Logo
Logo
×

বাতায়ন

মেধাপাচার ও তারুণ্যের দেশপ্রেম 

Icon

সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২২ পিএম

মেধাপাচার ও তারুণ্যের দেশপ্রেম 

প্রতীকী ছবি

এদেশে কিচ্ছু নেই। চাকরি-বাকরি নেই, উন্নত জীবন নেই, উন্নত শিক্ষা-স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই, সুশাসন, ন্যায়বিচার নেই, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নেই। এদেশে আছে শুধু দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি,মাফিয়া-ডন,কালোটাকা ও পেশীশক্তির প্রদর্শনী, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাব, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা,হয়রানি আরো কত কি! এদেশ কি দিয়েছে? এদেশ থেকে কি পেয়েছি?এ দেশকে আমি কেন ভালোবাসবো? এদেশ আমার জন্য না। এদেশের মানুষ খারাপ, কলুষিত রাজনীতি, দানবীয় ব্যবসায়ী সমাজ, টাউট-বাটপার,চোর-ডাকাতে ভরপুর।

না,এসব অভিযোগ আমার না। এই অভিযোগ, অনুযোগ এদেশের লাখো তারুণ্যের। নিদারুন মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কষ্টে কাটানো প্রজন্মের। কেন এত শত অভিযোগ,অনুযোগ? কেন তারুণ্য দেশ ছাড়ার জন্য এতো উন্মুখ!গবেষণায় প্রতীয়মান, ২০২৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ৫৮টি দেশের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন প্রায় ৫২৭৯৯ জন শিক্ষার্থী, ২০১৩ সালে যা ছিল ২৪১১২জন, ২০০৮ সালে ছিল ১৬৬০৯ জন।গত ১৫ বছরে মেধাপাচার তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ ছাড়ার এই স্রোত রুখে দেওয়ার সাধ্য কার? 

এ ছোট্ট একটি দেশে খুবই সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে ১৭ কোটি মানুষের চাহিদা মেটাতে হয় সরকারকে। ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির এদেশে কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন । এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। তবুও উন্নতজীবন ও আর্থিক নিরাপত্তার আশায় সাতসাগর তেরোনদী পাড়ি দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতে পাড়ি জমান। অনেকেই নিজের আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন, প্রিয়মানুষ ছেড়ে শুধুমাত্র উন্নত সুযোগ-সুবিধা ও স্বপ্নপূরণের আশায় প্রিয় মাতৃভূমিকে ছেড়ে থাকেন। 

এদেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর বাইশ লাখ তরুণ প্রবেশ করেন। যথোপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে অনেকেই হতাশ হন, কষ্টে দিনাতিপাত করেন,কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। অন্যদিকে বিসিএস,ব্যাংক ও সরকারি অন্যান্য সব সেক্টর মিলিয়ে প্রতিবছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে শূন্য পদ মাত্র ১২/১৩ হাজারের মতো। উচ্চশিক্ষিত তরুণরা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করে প্রধানত চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। একটি সোনার হরিণ চাকরি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তারা দিনরাত এক করে পড়াশোনা করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীগুলোতে গেলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। অপরদিকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগে

দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি,অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের আক্ষেপ ও অভিযোগ হর হামেশাই শোনা যায়।সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি  চাকরিতে মাত্র ২৩% নিয়োগ দেয়া হয়; বাকি ৭৭ শতাংশ তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীতে নিয়োগ পায়। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিগত কয়েক বছরে সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগ ও খুব একটা বাড়েনি। 

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র,দুর্নীতি,বিশ্বব্যাপী সমস্যা। স্বল্প সম্পদ দিয়ে বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। তার উপর কোভিড পরবর্তী অভিঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিও টালমাটাল। অন্যদিকে অবৈধ অর্থপাচার ও অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বাংলাদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাগ্রস্ত।

এছাড়াও কাঙ্খিত সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামোগত পরিবেশের অভাবে মেধা অন্যদেশে স্থানান্তরিত হয়। ফলে দেশের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, পরিবেশ, বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা, লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ ও নাগরিকত্বসহ স্থায়ী বসবাসসুযোগ হলো মেধাপাচারের অন্যতম কারণ।এছাড়া উন্নত বিশ্বে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাওয়া আরেকটি কারণ। 

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী প্রতি মাথাপিছু ব্যয় চার-পাঁচ লাখ, বুয়েটে ১০ লাখ ও মেডিকেলে ১৫ লাখের মতো। দরিদ্র,খেটে খাওয়া মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় পড়াশোনা করে অভিবাসী হয়ে মনে করি এদেশ জাহান্নামে যাক।কোন দেশের থিতু হতে পারলেই নিজেকে মুই কি হনুরে মনে করি। এই দরিদ্র দেশের পয়সায় ছোট থেকে পড়াশোনা করে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তৈরি করতে পারছি এটাই বা কম কিসের! উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা দক্ষ জনশক্তির একটা বিরাট অংশ দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যায়।উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু না।  কিন্তু তাদের মধ্যে ৮৫% ঐ সকল দেশে থিতু হতে চান।দেশ তার দক্ষ মেধা ও মননশীল শক্তিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। তার মানে এদেশের  তৈরি করা মেধা এদেশের ভবিষ্যতের উন্নয়নে কোন কাজেই লাগছে না। এটা দেশের জনগণের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।

কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে বলবেন যে রেমিট্যান্স তো পাঠাচ্ছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এদেশের তৈরি করে দেওয়া দক্ষ মানবসম্পদ টোপ দিয়ে উন্নত দেশগুলো নিয়ে যাচ্ছে। সে সকল দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যবহার করছে।তাহলে লাভের গুড় আসলে কে খাচ্ছে? অথচ আমাদের মত দেশগুলোতে দক্ষ জনশক্তির অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তা আমাদের মেধাপাচারের তুলনায় কিছুই না।তাছাড়া পরিবারের একজন চলে গেলে বাকিদের সে সকল দেশে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।এ ধরনের প্রবণতা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ভারতে মেট্রোরেল তৈরিতে খরচ এত কম অথচ বাংলাদেশে বেশি কেন? এক কথায় উত্তর হলো ভারতের দেশীয় প্রযুক্তি, দেশীয় দক্ষ লোকবল, দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা আমাদের নেই। আমরা অনেক কাটখড় পুড়িয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করি যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্বপ্নের পদ্মাসেতু। 

এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে আজাদ এক বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে চার লাখ বিদেশি দক্ষ জনশক্তি কাজ করেন। অথচ দেশের উচ্চশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ বেকার কাঙ্খিত চাকরি খুঁজে পান না। তাহলে সমস্যা কোথায় ? সমস্যা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে শিক্ষা কারিকুলামের সংযোগ খুবই কম। অর্থাৎ অনার্স, মাস্টার্স করেও কাঙ্খিত টেকনিক্যাল জ্ঞান ও সফট স্কিল অর্জন করতে আমাদের শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু আমাদের অভিবাসী দক্ষ জনগোষ্ঠীর ৫০ ভাগও যদি দেশে ফিরে আসেন তাহলে অনেকাংশেই আমরা স্বনির্ভর হতে পারব । অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারব। 

পাশের দেশ ভারত থেকেও প্রতিবছর উচ্চ শিক্ষার জন্য উন্নত দেশগুলোতে প্রচুর শিক্ষার্থী অভিবাসী হিসেবে প্রতিবছর উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমায়। তবে সরকারের শর্ত থাকে যে ডিগ্রি শেষ করে দেশে ফিরতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চ শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হলেও বিদেশে ডিগ্রি প্রাপ্ত কাউকে ফিরিয়ে  আনার জন্য সেরকম উদ্যোগ বা প্রণোদনা দেখা যায় না। একজন অভিবাসী কম সুযোগ-সুবিধা, কম বেতনে এদেশে কেন ফিরে আসবেন!এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,যুক্তরাষ্ট্রের ১২ শতাংশ বিজ্ঞানী, ৩৮ শতাংশ ডাক্তার ও নাসার চল্লিশ শতাংশ বিজ্ঞানী ভারতীয় বংশোদ্ভূত। 

মেধাপাচার রোধে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় যথাযথ গুরুত্বারোপ,বিদেশ ফেরত দক্ষ অভিবাসীদের যথাযথ মূল্যায়ন, মেধাবীদের বৃত্তি বা উপবৃত্তি প্রদান, সব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধার প্রাধান্য, নতুন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশিষ্ট ও মেধাবীদের বিভিন্ন পদক-পুরস্কার ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সরকার থেকে মেধাবীদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের দ্রুত বিকশিত ও আধুনিকায়নভিত্তিক উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে মেধাপাচার রোধ গুরুত্বপূর্ণ।বিশেষজ্ঞদের মতে, মেধাপাচার রোধে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে,কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।রাষ্ট্রকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। 

জন এফ কেনেডি বলেছিলেন,'দেশ তোমাকে কি দিয়েছে তা জিজ্ঞেস করো না, তুমি দেশকে কি দিতে পেরেছ নিজেকে জিজ্ঞেস করো '।এই নিরেট সত্য, দেশাত্মবোধ,দেশপ্রেম আমাদের কয়জনের মধ্যে আছে! বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের কথা আমরা জানি।বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার ছেড়ে নিতান্তই দেশকে ভালবেসে মাত্র ৩০০০ টাকা বেতনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।একজন স্বার্থপর, পরগাছা নাগরিকের চেয়েও দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ বাংলা মায়ের দামাল সন্তান অনেক বেশি প্রয়োজন। সারাজীবন দেশের খেয়েপরে, এদেশের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এদেশের প্রতি দায়বদ্ধতা না রেখে তথাকথিত উন্নতদেশে চিরতরে  চলে যায় তারা কি নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হন না!তাদের মনে রাখা উচিত,'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী'।

লেখক:শিক্ষক ও কলামিস্ট
saifulislamswapnil01@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম