ও আমার জন্মভূমি ও আমার মাতৃভাষা...

হাবীবাহ্ নাসরীন
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশ ও ভাষার জন্য লড়াইয়ের এমন ইতিহাস খুব কম দেশেরই আছে। আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য বুকের তাজা রক্ত আর জীবন দিয়ে গেছেন বহুজন। আমরা হয়তো তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়নও করতে পারিনি। তাই বলে এতটুকু ম্লান হয়নি তাদের অবদান। বরং দিনে দিনে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এই তো বিগত বছরের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান-সবকিছু মনে করিয়ে দেয়, আমরা জুলুম মেনে নেই না। দেশ ও মাতৃভাষার প্রশ্নে আমরা আপসহীন। আমরা যে আমাদের পূর্বসূরিদের যোগ্য প্রতিনিধি তা প্রমাণ করেছি বারবার। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এক হয়েছি নানা ধর্ম ও মতের মানুষ। লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ কোনো অশুভ শক্তির হাতে তুলে দিতে আমরা সম্মত নই। আমাদের আছে চোখভরা স্বপ্ন আর বুকভরা সাহস। আমাদের তরুণরা সবচেয়ে দামি জীবন দিয়ে সে কথাই বারবার প্রমাণ করে আসছে। ২৪-এর জুলাই-আগস্টের স্মৃতি এখনো জীবন্ত। দেশ এবং ভাষা নিয়ে তরুণদের ভাবনা কী? কথা বলেছেন কয়েকজন তরুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইজা জারিফ জুঁই বলেন, নিজের দেশকে নিয়ে প্রত্যেকেরই স্বপ্ন থাকে, আমারও আছে। আমার স্বপ্ন-দেশের আর কেউ যেন কনকনে শীতের রাতে ক্ষুধা পেটে নিয়ে উষ্ণতাহীন জেগে না থাকে। কেউ কোনো প্রতারণা করবে না, অপরাধ কমে আসবে, ঘুস খাবে না, দুর্নীতি করবে না, সবকিছুতে সমতা নিশ্চিত হবে, কেউ কাউকে দোষারোপ করবে না। নিজেরা নিজেদের দোষগুলো শুধরে একত্রিত হয়ে আমরা দেশটাকে নিজেদের স্বপ্নের মতো করে সাজাব। ভাষার মাসে আরেকটা কথা না বললেই নয়, বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব। কিন্তু যখন এ ভাষাকেই আমরা বিকৃত করে বলি শুধু নিজেকে উঁচু শ্রেণির বোঝানোর জন্য, সেটি খুবই শ্রুতিকটু এবং অসম্মানজনক। বিকৃত ভাষায় বলা বা লেখা কোনোটিই সাবলীল নয়! আমার স্বপ্ন যেন আমরা প্রত্যেকে বাংলা ভাষার উপযুক্ত সম্মান দিতে পারি। জুলাই বিপ্লবের খুব বেশি দিন হয়নি, এ বিপ্লব যেন সফল হয়, শহিদের রক্তের মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ন থাকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী তাসনিম লাবিব বলেন, আমি সেই বাংলাদেশ দেখেছি, যেখানে একজন ঢাকা মেডিকেলে পড়ুয়া শিক্ষার্থী হয়ে নিজের ক্যাম্পাসে চলতে হয়েছে বন্দির মতো। আবার সেই বাংলাদেশের বাতাসেও আমি শ্বাস নিয়েছি যেখানে ওই একই ক্যাম্পাসে স্বপ্নের ডানা মেলে উড়তে পেরেছি মুক্ত স্বাধীন বিহঙ্গের মতো। কিন্তু এ পার্থক্যটা নিয়ে এলো কে? নিয়ে এলো রক্তস্নাত জুলাই। নিয়ে এলো তারা, যারা মুক্তির খোঁজে বন্দুকের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে গেছে, গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু, পিছিয়ে যায়নি; এ স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তারা, যারা কীটপতঙ্গের মতো বাঁচতে চায়নি, চেয়েছে স্বাধীন মানুষ হিসাবে বাঁচতে, নয়তো স্বাধীন মানুষ হিসাবে মরতে। এই নতুন স্বাধীনতা এক নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, জন্ম দিয়েছে এক নতুন চেতনার, মানুষের মনে জন্ম দিয়েছে এক নতুন আশার। আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে স্বাধীনতা ও সংস্কারের। আমরা কেবল নিজের ভাষায়ই কথা বলি না, এখন প্রাণ খুলেও কথা বলতে পারি। কিন্তু এত সত্যের উল্লাসের মাঝেও যখন দেখি স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট মেয়েটি; এমনকি দুবছরের শিশুটিও এ দেশে গণধর্ষণের শিকার হয় এবং যথার্থ বিচার পায় না, যখন দেখি এখনো দেশের অনেক খাতে মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হয় না, এখনো কিছু পিশাচের দল ক্ষমতার অপব্যবহারে পিছপা হয় না তখন খানিকটা হতাশ হই। তবে হাল ছাড়া যাবে না। কারণ আমি ও আমরা স্বপ্ন দেখি সেই বাংলাদেশের, যেখানে যোগ্যতা হবে যে কোনো মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি, যেখানে কোনো নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হবে না, কোনো নাগরিক সন্ত্রাসের ভয়ে তটস্থ থাকবে না, প্রত্যেকের নাগরিক অধিকার শতভাগ নিশ্চিত হবে। আমরা সেই বাংলাদেশের বাতাসে শ্বাস নিতে চাই, যেখানে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হবে সে মানুষ এবং আমরা প্রত্যেকেই প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে উঠব। আমাদের ভাষা হবে ভালোবাসার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী আরবী সুবাহ বলেন, আমাদের মুখের ভাষা আর দেশ নিয়ে স্বপ্নের শেষ নেই। বড়রা মনে করতেন, আমরা কোনো কাজের নই। আমাদের হাতে হয়তো দেশ নিরাপদ নয়। কিন্তু আমরা সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছি। স্বৈরাচার তাড়ানোর আন্দোলনে আমাদের অনেক ভাইবোন প্রাণ দিয়েছেন, অনেকে খুইয়েছেন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছিলাম সোচ্চার। বিনিময়ে যা অর্জিত হয়েছে, আমরা তার মর্যাদা ধরে রাখতে চাই। আমি চাই দেশটা দূষণমুক্ত হোক। ট্রাফিক জ্যামে আমাদের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট না হোক। সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক না হয়ে সারা দেশে দায়িত্ব বণ্টন হোক। এতে প্রিয় শহর ঢাকা নিশ্বাস নিতে পারবে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা যেন সঠিক মর্যাদা পায়, বিকৃত না হয়। কারণ ভাষার জন্য, দেশের জন্য জীবন দেওয়া জাতি আমরা। শহিদ ও যোদ্ধাদের ঋণ আমাদের শোধ করতেই হবে!