নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে রুয়ান্ডা ডকট্রিন : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
সম্রাট মোঃ আবু সুফিয়ান
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০২ এএম
ফাইল ছবি
"পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশি অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে"- নেলসন ম্যান্ডেলা। আজ বাংলাদেশ এমন একটি ক্লান্তিকালে অবনীত হয়েছে যেখান থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে আলোর পথে দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে ম্যান্ডেলা এবং রুয়ান্ডা ডকট্রিন।
ম্যান্ডেলা ডকট্রিন এর মূল কথা হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ। কোন বর্ণবৈষম্য থাকবে না, কোন জাতিভেদ থাকবে না, সাদা-কালোয় কোন পার্থক্য করা যাবে না। আমরা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকান, সবাই এদেশের নাগরিক। বর্ণ বৈষম্যের দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন এক আফ্রিকা গড়ার কাজটি সহজ ছিল না। হিংসাত্মক, বৈষম্যবাদী, নিপীড়ক এবং চরম বর্ণবাদী সাদা বর্ণের শাসকদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন এক বর্ণবৈষম্যহীন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার জন্য। যে বর্ণবাদী অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ সরকার দীর্ঘ ২৭ বছর (১৯৬২-১৯৯০) কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে তাকে কারাবন্দী করে রেখেছিলেন, সেই অত্যাচারী সরকারের সঙ্গেই শান্তি চুক্তি করেছিলেন শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদ মুক্ত করার জন্য, দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য, জাতিগত বিভেদ দূর করার জন্য এবং তিনি অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন। তিনি নিপীড়ক অত্যাচারকারী জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং শুরু হল এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পদযাত্রা। ম্যান্ডেলা এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে, যেখানে থাকবে না কোন কালদের কর্তৃত্ব বা সাদাদের কর্তৃত্ব। এটা হবে এক দক্ষিণ আফ্রিকা, এক জাতি এবং সকল মানুষের মানবাধিকার সমান থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন এবং এক নতুন আফ্রিকার স্বপ্নের বীজ বপন করেন। তাই তো ২৭ বছর অবর্ণনীয় নির্যাতন, কারা ভোগের পরও তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতা মানে “কেবল শৃঙ্খলহীন হওয়া নয়, বরং স্বাধীন হওয়া মানে শ্রদ্ধা এবং অন্যের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সাথে বসবাস”। আমরা স্বাধীনতার স্বাদ তখনই উপলব্ধি করতে পারব, যখন অন্য মতাবলম্বীদের ( ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী, বিভিন্ন জাতী-উপজাতি বা ভিন্ন কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী দল) সাথে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের সহিত বসবাস করার সুযোগ তৈরি করতে পারব, যেখানে সবাই নিজেকে স্বাধীন মনে করবে এবং নিরাপদ অনুভব করবে। তিনি বলতেন " ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়, কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না "। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক পৃথিবী গড়তে যেখানে কারোর উপর কারোর কোন কর্তৃত্ব থাকবে না, শুধু গায়ের রঙের ভিত্তিতেই কাউকে অন্যায়ভাবে বিচার করা হবে না, মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী অধিষ্ঠিত হবে। তিনি তার আদর্শের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি বলতেন "আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।"
রুয়ান্ডার গণহত্যা যেটি ছিল মানবতার এক মহা দুর্যোগময় চরম কলঙ্কিত অধ্যায়। এখানে মাত্র ১০০ দিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে, যাদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। এই ভয়াবহ নির্যাতন পরিচালনাকারীরা ছিল হুতি সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল এবং জুনের মাঝামাঝি ১০০ দিনের ব্যবধানে ইতিহাস কুখ্যাত বর্বর এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এত সংখ্যক মানুষকে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০০ মানুষকে হত্যা করার নজির পৃথিবীর মানুষ কেউ কোনদিন কখনো চিন্তাও করতে পারেনি, যা ছিল কল্পনাতীত। যদিও তারা প্রায় দেখতে একই রকম ছিল, তাদের ভাষাও ছিল একই রকম, গায়ের কালারও একই রকম, গায়ের গঠনও প্রায় একই রকম (শুধু তুতসিরা একটু লম্বাটে এবং চিকন গড়নের ছিল) তথাপি খুব ছোট্ট কিছু জাতিগত বিষয় (যেগুলো মূলত বেলজিয়ামের সৃষ্টি। রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কলনী ছিল) নিয়ে তারা এক নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে হত্যা করে, হুতু স্বামী তাদের তুতসি স্ত্রীদের হত্যা