রবীন্দ্র-সাহিত্যকে পাকিস্তানি তাহজিব-তমুদ্দুন পরিপন্থি বিবেচনা করে নিরুৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করলে শাসিতেরা রবিঠাকুরকেই নিজস্ব সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রূপে আঁকড়ে ধরেছিল। জননায়ক মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পর্যন্ত রবিঠাকুরকে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন। এমনকি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যে মানবতার বাণীর সন্ধান পান। যদিও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মিত্র হিসেবে নিপীড়ক পংক্তিভুক্তই ছিলেন।
পাকিস্তান-পর্বের সেই ধারায় মুক্তিযুদ্ধকালে রবীন্দ্রসাহিত্য আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষকেই উদ্দীপ্ত করেছে। স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবিঠাকুরের 'আমার সোনার বাঙলা' গানকে আমরা সাদরেই গ্রহণ করেছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম সেই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট নয়। তাদের অনুভূতিও আমাদের অনুরূপ নয়। কাজেই জাতীয় সংগীত হিসেবে রবি ঠাকুরের ওই গানকে তারা সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখতেই পারে। এতে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। এমনকি ওরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে জাতীয় সংগীত বদলেও ফেলে তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। গরিষ্ঠের মতামত ও সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে আমাদের মধ্যে।
আমার সোনার বাঙলাকে জাতীয় সংগীত রূপে বহাল রাখার ব্যাপারে শহিদ রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মনোভাব ছিল অনড়। গত দুই দশক ধরে আওয়ামী প্রচারবিদেরা কল্পিত ও ভিত্তিহীন নানান কাহিনী ও রটনা অবাধে ও অবিরত প্রচার করে জিয়াউর রহমানকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ব্যর্থ উদ্যোক্তা হিসেবে চিত্রিত করার হীন-অপপ্রয়াস চালিয়েছে; কিন্তু ইতিহাসের প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তিনি তার সময়ে উত্থাপিত জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সব দাবিকে দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেছেন।
১৯৭৮ সালে এদেশে প্রথমবারের মতো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের একজন প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান ভোটের আগে ৭ মে এক সংবাদ-সম্মেলন করেন। পরদিন তার বিবরণ দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদ-সম্মেলনে জিয়াউর রহমানকে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা বদলের ব্যাপারে কতিপয় লোকের দাবির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়।
জবাবে তিনি বলেন- ‘এগুলো খুবই গুরুতর বিষয় এবং হালকাভাবে তা আলোচনা করা উচিত নয়। জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়েছে এবং এগুলো থাকবে। ‘
শহিদ জিয়া তার নিজের অনুভূতি এবং সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে ওই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দুই-একজন প্রার্থীও জাতীয় সংগীত বদলকে তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তারও আগে খোন্দকার মোশতাক আহমদের সরকার জাতীয় সংগীত বদলের একটি উদযোগ সময়াভাবে সম্পন্ন করে যেতে পারেনি। তৎকালে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎপর ছিল। তারা ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিন দিনব্যাপী এক সিরাত সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব।
সম্মেলনে অধ্যাপক গোলাম আযমের লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনানো হয়। দাবি ওঠে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা বদলের। স্লোগান দেওয়া হয়- ‘তাওয়াব ভাই-চাঁদতারা পতাকা চাই’। জিয়াউর রহমানকে তখন ভারতীয় আধিপত্য মোকাবিলার সঙ্গে যুগপৎভাবে পাকিস্তানিকরণের প্রচেষ্টাকেও রুখে দিতে হয়েছিল।
