
প্রিন্ট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫৮ এএম
জনমনে আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২০ এএম

আরও পড়ুন
জনমনে আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে অনুষ্ঠিতব্য পুলিশ সপ্তাহে একগুচ্ছ দাবি তুলে ধরা হবে পুলিশের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয়, নাগরিকদের সঙ্গে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক মতবিনিময় সভারও আয়োজন করা হবে। এ ধরনের উদ্যোগ এবারই প্রথম।
দাবিগুলোর মধ্যে আছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ, ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বৃদ্ধি, ঔপনিবেশিক আইন বাতিল, পুলিশ ইউনিভার্সিটি স্থাপন, এনভায়রনমেন্টাল পুলিশ ইউনিট চালু, সাইবার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন, সেন্টার ফর পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) গঠন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনি পরামর্শক নিয়োগ প্রভৃতি।সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল চরমে। তাই ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মানুষ আক্রমণ চালায় পুলিশের ওপর। এতে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য নিহত হন। ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয় থানাসহ পুলিশের স্থাপনা ও যানবাহনে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪৬০টি পুলিশের স্থাপনা। এর মধ্যে অগ্নিসংযোগ করা হয় ৫৮টি থানা, ২৬টি ফাঁড়ি, দুটি তদন্ত কেন্দ্র, ১০৬টি পুলিশ বক্স, ২৯টি অফিস এবং তিনটি অন্যান্য স্থাপনা। ভাঙচুর করা হয় ২৩৬টি স্থাপনা। এর মধ্যে ৫৬টি থানা, ২৪টি ফাঁড়ি, ১০টি তদন্ত কেন্দ্র, ৩০টি পুলিশ বক্স, ২৮টি অফিস, ১৫টি পুলিশ লাইন্স এবং ৭৩টি অন্যান্য স্থাপনা।
এছাড়া হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুলিশের এক হাজার ৭৪ যানবাহন। এসবের মধ্যে ২৯৯টি গাড়ি ও ১৬৫টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। ভাঙচুর করা হয় ৫৪৭টি গাড়ি ও ৭২টি মোটরসাইকেল।
ওই সময় জনবিস্ফোরণের মুখে পালিয়ে যায় পুলিশের তৎকালীন নেতৃত্ব। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এর আগে কখনো পুলিশ এত বিপর্যয়ে পড়েনি। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশের বতর্মান নেতৃত্বকেও। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য সতর্ক পুলিশ প্রশাসন। আর এ কারণেই জনবান্ধব পুলিশ তৈরিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাবে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয়েছে পুলিশ সপ্তাহকে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী পদোন্নতি দেওয়ার সময় তার সততা, মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রশিক্ষণের অর্জিত ফলাফল পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রণোদনার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। এ কারণে প্রশিক্ষণার্থীরা নিজেদের দক্ষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করে না। আগামী পুলিশ সপ্তাহে এ বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, পুলিশের বাজেটে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ ভাগ বরাদ্দ রয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য। এটা খুবই অপ্রতুল। তাই প্রশিক্ষণের জন্য বাজেট বাড়ানোর বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে আধুনিক সরাঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতে ফরেনসিক ল্যাব, সাইবার ল্যাব এবং সাইবার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের দাবিও জানানো হবে।
পুলিশের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার আইন হিসাবে পরিচিত। এটি জনগণের সেবা ও সুরক্ষার পরিবর্তে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যা আধুনিক গণতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই আইন জনগণের কাছে পুলিশ আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা, এটি পুলিশকে আইন বা জণগণের কাছে নয়; বরং সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। পাশাপাশি পুলিশের পেশাগত স্বাধিকার খর্ব করে। তাই এই আইনটির পরিবর্তন জরুরি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুলিশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ওই সব দেশের পুলিশ সদস্যরা পুলিশবিষয়ক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এসব উদাহরণ তুলে ধরে পুলিশ সপ্তাহে বাংলাদেশে পুলিশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির দাবি জানানো হবে।
পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলে সেটির একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষক-গবেষকদের দ্বারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিষদে থাকবেন উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশসহ দেশের যে কোনো নাগরিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে পারবেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, নতুন এবং আকস্মিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জ্ঞান চর্চা ও প্রতিপালনের সংস্কৃতি গভীরভাবে ধারণ করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সেন্টার ফর পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সিপিআরডি হবে পুলিশিং এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা অধ্যয়ন ও গবেষণার একটি তীর্থস্থান। সবার অধ্যয়নের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এটি। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ এবং জনস্বাস্থ্যের ক্রমাগত হুমকি রোধে এনভায়রনমেন্টাল পুলিশ গঠনের প্রস্তাবও আসতে পারে পুলিশ সপ্তাহে।
সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু তাদের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা নেই। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) দেশের সর্বত্র একজন ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও অবারিত নয়। সরকার কর্তৃক আরোপিত নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। বর্তমান বাস্তবতায় আইজিপির ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদেরও নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া উচিত।
সূত্র আরও জানায়, তদন্ত কাজে আইনি সহায়তা ও আদালতে আসামিপক্ষের উকিলের জেরা যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পুলিশ সদস্যদের মধ্য থেকে ‘লিগ্যাল অফিসার্স সেল’ গঠন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ আইনজীবীদের নিয়ে দেশের প্রত্যেক মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশে স্থায়ীভাবে ‘লিগ্যাল প্যানেল’ তৈরি করা যেতে পারে। এ বিষয়টি নিয়েও পুলিশ সপ্তাহে আলোচনা হতে পারে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্টের পর যে অবস্থা হয়েছিল সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। পরিস্থিতি আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে পুলিশ সপ্তাহের ইতিহাসে এবারই প্রথম জনসাধারণের ভাবনা শুনতে আয়োজন করা হচ্ছে নাগরিক সভার।