করে। এমনকি হুতু ধর্মযাজকরা তুতসিদের হত্যা করার ব্যাপারে প্ররোচনা দিয়েছে, তাদের মনের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য নারী এবং শিশুদের হত্যা করার পাশাপাশি হাজারো তুতসি নারীকে যৌনদাসী করা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, তানজানিয়ার আরুশা শহরে বসা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল, যেখানে গণহত্যার অভিযোগে দোষীদের বিচার করা হয়। এটি প্রমাণিত সত্য যে অপরাধ করে কেউ সহজে পার পায় না, শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হয়। সেই অপরাধের বিচার এই পৃথিবীতেই ঘটে। ইতিহাস থেকে এই সত্যটাই আমরা দেখতে পাই, কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করি না।
ডিসেম্বর/২০২৩ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল রুয়ান্ডা ভ্রমণের। এ এক অন্য রুয়ান্ডা, যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। দেশের প্রতিটা প্রান্তর, প্রতি ইঞ্চি জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকটা মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশের কোথাও কোন ট্রাফিক পুলিশ সাধারণত দেখা যায় না, কিন্তু মানুষ ট্রাফিক আইন মান্য করছে। কোথাও হেলমেটবিহীন একজন মানুষও পায়নি যে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে কখনো গাড়ির হর্ন বাজায় না। মধ্যরাতেও কোন নারী এখানে অনিরাপদ ফিল করে না। কোন টুরিস্ট এখানে কখনো হয়রানির শিকার হওয়া বা কোনরকম সমস্যার সম্মুখীন হয় না। সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত। মনে হচ্ছিল, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরেও রুয়ান্ড সেই ফিনিক্স পাখির মতো আজ জেগে উঠেছে। রুয়ান্ডা বর্তমানে একটি স্থিতিশীল এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিত। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশটি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বর্তমানে তাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ১০০০ ডলার যেখানে ১৯৯৫ সালে যেখানে তাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৫ ডলার।
আজ রুয়ান্ডার জেগে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে তাদের জনগণ, যাদেরকে এক সময় ডিভাইড করা হয়েছিল। রুয়ান্ডার জনগণের সঙ্গে কথা বলে যে জিনিসটা সুস্পষ্ট মনে হয়েছে যে, আজ তারা না হুতু, না তুতসি, তারা হচ্ছে রুয়ান্ডিয়ান, তারা এই দেশের জনগণ। তারা হুতু-তুতসি পরিচয় ভুলে যেতে চায়। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে হুতু নাকি তুতসি? আপনি তার কাছে উত্তর পাবেন না, তিনি বলবেন, আমি এই দেশের নাগরিক। তারা আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেছেন। রুয়ান্ডা আজ আফ্রিকা তথা সমগ্র পৃথিবীর একটি নিরাপদ দেশ হিসেবে বিবেচিত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রুয়ান্ডা আজ গভীরতম ক্ষত থেকে সেরে ওঠার এবং অন্ধকারতম খাদ থেকে জেগে উঠে শক্তিশালী সমাজ গঠনে মানব সক্ষমতার শক্তিশালী সাক্ষ্য হিসেবে দাড়িয়ে আছে।
১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় তুতসিদের ওপর গণহত্যার ২৮তম বার্ষিকীর আন্তর্জাতিক প্রতিফলন দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন "আজ আমাদের অবশ্যই অসহনশীলতা, যুক্তিহীনতা ও গোঁড়ামি প্রতিটা সমাজের জন্য কতটা বিপজ্জনক, তা স্বীকার করে নিতে হবে।"
৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি তা যেন কোনভাবেই ফিকে হয়ে না যায়, আমাদের কোন কর্মকান্ডে যেন তার সেই আলোর দিশা নিভে না যায়। কিন্তু বাস্তবে অনেক কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছে না। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর আমরা যে স্বকীয়তার সন্ধান পেয়েছিলাম, তা আজ তা আমাদের কর্মকান্ডে ম্লান হওয়ার পথে। আমরা যে মুক্ত বাতাসের স্বাদ পেয়েছিলাম, তা আমাদের অতি লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, অধৈর্য এবং জিঘাংসার জন্য ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, আমরা একজন আরেকজনের ধন-সম্পদ লুট করছি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছি, প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বিভিন্ন রকম মামলায় জড়িত করছি, বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে গণহারে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। মানুষ গড়ার কারিগর যে শিক্ষকরা তারা আজ বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত হচ্ছে। যে ডাক্তার এবং পুলিশরা ২৪ ঘন্টা জনগণের সেবায় নিয়োজিত, তারা আজ ছোট ছোট বিভিন্ন ইস্যুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যবৃন্দ বিভিন্ন রকম মামলায় আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ পুলিশের মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক পদলেহনকারী দুর্বিত্তায়িত চাটুকার, দুর্নীতি পরায়ণ সিনিয়র কর্মকর্তারা সামগ্রিক এই অবস্থার জন্য আজ দায়ী। কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে অন্যরা। যে পুলিশ সদস্যরা দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করবে, তারাই আজ আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের নিজেদেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে কোনভাবেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত ফলাফল পাবো না। কেউই নিরাপদ থাকবো না। আর এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণ। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন ২৭ বছর রুবেন দ্বীপের অন্ধকার কারাগারে অসহনীয় নির্মম যন্ত্রণা ভোগের পরও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা, রুয়ান্ডায় যেমন ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসের পরেও আজ এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে, আমাদেরও সবকিছু ভুলে সবাইকে একসাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের এই নতুন আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমার প্রতিবেশী এবং তার সম্পদ যেন আমার হাতে নিরাপদ থাকে শুধু এইটুকুই নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা এগিয়ে যাব। কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। যতই কৃত্রিমভাবে উজানের ঢেউ বা উজানের পানি দিয়ে কৃত্রিম বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি করা হোক না কেন এই দেশের জনগণ ঠিকই জেগে উঠবে সেই ফিনিক্স পাখির মত, কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না, যার প্রমান এদেশে মানুষ বাস্তবিক পক্ষেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যে কৃত্রিম বন্যা, যে পানির জোয়ারে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে একে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলেই আমরা এগিয়ে যাব।
সত্যিই এক আশা জাগানো খবর, যখন দেখি বন্যার্তদের সার্বিক সহায়তার জন্য আমার ‘রিকশাওয়ালা ভাই তার সারাদিনের আয় দান করে দিচ্ছে, মা-বোনেরা এসে গলার চেইন খুলে বলছে এটা ছাড়া দেওয়ার মত কিছু নেই, হিন্দুরা টাকা দিচ্ছে আস-সুন্নাহতে, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা ত্রাণ এবং খাবার বিতরণ করছে, পূজার জন্য উত্তোলিত টাকা বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় বিতরণ করছে, সম্মিলিত এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষ নৌকা, স্পিড বোট নিয়ে হাজির হচ্ছে, ইঞ্জিনের জন্য তেল লাগবে, ফুয়েল স্টেশন মালিক তেল ফ্রি করে দিচ্ছে, ত্রাণ কর্মীদের যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন বাস কোম্পানি বাস ফ্রি করে দিচ্ছে, নৌকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না- প্রবাসীর হেলিকপ্টার এবং কিছু এজেন্সি থেকে হেলিকপ্টার ফ্রী তে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দূর্গতদের সাহায্যের জন্য, মোবাইলে নেট/মিনিট নাই? মোবাইল অপারেটর ফ্রি নেট/মিনিট সেবা চালু করে দিচ্ছে, মোবাইলে চার্জ নাই -টাওয়ার কর্তৃপক্ষ চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, প্রবাসী ভাইয়েরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে।'
দেশের মানুষকে এতটা একতাবদ্ধ কখনো দেখেছেন? সত্যিই এক অভূতপূর্ব ঘটনা, মহামিলন মেলা, মানবতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ যে আজ জাতি, ধর্ম ,বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ, এটা তার ওই জ্বলন্ত প্রমাণ। আমরা যদি এই ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখতে পারি, এই সহিষ্ণু আচরণ ধরে রাখতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব, নতুবা জাতি হিসেবে আমরা মুখ থুবড়ে পড়বো। দেশ আজ এক নতুন সময় অতিক্রম করছে। আমরা যদি এই সময়ের স্রোতে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করে না নিতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মুখ তুলে উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। আমার ভাই, আমার প্রতিবেশী যেন আমার দ্বারা আক্রান্ত না হয়, আমরা এই শপথে বলিয়ান হই। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো অন্যায়কেই কোনদিনই অন্যায় দিয়ে দমন করা যায় না। অন্যায়কে দমন করতে হয়, ন্যায় দিয়ে। যদিও কাজটি কঠিন, হয়তো খুবই কঠিন, তারপরেও সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায় দিয়েই অন্যায়কে দমন করতে হবে। অন্যায় দিয়ে দমন করতে গেলে হিংসা তৈরি হবে, বিদ্বেষ তৈরি হবে, সমাজে ভেদাভেদ তৈরি হবে, মানুষে মানুষে জিঘাংসা তৈরি হবে। সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন যদি আমরা চাই তাহলে সেটা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেই করতে হবে।
লেখক: পুলিশ সুপার (পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গো থেকে ফেরত পদায়নের অপেক্ষায়)