জাতীয় সংগীত বদলের দাবি ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্টেও তুলেছিলেন তৎকালীন আইডিএল নেতা মওলানা আবদুর রহীম। জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনৈতিক দলবিধির (পিপিআর) আওতায় জামায়াত নামে দল গঠনের অনুমতি না পেয়ে তারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সরকার সংসদে তোলা তাদের প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছিলেন।
অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র আবদুল্লাহিল আমান আযমী সম্প্রতি জাতীয় সংগীত বদলের সেই তুফান-তোলা দাবি পুনরায় তুলেছেন। আযমী বাংলাদেশ আর্মিতে খুব মেধাবী ও চৌকস অফিসার ছিলেন। গোলাম আযমের ছেলে বলে আওয়ামী সরকার ব্রিগেডিয়ার থাকা অবস্থায় তাকে চাকরিচ্যুত করে। পরে তাকে অপহরণ করে কুখ্যাত আয়নাঘরে এক দশক বন্দি করে রাখা হয়। এই জঘন্য নিবর্তনের শিকার হবার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এবং দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রবল সহানুভূতি পেয়েছেন।
আযমী দলীয়ভাবে জামায়াতের কেউ নন। অবশ্য জামায়াতের অন্তর-লালিত একটি দাবিই তিনি তুলে ধরেছেন। তবে রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে অনভিজ্ঞ লোক হিসেবে এই দাবি কতটা সময়োচিত হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
দল হিসেবে জামায়াত এখন উদারনৈতিকতার পরিচয় দিতে মরিয়া। তারা ইউরোপ-আমেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য হবার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে একটি ওয়ার্কিং রিলেশন স্থাপন এবং একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চাইছে তারা। এ সময় আযমী জাতীয় সংগীত বদলাবার পুরোনো দাবি তুলে দলটিকে বিব্রত করলেও সেটা তারা প্রকাশ্যে বলতে পারবে না। তবে এ দাবির বিরুদ্ধে বামপন্থি কালচারাল সংগঠনগুলো সোচ্চার হবে এবং তাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগও মাঠে নেমে পড়ার সুযোগ নিতে পারে। একটি অপ্রধান ইস্যুকে এই মুহূর্তে সামনে আনা কতটা হঠকারিতা হয়েছে তা সময়ই বলে দেবে।
জামায়াত এখনো এ দেশের মূলধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই বলে সমাজে তাদের মতামত অবাধে তুলতে বাধা দেওয়ার অবকাশ থাকা উচিত নয়। আবার তাদের মতামতের বিরোধিতা করার অধিকারও সবার আছে। তবে তার প্রকাশ শোভন, সুন্দর ও গণতান্ত্রিক পন্থায় হওয়া উচিত।
শুধু জাতীয় সংগীত নয়, কোনো ব্যাপারেই আমাদের ভাবনা অনড় ও নিশ্চল হওয়া উচিত নয়। পরিবর্তনশীলতা ও যুগের দাবিকে মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের থাকতে হবে। রবিঠাকুরের গান বাংলাদেশ ও ভারত এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত; কিন্তু দুটি গানের কোনোটিই জাতীয় সংগীত হিসেবে রচিত হয়নি।
রবিঠাকুরের 'জনগণমন-অধিনায়ক ভারত ভাগ্যবিধাতা' গানটিকে ভারত স্বাধীন হবার আগেই সেদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন নেতাজী সুভাস বসু। উপনিবেশ ভারতে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে তার মহিমাকীর্তন করে রচিত এই গান যেন জাতীয় সংগীত না থাকে সে ব্যাপারে ভারতে এখনো অনেকেই অবিরাম দাবি করে যাচ্ছেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রচিত 'আমার সোনার বাঙলা' গানটিও বর্তমান বাংলাদেশের মানুষদের স্বার্থবিরোধী অবস্থান থেকে রচিত বলে অনেক সমালোচকের অভিমত।
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে রবিঠাকুরের বিরোধিতা থেকে উৎসারিত জাতীয় সংগীত বদলের দাবিকে আমরা অগ্রাহ্য করতেই পারি। তবে আরও অনেক কারণকে যুক্ত করে সময়ের দাবি মেটাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠে যদি কখনো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বদলের দাবি ওঠে তখন আমরা কি তাকে শুধু আবেগ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারব?
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব।