
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাশকতা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা। সম্প্রতি ট্রেনে আগুনসহ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সামনের দিনগুলোয় এমন ঘটনা ঘটতে পারে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা এ শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা। তবে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও জানান তারা।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এসব বক্তব্য দেন তারা। ঢাকা অঞ্চলের ছয় জেলার মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সবাইকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেন।
ইসি (নির্বাচন কমিশন) ১০ অঞ্চলের নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা অঞ্চলের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হলো। বিকালে ঢাকা জেলার ২০টি আসনের প্রার্থীদের নিয়েও সভা করেছে ইসি। সভায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম।
বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের বক্তব্যেও নির্বাচনে নাশকতার আশঙ্কার বিষয়টি উঠে আসে। সভার আলোচনার বিষয়ে মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন আয়োজন করতে নানারকম চ্যালেঞ্জ থাকে। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তাদের যে পরিকল্পনা আছে, তা আমাদের জানিয়েছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং একে অপরকে ওই তথ্য আদান-প্রদান করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারে, সেই নির্দেশনা দিয়েছি।
অপরদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, অন্যান্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্টেকহোল্ডারদের একমুখী সমস্যা থাকে। সেটা হলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের আচরণবিধি মানতে বাধ্য করা এবং নির্বাচনে সহিংসতাপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে সুষ্ঠু ভোট আয়োজন করা। এবারের জাতীয় নির্বাচনে আরেকটি অতিরিক্ত বিষয় যুক্ত হয়েছে সেটি হচ্ছে- নাশকতা, আতঙ্ক ও শঙ্কা সৃষ্টির মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একটি বা দুটি রাজনৈতিক দলের আহূত কর্মসূচি সামনে রেখে পুলিশের পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি, এসব সমস্যা ও শঙ্কা মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনি পরিবেশ গড়ে তোলার মতো অবস্থান ও সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ- এ ছয় জেলার ডিসি, এসপি, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ওসি, ইউএনওসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। যে কজন ওসি বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই জানিয়েছেন নির্বাচনের পরিবেশ ভালো রয়েছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন তাদের বক্তব্যে নির্বাচনে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের বক্তব্যে উঠে আসে, বিশেষ কয়েকটি দল এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সাম্প্রতিক ট্রেনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তুলে ধরে সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটতে পারে বলেও জানান তারা। বিশেষ করে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর সময় হামলার আশঙ্কা করেন তারা। কর্মকর্তারা বলেন, জানুয়ারিতে শীত মৌসুম হওয়ায় কুয়াশা থাকবে। কিছু কেন্দ্রের যাতায়াতব্যবস্থা ভালো নয়।
সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে দূরবর্তী কেন্দ্রগুলোর জন্য একাধিক স্থানে ব্যালট পেপার সংরক্ষণের প্রস্তাব করেন। জবাবে ইসি জানিয়েছে, ভোর ৪টায় রওয়ানা দিয়ে সকাল ৮টার আগে পৌঁছানো যাবে- এমন কেন্দ্রে সকালেই ব্যালট পেপার পাঠাতে হবে। এরপরও সমস্যা মনে করলে আপনারা (রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) নিজেরা বসে সমন্বয় করবেন। কোথায় কী ধরনের সমস্যা হবে ব্যালট পৌঁছাতে, সেটা লিখিত জানালে কমিশন বিবেচনা করবে। ব্যালট পেপারের নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় করার জোর দেন। এছাড়া ভোটারদের মধ্যে আস্থা অর্জনের নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর আরও যা বলেন : নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। সভার পর তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারসহ যত কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানে কাজ করছেন- সবাই যেন সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন, সেটা বলা হয়েছে। কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে যেন তারা কোনো ধরনের আচরণ না দেখান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার যেহেতু বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসছে না, তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন বাতিলের যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে- সেগুলোর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কীভাবে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা যায় এবং ভোটাররা যাতে উৎসাহিত হয়ে ভোট দিতে আসেন, সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত দেখছি আনন্দমুখর পরিবেশ আছে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে মোটেও ভয় পাচ্ছি না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বতন্ত্র ও ছোট ছোট দলের প্রার্থীরা ঠিকমতো প্রচার করতে পারবেন কি না, সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদেরকে প্রশাসন ও ইসির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে- আপনাদের সবরকম সহযোগিতা করা হবে। আপনারা নিজেরা সেখানে থাকবেন। আপনাদের এজেন্টদের কোনো সমস্যা হলে প্রিসাইডিং অফিসারদের জানাবেন। তিনি সমাধান করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে। সেখানে পুলিশ, র্যাব, আর্মি, বিজিবি থাকবে- তাদের জানাবেন।
ডিএমপি কমিশনারের ব্রিফিং : সভার পর হাবিবুর রহমান আরও বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সেজন্য যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ হয়, সেখানে কোনো সহিংসতা না হয়, তৃতীয় পক্ষ যাতে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে এবং সমস্যা সৃষ্টি করলে যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, সে বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।
রেলওয়ের নাশকতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, একটি নাশকতা নয়, একাধিক নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিভিন্নভাবে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এর বেশির ভাগই পুলিশ উদ্ঘাটন করতে এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। বাকি যারা আছে, তারা আইনের আওতায় চলে আসবে বলে আশা করি। এগুলো যাতে ঘটাতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ট্রেন ও বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে। ট্রেন ও রেললাইনের নিরাপত্তায় আনসার মোতায়েন করা হয়েছে।
ভোটকেন্দ্রে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসির যেসব আদেশ-নির্দেশ রয়েছে, তা মেনে চলার জন্য সবাই বদ্ধপরিকর। যারা নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করছেন, তারা ইসির এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। ভোটের আগের দিন নির্বাচনি সামগ্রী ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যাবে। কেবল ব্যালট পেপার সকালে পৌঁছানো হবে। দুর্গম, হাওড়, চরাঞ্চলগুলোয় ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইসির সিদ্ধান্ত রয়েছে এবং সেভাবে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি আশা করি, এতে কোনো সমস্যা হবে না। সবার সম্মিলিত প্রয়াস থাকলে সামনে যে নির্বাচনি যুদ্ধ, সেটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারব।
৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে- এ বিষয়ে পুলিশের পদক্ষেপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোট উৎসবমুখর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য যারা রয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে অনেকখানি করতে সক্ষম হয়েছেন। নাশকতা ও চোরাগুপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে- এ ধরনের নাশকতা উপেক্ষা ও মোকাবিলা করে পুলিশ ও জনগণ একসঙ্গে হয়ে ইসির অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে।