আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর রিটের শুনানিতে যা হলো
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৯:৩১ পিএম
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব মৃত্যু হয়েছে, তা সবার জন্যই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, জাতির ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করা আমাদের উচিত হবে না।
মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসেন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সংক্রান্ত এক রিটের শুনানিতে এমন মন্তব্য করেন। আদালত শুনানি ও আদেশের জন্য বুধবার পরবর্তী দিন রেখেছেন।
এর আগে সোমবার ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিমকোর্টের দুই আইনজীবী। তারা হলেন, আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিচালক, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, জানতে বিবাদীদের প্রতি রুল জারির আরজি জানানো হয়েছে রিটে। সেই সঙ্গে কথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তি দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রিটে সে মর্মেও রুল চাওয়া হয়। সোমবার ও মঙ্গলবার রিটের ওপর শুনানি হয়।
মঙ্গলবার রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনীক আর হক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তাদের সহযোগিতা করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, নুরুল ইসলাম সুজন, আজহার উল্লাহ ভূঁইয়া ও শাহ মঞ্জুরুল হক শুনানিতে অংশ দেন। এদিন বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনে এজলাস কক্ষ পরিপূর্ণ ছিল।
মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের শুনানি করছিলেন রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী অনীক আর হক। শুনানিতে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়ার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন শুনানিতে তুলে ধরেন তিনি।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক। তখন আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ‘নিঃসন্দেহে (দুঃখজনক)। একটা জীবন যখন চলে যায়, তখন কোনো পক্ষ থাকে না। আর এটা ছয় বছরের একটি শিশুর মৃত্যু! তখন এই আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘আমরা কোর্টে ইমোশনাল বিষয় অ্যাড্রেস করব না। আমরা খুব লজ্জিত।’
এরপর আইনি দিক তুলে ধরে আইনজীবী অনীক আর হক শুনানিতে বলেন, পুলিশকে যদি গুলি চালাতেই হয়, তবে পা লক্ষ্য করে গুলি করতে হবে। রাতে ডাকাত ধরার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে শুধু সরাসরি গুলি করতে পারবে। আদালত বলেন, আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে জাতির ক্ষতি হয়। আইনজীবী বলেন, জাতির ক্ষতি বলতে শুধু কিছু ভবন, স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি বোঝালে হবে না। জীবনের ক্ষতিও জাতির ক্ষতি। আগে বিক্ষোভ দমন বা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গরম পানি, মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করত।
আদালত তখন বলেন, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। তার আগে মাইকিং করে সতর্ক করতে হবে। আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কখন আর্মি কল করতে পারে সেটিও আইনে বলা আছে। পুলিশকে যে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসেনি।
শুনানিতে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ছয় সমন্বয়ককে যে হেফাজতে রাখা হয়েছে, এটা তো স্বীকৃত। আইন কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে কাউকে এভাবে হেফাজতে রাখার সুযোগ নাই। আইনি ক্ষমতার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। বলা হচ্ছে যে, তাদের (ছয় সমন্বয়ক) আত্মীয়স্বজনরা দেখা করতে পারছেন। কিন্তু তারা (ছয় সমন্বয়ক) কার সঙ্গে দেখা করতে চান বা চান না, সেটা জানার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলছে। আদালত বলেন, একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আটকাতে হবে। হয় রিমান্ডে নিতে হবে, নয় আদালতে তুলতে হবে।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর। শুনানিতে তিনি ছয় সমন্বয়কের জীবন ঝুঁকি ও হুমকির কথা তুলে ধরেন। আর এ কারণেই ডিবি তাদের হেফাজতে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তখন আদালত বলেন, তাদের যে মেরে ফেলবে এই কথাটা তাদেরই বলতে হবে। সে তো আশ্রয় চায়নি।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, রিট আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এসেছেন। তারা একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। এখানে যারা এসেছেন (রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী) তারা সবাই এই কমিশনের সদস্য। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান রিট আবেদনকারী একজনের বাবা। এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে আদালত তাদের নিভৃত করেন।
জাতিসংঘের একটি সনদ উদ্বৃত করে মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। ওই সনদ অনুসারে অনুপেক্ষিত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা গুলি চালাতে পারবে। কোনটা অনুপেক্ষিত পরিস্থিতি, সে সিদ্ধান্তও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই নিতে হবে। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
শুনানির এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, আমরা আদালতের ভেতরে আছি। আইনের মধ্য থেকে কথা বলব। এমন কিছু বলব না, যাতে শুধু মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়। আদালত তখন বলেন, বিষয়টি সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার। এখন দেশে যে অবস্থা সে পরিস্থিতিতে ছয় সমন্বয়ককে পুলিশ আটকে রাখতে পারে কি না।
জবাবে শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাকে কিভাবে রাখবে সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোটা নিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেখানে সর্বোচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। আদালত আশা প্রকাশ করেছেন, যে তদন্ত কমিশন সরকার গঠন করেছে সেই কমিশন প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করবে। তা সত্ত্বেও তারা (রিট আবেদনকারী পক্ষকে উদ্দেশ করে) গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
সভা-সমাবেশের অধিকার নিয়ে শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, ‘আইনি বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বল প্রয়োগ করেছে, তার কোনো প্রমাণ তাদের (রিট আবেদনকারীদের) কাছে নেই।’ শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ এ রিট আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন শুনানি করবেন বলে জানান। তখন আদালত শুনানি বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেন।