বসানো হল প্রথম স্প্যান
স্বপ্ন থেকে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু
প্রধানমন্ত্রীর একক নেতৃত্বের ফসল -ওবায়দুল কাদের * ‘যথাসময়েই শেষ হবে কাজ’ * দুই পারের মানুষের চেহারায় খুশির ঝিলিক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৭, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুটি পিলারের ওপর ধীরে ধীরে বসানো হল একটি স্প্যান। আর এর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হল পদ্মা বহুমুখী সেতু। প্রায় দূর হল স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক। এরপর একটির পর একটি, এভাবে ৪০টি স্প্যান বসিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হবে সেতুর। সেদিনটিও বেশি দূরে নয়- জানালেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রথম স্প্যান বসানোর কাজ তদারক করছিলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, বিয়ারিংয়ের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে এ স্প্যান বসানো হয়। এরপরও ঐতিহাসিক মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে সুবিধাজনক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এ কাজের উদ্বোধন করবেন।
শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের (খুঁটি) ওপর এ স্প্যানটি বসানো হয়। এ সময় সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দুই পারের মানুষের মধ্যে বয়ে যায় খুশির ঝিলিক।
স্প্যান বসানোর পর সেখানেই সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ওয়ায়দুল কাদের। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন এই প্রকল্প থেকে চলে যায়, তখন পদ্মা সেতু প্রকল্প অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা পড়ে। অনেকেই ভেবেছিল এই সেতু আর হবে না। কিন্তু সে সময় প্রধানমন্ত্রী অসম সাহসে মশাল ধরেছিলেন। তার একক নেতৃত্বের ফসল পদ্মা সেতু আজ কোনো রঙিন স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। তিনি বলেন, এমন একটি দিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর রূপকার তারই কন্যা, বিপন্ন মানবতার বাতিঘর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রী তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঊর্মিমালার মতো আজ উদ্বেলিত আমার হৃদয়। আজকের এই দিন জাতীয় জীবনে সোনালি স্বপ্নের দিন। এখানে অবদান আছে সবার; সচিব, প কল্প পরিচালক, জনপ্রতিনিধি, পদ্মার দুই পারের জনগণ, সেনাবাহিনীর। আজ কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, শুধু কাজ চালিয়ে নিলাম। প্রধানমন্ত্রী এখন ওয়াশিংটনে আছেন। আমরা ফোন করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব কিনা। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘অপেক্ষা করতে হবে না, তোমরা কাজ চালিয়ে যাও, পদ্মা সেতুর কাজ এক মিনিটও যেন বন্ধ না থাকে।’ তিনি যখন আসবেন, তখন সবাইকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। এজন্যই আমরা আজ কাউকে ডাকিনি।
মন্ত্রী আরও বলেন, এ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে পদ্মা সেতুর অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৪৯ শতাংশ। নদী শাসনের কাজ হয়েছে ৩৪ শতাংশ। মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ শতভাগ শেষ। জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ ৯৮ শতাংশ হয়েছে সম্পন্ন। এছাড়া সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজও শতভাগ শেষ। ওবায়দুল কাদের বলেন, শুরু করতে দেরি হলেও যথাসময়েই শেষ হবে সেতুর কাজ।
এ সময় সেতুমন্ত্রী ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল ইসলাম এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে মোট ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। বসানো প্রথম স্প্যানটি চীনে তৈরি হয়েছে। এর অংশগুলো সমুদ্রপথে জাহাজে করে দেশে আনা হয়। সেখান থেকে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে নিয়ে ফিটিং করা হয়। এটির ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। ৩ হাজার ৬০০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন দিয়ে মাওয়া থেকে জাজিরা প্রান্তে এটি আনা হয়। গত রোববার মাওয়া থেকে যাত্রা শুরু করে সোমবার সকালে জাজিরায় ৩১ নম্বর খুঁটির সামনে স্প্যানটি পৌঁছে। এখান থেকে আবার ড্রেজিং করে শুক্রবার ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির কাছাকাছি ক্রেনটি নেয়া হয়। এদিন বেলা ২টার দিকে ক্রেন দিয়ে খুঁটির ওপরে স্প্যানটি তোলার কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে এক মিটার ব্যবধানে স্প্যানটি খুঁটি বরাবর ঝুলিয়ে রাখা হয়। শনিবার সকাল ৮টা থেকে আবার কাজ শুরু হয়। ৯টার দিকে নাট-বল্টু স্প্যানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্প্যানটি পুরোপুরি খুঁটির ওপর স্থাপন করা হয়।
দ্বিতল পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। খুঁটির ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপরে কংক্রিটের প্লাটফর্ম দিয়ে চলবে যানবাহন।
সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। কিন্তু ডিজাইন পরিবর্তন মানেই নেগেটিভ কিছু নয়। সামান্য একটু পরিবর্তন করা হলেও সেটাকে বলা হয় ডিজাইন পরিবর্তন। সেতু বাস্তবায়ন করতে গেলে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছুই করতে হয়। এজন্য সেতুর কাজ বাধাগ্রস্ত হবে না। নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।
সূত্র জানায়, সেতুর দ্বিতীয় স্প্যানটি অক্টোবর মাসের শেষের দিকে স্থাপন করা হবে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ১২টি স্প্যান চীন থেকে শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এর আগে মাওয়ায় ১০টি স্প্যান চলে এসেছে। সেতুতে মোট খুঁটি হবে ৪২টি। এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। বর্তমানে ১৬টি পিলারের নির্মাণের কাজ চলমান। পদ্মা সেতুর প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাইলের সংখ্যা ২৪০টি। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬৮টি পাইলিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ১৭টি পাইল বসানোর কাজ চলমান আছে।
২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এই কাজের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব কাজে ব্যয় হচ্ছে ৭ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৪৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর কাজ শুরু হয়। এর পৌনে দুই বছর পর প্রথম স্প্যান বসল শনিবার।
যুগান্তরের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, শিবচর ও লৌহজং প্রতিনিধি জানান, অনেকেই নৌকায় করে দূর-দূরান্ত থেকে স্প্যান বসানো দেখতে আসেন। অনেকেই ভিড় করেন নদীপাড়ে। তবে নিরাপত্তার জন্য নৌকাগুলোকে কাছে ভিড়তে দেয়নি সেনাবাহিনী। বাধ্য হয়ে দূর থেকেই তা দেখেন স্থানীয়রা। এরপরও তাদের চেহারায় ছিল আনন্দের আভা। সবখানেই এদিন আলোচনার বিষয়ও ছিল স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
২০১৮ সালে নভেম্বরে মূল সেতুর কাজ শেষ করার আশা করা হচ্ছে। কাজ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ সারা দেশে সামগ্রিক অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা।