এই সেদিনও সাধারণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। সপ্তাহের ছুটির দিনে কোন কোন সময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল আনন্দের বিষয়। যে কোন উৎসব-আনন্দে প্রিয়জনদের বিভিন্ন আবদারের মধ্যে থাকত সিনেমা দেখাতে হবে। সিনেমা হলমুখী মানুষের এই গল্পগুলো এখন অনেকটাই ইতিহাস। মানসম্মত সিনেমার অভাব ও হলগুলোর অনুন্নত পরিবেশের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সাধারণ দর্শক। দেশের হলগুলোতে দর্শক না আসায় গত দেড় দশকে সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে প্রায় এক হাজার। সিনেমা হল ভেঙে অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন মালিকরা। যেগুলো ঠিকে আছে সেগুলোও লাভের মুখ দেখছে না অনেকদিন। অধিকাংশ সিনেমা হল মালিক-কর্মচারীদের কাছে হল চুক্তিতে চুক্তিতে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। সিনেমা হল ব্যবসার এই বেহালদশার জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে সারাদিন সিনেমা দেখানো, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম কলা-কৌশলীর অভাব, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ পরিচালক দিয়ে সিনেমা নির্মাণসহ সরকারি সুনজরের অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিনেমা হলের একাল-সেকাল
বাংলাদেশে নব্বই দশকের আগের হলের সংখ্যা প্রায় ১৩০০। আর রাজধানীতে প্রায় ৪০টি। বর্তমানে সারা দেশে হলের সংখ্যা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে ৩০০-তে। ঢাকায় রয়েছে ১২-১৩টি। দেশের প্রতিটি জেলাতে একাধিক সিনেমা হল ছিল একসময়। কিন্তু বর্তমানে অনেক জেলাতে সিনেমা হল নেই। যদিওবা আছে হলে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই। পুরো সিনেমা হল ব্যবসায় ধস নামে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় শত শত সিনেমা হল। অসংখ্য স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট, নকল ছবি, অশ্লীল ও বাজে গল্পের কারণে ক্রমেই হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শক।
রাজধানীর কাকরাইলের রাজমণি ও রাজিয়া সিনেমা হলের ম্যানেজার মো. অহিদ জানান, আগে একটা ছবি একমাস ধরে চলত। সারা মাস হলভর্তি দর্শক থাকত। লাভও হতো। এখন হল চালানই কঠিন। শুক্রবারে কিছু দর্শক হয়। আর বাকি দিনগুলো ফাঁকা থাকে। টিকেটের জন্য দর্শক বাইরে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃশ্যটা এখন ভাবাই যায় না। হল ব্যবসা বাদ দিয়ে মালিকরা মার্কেট বানাচ্ছেন বা অন্য কিছু করছেন। আর কীইবা করার আছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক নাছিরউদ্দিন দিলু বলেন, আগে মানুষ দুটো কারণে হলে যেত : এক, পরিবেশ; অন্যটা ভালো সিনেমা। এখন কোনোটাই নেই। হলে সুন্দর পরিবেশ নেই। এদিকে মানসম্মত ছবিও নেই। কিসের জন্য যাবে সিনেমা হলে। সিনেমার মাধ্যমে কিছু দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দু-একটা ছবি যখন ভালো আসে তখন কিন্তু দর্শক আসে। তার মানে ভালো সিনেমা বানানো হলে দর্শক আসবেন। সরকারের একটা প্ল্যান আছে যে প্রতিটা জেলায় একটা করে মিনি থিয়েটার করার। এটা হলে কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণ হবে। মূল কথা হল ভালো সিনেমা বানাতে হবে।
হলগুলোর হালচাল
সিনেমা হলে দর্শক যায় একটু বিনোদনের জন্য। সেই বিনোদন উপভোগ করার পরিবেশ অধিকাংশ সিনেমা হলের বাইরে-ভেতরে কোথাও নেই। হল প্রাঙ্গণ অপরিচ্ছন্ন, ভেতরে গরম ও দুর্গন্ধে ভরপুর। সিট ভাঙা, ছারপোকার আক্রমণ। সঙ্গে রয়েছে হল কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার। এছাড়া হলকেন্দ্রিক মাদকাসক্ত ও বখাটেদের অবস্থান দর্শকদের বিব্রত করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নোমান আবদুল্লাহ জানান, বিগত তিন বছরে তিনি একটি সিনেমাও হলে গিয়ে দেখেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একে তো ভালো ছবি নেই। তার ওপর হলের পরিবেশ খুবই বাজে। এক ধরনের ভ্যাপসা গরম সবসময় লেগে থাকে। তার ওপর শান্তিতে বসে সিনেমা দেখা যায় না। সিটগুলো আরামদায়ক নয়। বিভিন্ন জায়গায় ছেড়া বা ভাঙা। সঙ্গে ছারপোকার কামড়। এত সমস্যা নিয়ে সিনেমা দেখা যায় না।
এ বিষয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পূর্ণিমা সিনেমা হলের ম্যানেজার কাঞ্চন মিয়া বলেন, আমাদের পরিবেশ ভালো। কোনো সমস্যা নেই। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হল ব্যবসা ভালো চলছে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। বলতে গেলে সমস্যা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাকরাইলের একটি হলের মালিক বলেন, হলমুখী দর্শক নেই, ব্যবসাও নেই। এজন্য হলও কম। হলগুলোকে সরকারি অনুদান দিলেই যে দর্শক হলে আসবেন এমনটা না। দর্শক আসা না আসাটা ছবির মেকিংয়ের ওপর নির্ভর করবে। আপনি ভালো ছবি নির্মাণ করবেন, হলে দর্শক আসবেই। আর দর্শক এলে হলের ব্যবসা ভালো হবে। তখন হল মালিকরাও তাদের হলগুলোকে সুসজ্জিত করতে পারবেন।
সিনেমা দেখার জন্য ভাড়ায় পাওয়া যায় সঙ্গী
রাজধানীর বিভিন্ন সিনেমা হলের আশপাশে ঘুরে দেখা গেছে, হলগুলোর আশপাশে সন্ধ্যা হলেই যৌনকর্মীদের ভিড় বেড়ে যায়। রাজধানীর রাজমণি, আনন্দ, পূর্ণিমা এবং পূরবী হল ঘুরে এ অবস্থা দেখা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায় এসব যৌনকর্মী বাসা বা হোটেলে না গিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গেই সিনেমা হলে যান। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে সিনেমার টিকিট এবং ঘণ্টা হিসেবে টাকা দিতে হয়। সাধারণত ১০০ থেকে ২০০ টাকার বিনিময়ে এসব তরুণী সিনেমা হলে সঙ্গ দিতে যান। তবে এ ধরনের বেলাল্লাপনা চলে হলগুলোর নিুশ্রেণির টিকিটে। হলের ভেতরে প্রবেশ করার পর লাইটম্যান বা ভেতরে যারা আসন বিন্যাসের দায়িত্বে থাকেন তাদের হাতে ১০-২০ টাকা ধরিয়ে দিলেই অন্ধকারে বসার ব্যবস্থা করে দেন।
সরেজমিন, পূর্ণিমা সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে গেলে একজন তরুণী ইশারায় তাকে হলে নেয়ার আহ্বান জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তরুণী বলেন, পেটের দায়ে এসব করি। হলের ভেতরে পুলিশি ঝামেলা নাই। ভেতরের লোকজনরে ২০ টাকা দিলেই কোনো সমস্যা হয় না। একদিনে দুইটা শো’তে যাওয়ার সুযোগ হয়।
বাড়ছে মাল্টিকমপ্লেক্সের সংখ্যা
একদিনে সিনেমা হল বন্ধ হলেও ক্রমে বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটারের সংখ্যা। ২০০৪ সালে বসুন্ধরা শপিংমলে চালু হয় স্টার সিনেপ্লেক্স। প্রথম দিকে ব্যবসা সফল হতে না পারলেও বর্তমানে তারা সেই অবস্থা থেকে উঠে এসে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। সম্প্রতি যমুনা ফিউচার পার্কে চালু হয়েছে ‘ব্লক বাস্টার’। উন্নতমানের পরিবেশ এবং ভালো সেবা প্রদান করায় ইতিমধ্যেই ব্লক বাস্টার মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। প্রচুর দর্শক সমাগম হচ্ছে সেখানে। শ্যামলী সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে শ্যামলী স্কয়ার শপিংমল। যার এক অংশে রয়েছে শ্যামলী সিনেমা। হল মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে সিনেপ্লেক্স ট্রেন্ড আসছে। বাইরের লোকজনও এসে এখানে সিনেমা চালাবে। কিছুদিন আগেও বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স লসের মধ্যে ছিল। এখন তারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুভি রিলিজ দিচ্ছে। এটা ভালো দিক। পাকিস্তানের লাহোরে মাত্র একটি সিনেপ্লেক্স ছিল। এখন তাদের দেশে ২৫টি সিনেপ্লেক্স আছে। ইন্ডাস্ট্রি ক্রমেই ভালো হচ্ছে। একসময় আমাদের দেশেও এই ট্রেন্ড চালু হবে।
কিন্তু সিনেপ্লেক্সের প্রচারিত ছবিগুলো সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিনেমার আবেদন সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। একশ্রেণীর মানুষ সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখছেন। বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। মূল কথা, সবার জন্য সিনেমা অথচ মধ্যবিত্তের জন্য সিনেমা হচ্ছে না।
আগে সপরিবারে ছবি দেখার যে ট্রেডিশন ছিল এখন সেটা নেই। বাইরের সেনেমা হলগুলোর মান ভালো না, ছবিও নেই। তাহলে কিসের টানে দর্শক হলে আসবে। অনেকে বলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৪ সালে ছবি রিলিজ হয়েছে ৪০টা, ২০১৫ সালে রিলিজ হয়েছে ৩৮টা। এই ৩৮টা দিয়ে তো হল চলবে না। এছাড়া চ্যানেলের ছবিগুলোতো আর আমাদের এখানে চলে না। মূলত চ্যানেলের আগ্রাসন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এই সেক্টরটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। এখন দেশের পরিবেশ সঙ্গে মানানসই ও বিশ্বমানের ছবি তৈরি করতে না পারলে এই ব্যবসায় সুফল পাওয়া খুব কঠিন।
সিনেমা হল বন্ধের নেপথ্যে
বাংলাদেশে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হল ভালো সিনেমার অভাব। সিনেমাবোদ্ধাদের মতে, সিনেমা সিনেমার মতো হতে হবে। সিনেমা যদি নাটকের মতো হয় তাহলে দর্শক আসবে কীভাবে? আগে সিনেমা হলে উপচেপড়া ভিড় হতো। এত চ্যানেল ছিল না। এখন প্রতিটা চ্যানেলেই বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সিনেমা দেখাচ্ছে। ভালো জিনিস উপহার দিতে পারলেই দর্শক হলে আসবেন। ভালোমানের সিনেমা হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর লস দিয়ে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে মালিকদের। যারা পারছে তারা ঠিকে আছে নিয়েছেন। বাকিরা হল বন্ধ করে অন্য ব্যবসা ধরেছেন।
সিনেমা হল বন্ধের কারণ জানিয়ে মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কারণ ভালো ছবি নেই। ভালো ছবি না থাকায় ব্যবসা নেই। ফলে হলগুলোও নেই হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থার জন্য তিনি এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, প্রবীণ নির্মাতারা এখন আর নতুন সিনেমা বানাচ্ছেন না। নতুনরা বানাচ্ছেন। নাটকের পরিচালক এসে সিনেমা বানাচ্ছেন। সিনেমা হচ্ছে নাটকের মতো। নাটকের মুভমেন্ট এক জিনিস আর সিনেমারটা আলাদা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতি আসার পর। দেখা যায় নাটকের ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করে ফেলছে। এতে না কালার থাকে না মান। কিছুই হয় না। আমাদের দেশে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষিত কলা-কৌশলী। যারা সিনেমা বানানোটা শিখে এই সেক্টরে আসবেন। তখন ছবি বানানো হলে সেটা ভালো হবে। তখন দর্শক হলে আসবে। ব্যবসাও ভালো হবে। আর ব্যবসা ভালো হচ্ছে দেখলে অন্যরাও হল ব্যবসায় আসতে চাইবেন। ক্রমে হলের সংখ্যা বাড়বে।
একই সুরে কথা বলেন সিনেমা হল মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, বলা হয় সিনেমা হলের পরিবেশ খারাপ। হল মালিকের ব্যবসা হলেতো সিনেমা হলের মালিকরা তাদের হলের পরিবেশ ভালো রাখবেন। এখন ৮০ ভাগ সিনেমা হল কর্মচারীদের কাছে ভাড়া দেয়া আছে। ভাড়া দিয়ে যেটা চলছে সেটা থেকে তো ভালো কিছু আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, আমরা সিনেমা হল মালিকরা বিদ্যুৎ বিল দিতে পারি না, কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না। এগুলোর ব্যবস্থা আগে করবো না সিনেমা হলটাকে সাজাব। কোনটা করব। আয় নাই কেমনে করব। যদি আশার আলো দেখা যেত যে বাংলাদেশে ভালো ছবি হচ্ছে তাহলে একটা কথা ছিল। আমি রাজশাহীতে একা একটা হল নিয়ে বসে আছি। পাঁচটা হলের মধ্যে চারটা বন্ধ হয়ে গেছে। একা আছি তারপরও চলে না। লোকসানের ব্যবসাটা কে কতদিন ধরে রাখবেন?
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখনই সিনেমা হল উন্নয়নের জন্য তিনি মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছিলেন। এখন হল ২০১৬। এই ক’বছরে শুধু কথা হচ্ছে আর ফাইল চালাচালি হচ্ছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নের কোনো কিছুই হচ্ছে না।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পাততাড়ি গুটাচ্ছে সিনেমা হলগুলো
এই সেদিনও সাধারণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। সপ্তাহের ছুটির দিনে কোন কোন সময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল আনন্দের বিষয়। যে কোন উৎসব-আনন্দে প্রিয়জনদের বিভিন্ন আবদারের মধ্যে থাকত সিনেমা দেখাতে হবে। সিনেমা হলমুখী মানুষের এই গল্পগুলো এখন অনেকটাই ইতিহাস। মানসম্মত সিনেমার অভাব ও হলগুলোর অনুন্নত পরিবেশের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সাধারণ দর্শক। দেশের হলগুলোতে দর্শক না আসায় গত দেড় দশকে সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে প্রায় এক হাজার। সিনেমা হল ভেঙে অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন মালিকরা। যেগুলো ঠিকে আছে সেগুলোও লাভের মুখ দেখছে না অনেকদিন। অধিকাংশ সিনেমা হল মালিক-কর্মচারীদের কাছে হল চুক্তিতে চুক্তিতে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। সিনেমা হল ব্যবসার এই বেহালদশার জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে সারাদিন সিনেমা দেখানো, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম কলা-কৌশলীর অভাব, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ পরিচালক দিয়ে সিনেমা নির্মাণসহ সরকারি সুনজরের অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিনেমা হলের একাল-সেকাল
বাংলাদেশে নব্বই দশকের আগের হলের সংখ্যা প্রায় ১৩০০। আর রাজধানীতে প্রায় ৪০টি। বর্তমানে সারা দেশে হলের সংখ্যা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে ৩০০-তে। ঢাকায় রয়েছে ১২-১৩টি। দেশের প্রতিটি জেলাতে একাধিক সিনেমা হল ছিল একসময়। কিন্তু বর্তমানে অনেক জেলাতে সিনেমা হল নেই। যদিওবা আছে হলে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই। পুরো সিনেমা হল ব্যবসায় ধস নামে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় শত শত সিনেমা হল। অসংখ্য স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট, নকল ছবি, অশ্লীল ও বাজে গল্পের কারণে ক্রমেই হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শক।
রাজধানীর কাকরাইলের রাজমণি ও রাজিয়া সিনেমা হলের ম্যানেজার মো. অহিদ জানান, আগে একটা ছবি একমাস ধরে চলত। সারা মাস হলভর্তি দর্শক থাকত। লাভও হতো। এখন হল চালানই কঠিন। শুক্রবারে কিছু দর্শক হয়। আর বাকি দিনগুলো ফাঁকা থাকে। টিকেটের জন্য দর্শক বাইরে দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃশ্যটা এখন ভাবাই যায় না। হল ব্যবসা বাদ দিয়ে মালিকরা মার্কেট বানাচ্ছেন বা অন্য কিছু করছেন। আর কীইবা করার আছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক নাছিরউদ্দিন দিলু বলেন, আগে মানুষ দুটো কারণে হলে যেত : এক, পরিবেশ; অন্যটা ভালো সিনেমা। এখন কোনোটাই নেই। হলে সুন্দর পরিবেশ নেই। এদিকে মানসম্মত ছবিও নেই। কিসের জন্য যাবে সিনেমা হলে। সিনেমার মাধ্যমে কিছু দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দু-একটা ছবি যখন ভালো আসে তখন কিন্তু দর্শক আসে। তার মানে ভালো সিনেমা বানানো হলে দর্শক আসবেন। সরকারের একটা প্ল্যান আছে যে প্রতিটা জেলায় একটা করে মিনি থিয়েটার করার। এটা হলে কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণ হবে। মূল কথা হল ভালো সিনেমা বানাতে হবে।
হলগুলোর হালচাল
সিনেমা হলে দর্শক যায় একটু বিনোদনের জন্য। সেই বিনোদন উপভোগ করার পরিবেশ অধিকাংশ সিনেমা হলের বাইরে-ভেতরে কোথাও নেই। হল প্রাঙ্গণ অপরিচ্ছন্ন, ভেতরে গরম ও দুর্গন্ধে ভরপুর। সিট ভাঙা, ছারপোকার আক্রমণ। সঙ্গে রয়েছে হল কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার। এছাড়া হলকেন্দ্রিক মাদকাসক্ত ও বখাটেদের অবস্থান দর্শকদের বিব্রত করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নোমান আবদুল্লাহ জানান, বিগত তিন বছরে তিনি একটি সিনেমাও হলে গিয়ে দেখেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একে তো ভালো ছবি নেই। তার ওপর হলের পরিবেশ খুবই বাজে। এক ধরনের ভ্যাপসা গরম সবসময় লেগে থাকে। তার ওপর শান্তিতে বসে সিনেমা দেখা যায় না। সিটগুলো আরামদায়ক নয়। বিভিন্ন জায়গায় ছেড়া বা ভাঙা। সঙ্গে ছারপোকার কামড়। এত সমস্যা নিয়ে সিনেমা দেখা যায় না।
এ বিষয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পূর্ণিমা সিনেমা হলের ম্যানেজার কাঞ্চন মিয়া বলেন, আমাদের পরিবেশ ভালো। কোনো সমস্যা নেই। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হল ব্যবসা ভালো চলছে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। বলতে গেলে সমস্যা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাকরাইলের একটি হলের মালিক বলেন, হলমুখী দর্শক নেই, ব্যবসাও নেই। এজন্য হলও কম। হলগুলোকে সরকারি অনুদান দিলেই যে দর্শক হলে আসবেন এমনটা না। দর্শক আসা না আসাটা ছবির মেকিংয়ের ওপর নির্ভর করবে। আপনি ভালো ছবি নির্মাণ করবেন, হলে দর্শক আসবেই। আর দর্শক এলে হলের ব্যবসা ভালো হবে। তখন হল মালিকরাও তাদের হলগুলোকে সুসজ্জিত করতে পারবেন।
সিনেমা দেখার জন্য ভাড়ায় পাওয়া যায় সঙ্গী
রাজধানীর বিভিন্ন সিনেমা হলের আশপাশে ঘুরে দেখা গেছে, হলগুলোর আশপাশে সন্ধ্যা হলেই যৌনকর্মীদের ভিড় বেড়ে যায়। রাজধানীর রাজমণি, আনন্দ, পূর্ণিমা এবং পূরবী হল ঘুরে এ অবস্থা দেখা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায় এসব যৌনকর্মী বাসা বা হোটেলে না গিয়ে খরিদ্দারের সঙ্গেই সিনেমা হলে যান। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে সিনেমার টিকিট এবং ঘণ্টা হিসেবে টাকা দিতে হয়। সাধারণত ১০০ থেকে ২০০ টাকার বিনিময়ে এসব তরুণী সিনেমা হলে সঙ্গ দিতে যান। তবে এ ধরনের বেলাল্লাপনা চলে হলগুলোর নিুশ্রেণির টিকিটে। হলের ভেতরে প্রবেশ করার পর লাইটম্যান বা ভেতরে যারা আসন বিন্যাসের দায়িত্বে থাকেন তাদের হাতে ১০-২০ টাকা ধরিয়ে দিলেই অন্ধকারে বসার ব্যবস্থা করে দেন।
সরেজমিন, পূর্ণিমা সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে গেলে একজন তরুণী ইশারায় তাকে হলে নেয়ার আহ্বান জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তরুণী বলেন, পেটের দায়ে এসব করি। হলের ভেতরে পুলিশি ঝামেলা নাই। ভেতরের লোকজনরে ২০ টাকা দিলেই কোনো সমস্যা হয় না। একদিনে দুইটা শো’তে যাওয়ার সুযোগ হয়।
বাড়ছে মাল্টিকমপ্লেক্সের সংখ্যা
একদিনে সিনেমা হল বন্ধ হলেও ক্রমে বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটারের সংখ্যা। ২০০৪ সালে বসুন্ধরা শপিংমলে চালু হয় স্টার সিনেপ্লেক্স। প্রথম দিকে ব্যবসা সফল হতে না পারলেও বর্তমানে তারা সেই অবস্থা থেকে উঠে এসে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। সম্প্রতি যমুনা ফিউচার পার্কে চালু হয়েছে ‘ব্লক বাস্টার’। উন্নতমানের পরিবেশ এবং ভালো সেবা প্রদান করায় ইতিমধ্যেই ব্লক বাস্টার মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। প্রচুর দর্শক সমাগম হচ্ছে সেখানে। শ্যামলী সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে শ্যামলী স্কয়ার শপিংমল। যার এক অংশে রয়েছে শ্যামলী সিনেমা। হল মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে সিনেপ্লেক্স ট্রেন্ড আসছে। বাইরের লোকজনও এসে এখানে সিনেমা চালাবে। কিছুদিন আগেও বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স লসের মধ্যে ছিল। এখন তারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুভি রিলিজ দিচ্ছে। এটা ভালো দিক। পাকিস্তানের লাহোরে মাত্র একটি সিনেপ্লেক্স ছিল। এখন তাদের দেশে ২৫টি সিনেপ্লেক্স আছে। ইন্ডাস্ট্রি ক্রমেই ভালো হচ্ছে। একসময় আমাদের দেশেও এই ট্রেন্ড চালু হবে।
কিন্তু সিনেপ্লেক্সের প্রচারিত ছবিগুলো সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিনেমার আবেদন সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। একশ্রেণীর মানুষ সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখছেন। বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। মূল কথা, সবার জন্য সিনেমা অথচ মধ্যবিত্তের জন্য সিনেমা হচ্ছে না।
আগে সপরিবারে ছবি দেখার যে ট্রেডিশন ছিল এখন সেটা নেই। বাইরের সেনেমা হলগুলোর মান ভালো না, ছবিও নেই। তাহলে কিসের টানে দর্শক হলে আসবে। অনেকে বলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৪ সালে ছবি রিলিজ হয়েছে ৪০টা, ২০১৫ সালে রিলিজ হয়েছে ৩৮টা। এই ৩৮টা দিয়ে তো হল চলবে না। এছাড়া চ্যানেলের ছবিগুলোতো আর আমাদের এখানে চলে না। মূলত চ্যানেলের আগ্রাসন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এই সেক্টরটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। এখন দেশের পরিবেশ সঙ্গে মানানসই ও বিশ্বমানের ছবি তৈরি করতে না পারলে এই ব্যবসায় সুফল পাওয়া খুব কঠিন।
সিনেমা হল বন্ধের নেপথ্যে
বাংলাদেশে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হল ভালো সিনেমার অভাব। সিনেমাবোদ্ধাদের মতে, সিনেমা সিনেমার মতো হতে হবে। সিনেমা যদি নাটকের মতো হয় তাহলে দর্শক আসবে কীভাবে? আগে সিনেমা হলে উপচেপড়া ভিড় হতো। এত চ্যানেল ছিল না। এখন প্রতিটা চ্যানেলেই বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সিনেমা দেখাচ্ছে। ভালো জিনিস উপহার দিতে পারলেই দর্শক হলে আসবেন। ভালোমানের সিনেমা হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর লস দিয়ে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে মালিকদের। যারা পারছে তারা ঠিকে আছে নিয়েছেন। বাকিরা হল বন্ধ করে অন্য ব্যবসা ধরেছেন।
সিনেমা হল বন্ধের কারণ জানিয়ে মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কারণ ভালো ছবি নেই। ভালো ছবি না থাকায় ব্যবসা নেই। ফলে হলগুলোও নেই হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থার জন্য তিনি এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, প্রবীণ নির্মাতারা এখন আর নতুন সিনেমা বানাচ্ছেন না। নতুনরা বানাচ্ছেন। নাটকের পরিচালক এসে সিনেমা বানাচ্ছেন। সিনেমা হচ্ছে নাটকের মতো। নাটকের মুভমেন্ট এক জিনিস আর সিনেমারটা আলাদা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতি আসার পর। দেখা যায় নাটকের ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করে ফেলছে। এতে না কালার থাকে না মান। কিছুই হয় না। আমাদের দেশে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষিত কলা-কৌশলী। যারা সিনেমা বানানোটা শিখে এই সেক্টরে আসবেন। তখন ছবি বানানো হলে সেটা ভালো হবে। তখন দর্শক হলে আসবে। ব্যবসাও ভালো হবে। আর ব্যবসা ভালো হচ্ছে দেখলে অন্যরাও হল ব্যবসায় আসতে চাইবেন। ক্রমে হলের সংখ্যা বাড়বে।
একই সুরে কথা বলেন সিনেমা হল মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, বলা হয় সিনেমা হলের পরিবেশ খারাপ। হল মালিকের ব্যবসা হলেতো সিনেমা হলের মালিকরা তাদের হলের পরিবেশ ভালো রাখবেন। এখন ৮০ ভাগ সিনেমা হল কর্মচারীদের কাছে ভাড়া দেয়া আছে। ভাড়া দিয়ে যেটা চলছে সেটা থেকে তো ভালো কিছু আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, আমরা সিনেমা হল মালিকরা বিদ্যুৎ বিল দিতে পারি না, কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না। এগুলোর ব্যবস্থা আগে করবো না সিনেমা হলটাকে সাজাব। কোনটা করব। আয় নাই কেমনে করব। যদি আশার আলো দেখা যেত যে বাংলাদেশে ভালো ছবি হচ্ছে তাহলে একটা কথা ছিল। আমি রাজশাহীতে একা একটা হল নিয়ে বসে আছি। পাঁচটা হলের মধ্যে চারটা বন্ধ হয়ে গেছে। একা আছি তারপরও চলে না। লোকসানের ব্যবসাটা কে কতদিন ধরে রাখবেন?
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখনই সিনেমা হল উন্নয়নের জন্য তিনি মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছিলেন। এখন হল ২০১৬। এই ক’বছরে শুধু কথা হচ্ছে আর ফাইল চালাচালি হচ্ছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নের কোনো কিছুই হচ্ছে না।