জলবায়ু পরিবর্তন এবং শ্রমিকের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ
সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৯ পিএম
পহেলা মে মহান শ্রমিক দিবস। পৃথিবীর আশিটিরও বেশি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়। শ্রমিকের রক্ত, শ্রম ও ঘামে সভ্যতার বুনিয়াদ আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে শ্রমিকের অবদান অনস্বীকার্য। সভ্যতার বড় বাবুদের আরাম-আয়েশ, স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যে শ্রমিকদের অবদান থাকলেও শ্রমিকরা ইতিহাসে অপাঙক্তেয় থেকে গেছেন। তাদের জীবনমান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কখনই সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো পুঁজিবাদী ও উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিক দিবস সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।
শ্রমিক দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ'। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে এখনো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ অনেকটাই অবহেলিত। যদিও ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হাজারও শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সরকার, ACCORD, ALLIANCE ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে। তদুপরি অন্যান্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শ্রমিকের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ একবিংশ শতাব্দীর বিরাট চ্যালেঞ্জ।
জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাব হলো ‘হিট স্ট্রেস’। বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই-তিন মাস অসহনীয় গরম পড়ে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০-২৫ বছর পর বছরে ৫-৭ মাস তীব্র গরম পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অত্যধিক গরমে একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলো কাজের গতি কমে যাওয়া, যা মজুরি ও উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবমতে, বাংলাদেশের উত্পাদন খাত হিট স্ট্রেস ও তাপীয় অস্বস্তির কারণে বর্তমানে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারায়, যা ২০৩০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে (আইএলও, ২০১৯)। যদি পোশাক কারখানাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবিষ্যতে এয়ার কন্ডিশনের ওপর বেশি নির্ভর করে, তাহলে এটি বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনকে আরও বাড়িয়ে দেবে; কারণ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রায় একচেটিয়াভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হয়। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ না বাড়িয়ে কিভাবে প্যাসিভ কুলিং কৌশল ব্যবহার করে ভবিষ্যতে কারখানাগুলোকে ঠান্ডা রাখা যায়।
অত্যধিক আর্দ্রতা ব্যাকটেরিয়া এবং কীটপতঙ্গের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে, যা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অভ্যন্তরীণ কর্মীদের জন্য হাঁপানি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের প্রভাবকে অধিকতর খারাপ করতে পারে। কিছু শ্রমিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অংশ হতে পারে। এতে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনুসারে, মাত্র সাত বছরে জলবায়ু-প্ররোচিত উচ্চ তাপমাত্রায় বিশ্বব্যাপী মোট কাজের ঘণ্টার ৩.৮% পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে। এটি ১৩৬ মিলিয়ন ফুল-টাইম চাকরির সমতুল্য এবং ২৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি। দূষিত বায়ু, রোগ-বাহক কীটপতঙ্গ, বন্যা এবং দাবানল ও শ্রমিকদের প্রভাবিত করবে এবং কাজের ক্ষতির দিকে পরিচালিত করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাধারণত অফিসের কর্মীরা নয় প্রধানত প্রভাবিত হবে বাইরের কর্মী, জরুরি প্রতিক্রিয়াকারী ও গরম পরিবেশে কাজ করা কর্মীরা।
শুধুমাত্র চরম তাপমাত্রার সাথে নয়; শ্রমিকদের লড়াই করতে হবে দূষিত বায়ু, রোগ-বাহক কীটপতঙ্গ, বন্যা এবং দাবানল ইত্যাদির সাথে। জলবায়ু সংকটের কারণে এসব প্রভাব আরও বেড়েছে। এগুলো শ্রমিকদের কাজ চালানোর ক্ষমতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে; যা মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ) বলে। Deloitte অনুমান করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ মিলিয়নেরও বেশি চাকরি- জলবায়ু এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
জলবায়ু সংকটের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি ২৪০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে। ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকস অনুসারে, তাপের চাপের ফলে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ জন কর্মসংক্রান্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি কর্মী জলবায়ু-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকির সাথে যুক্ত চাকরিতে রয়েছেন, মার্কিন অলাভজনক কেএফএফ অনুমান করে।
EPA এই "জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপদ" এর পাঁচটি প্রধান স্বাস্থ্য প্রভাব চিহ্নিত করেছে:
তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থ-স্বাস্থ্য: হিট স্ট্রোক এবং তাপ নিঃশ্বাস প্রচণ্ড গরমের সংস্পর্শে আসা কর্মীদের জন্য সুস্পষ্ট বিপদ। এছাড়াও অতি গরমে কাজ করার ফলে ক্লান্তিও একটি ঝুঁকি, কারণ এটি ত্রুটির সম্ভাবনা বাড়ায়। আঘাত বা মৃত্যুর দিকে পরিচালিত করে।
শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা: জলবায়ু সংকট বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ুর গুণমান খারাপ হবে; এছাড়াও দাবানল ও খরা থেকে ধুলো বায়ু দূষণকারীর পরিমাণ বাড়িয়ে তুলবে। একই সাথে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বসন্ত এবং গ্রীষ্মের ঋতুগুলোর দৈর্ঘ্যকে পরিবর্তন করবে, যা বাইরের শ্রমিকদের জন্য জ্বর এবং হাঁপানির মতো সমস্যাগুলিকে বাড়িয়ে তুলবে।
শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব: অগ্নিনির্বাপক এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মতো ফ্রন্টলাইনে থাকা কর্মীদের জন্য; চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির ফলাফলের সাথে মোকাবিলা করার শারীরিক এবং মানসিক শক্তি প্রভাবিত হতে পারে।
রোগ: উষ্ণ তাপমাত্রার সাথে পোকামাকড় বৃদ্ধি পায়, যার অর্থ মশা এবং অন্যান্য রোগ বহনকারী পোকামাকড় থেকে আরও বিপজ্জনক সংক্রমণ।
কীটনাশক সম্পর্কিত প্রভাব: কীটপতঙ্গ বৃদ্ধির ফলে অধিক কীটনাশক ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে থাকা কৃষি শ্রমিকদের প্রভাবিত করবে।
গবেষণায় দেখা যায় যে ঘন ঘন পানি পান করার সুযোগের সঙ্গে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করা কর্মীদের হিট স্ট্রেস এবং অস্বস্তি কমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে দিনের মাঝামাঝি সময়ে শ্রমিকদের মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি ও বমি বমি ভাবের মতো উপসর্গগুলো দেখা যায়, যা উৎপাদনশীলতার ওপর একটি নীতিবাচক প্রভাব ফেলে। গ্রীষ্মে উচ্চ অনুপস্থিতির হারও লক্ষ্য করা গেছে।
ভবন নির্মাণে নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজর দেওয়া সময়ের দাবি।
পেশাদার স্থপতিদের সহযোগিতায় ভবন নির্মাণ করলে শ্রমিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হতে পারে। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়টি এখন পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। কারখানাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকা গবেষণায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলোর সঙ্গে আইনি বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। বিজেএমইএ, বিকেএমইএ কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে কাজ করার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের কথাও চিন্তা করতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে শ্রমিকদের আচরণে কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই বিষয় নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আইএলও কাজ করছে।
কারখানার হিট স্ট্রেস ও শক্তি দক্ষতার ওপর নজর দিতে হবে। এসি ব্যবহারের পরিবর্তে প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা কমানোর বিষয়ে ভাবতে হবে। হিট স্ট্রেস নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প দ্রুত শুরু করা দরকার। কারখানার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে মালিক ও স্থপতিদের একযোগে কাজ করতে হবে। নারীর শরীর তাপমাত্রা সহায়ক নয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নারী শ্রমিক যেন কর্মক্ষমতা না হারায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন কারণে নারীর শরীর তাপমাত্রা সহায়ক নয়। সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক হিসেবে যেমন নারী কর্মক্ষমতা হারাবেন, তেমনি কারখানাও উৎপাদন ক্ষমতা ও হারাবে। কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। পোশাক খাতে কেন নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। কারখানার বাইরে পোশাক শ্রমিকদের আবাসন নিয়েও ভাবতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত প্রভাব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
সর্বোপরি শ্রমিকের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ উন্নয়নে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি।
লেখক: শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী
saifulislamswapnil01@gmail.com